হিল ভয়েস, ৬ জুলাই ২০২১, ঢাকা: সম্প্রতি জাতীয় ছাপা ও সম্প্রচার গণমাধ্যমে একজন নারী আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। জানা গেছে, বরিশালের উজিরপুর থানায় রিমান্ডে থাকা ঐ নারী আসামিকে রিমান্ড শেষে আদালতে উপস্থাপন করা হলে আসামির শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টি আদালতের নজরে আসে এবং উক্ত নারী আসামির বক্তব্য শুনে আদালত আসামির শারীরিক পরীক্ষা করে জখম, নির্যাতনের চিহ্ন ও নির্যাতনের সম্ভাব্য সময় উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকে নির্দেশ প্রদান করেন। পরবর্তীতে হাসপাতালের রিপোর্টেও ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচার হয়েছে।
এমন ঘটনায় দেশের নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ২২ বিশিষ্ট নাগরিক। বিবৃতিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে থানা হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত অপরাধীদের সনাক্ত করে দ্রুততম সময়ে আইনের আওতায় নেওয়ার দাবি জানান উক্ত নাগরিকগণ।
বিবৃতিতে বলা হয় যে, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনা এটিই যেমন প্রথম নয়, তেমনি এ ধরনের ঘটনায় সকল ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের নজিরও খুব একটা নেই। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো ২০১৪ সালে পল্লবী থানায় পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনায় গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর তারিখে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত নির্যাতনকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও প্রত্যেককে দুই লাখ টাকা ক্ষতিপুরণের আদেশ দিয়ে রায় প্রদানই যার প্রমাণ।
বিবৃতিদাতারা আরো বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫(৪) এবং নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা অমর্যাদাকর আচরণ অথবা শাস্তির বিরুদ্ধে জাতিসংঘ ঘোষিত সনদের অনুচ্ছেদ ২(১) ও ৪ অনুযায়ী এ ধরনের ঘটনায় দ্রুততার সাথে আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রয়েছে।
বরিশালে নারী আসামিকে নির্যাতনের ঘটনায় ইতোমধ্যে দুই ধরনের অপরাধ দৃশ্যমান বলেও নাগরিকরা উল্লেখ করেন। একদিকে থানা হেফাজতে শারীরিক নির্যাতন, অপরদিকে উক্ত নারীকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ। এমতাবস্থায় যথাযথ তদন্তসাপেক্ষে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের পাশাপাশি যৌন নির্যাতনের মাধ্যমে নারীর অধিকার ও মর্যাদা লঙ্ঘনের অপরাধে নির্দিষ্ট আইনে অপরাধীদের বিচারের দাবিও জানান নাগরিকরা।
বিবৃতিদাতারা মনে করেন, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩ ও ২০১৮) এর আওতায় অপরাধীর পৃথক বিচার অনুষ্ঠিত হতে পারে। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, ভিন্ন ভিন্ন অপরাধের দায়ে ভিন্ন ভিন্ন আইনে অপরাধীর বিচারের সুযোগ রয়েছে এবং বাংলাদেশে এ ধরনের বিচারের নজিরও রয়েছে।
বিবৃতিদাতারা উদ্ধেগের সাথে জানান যে, যখনই এ ধরনের ঘটনা ঘটে তখনই সংশি¬ষ্ট কর্তৃপক্ষ অপরাধের বিষয়টি অস্বীকার করেন, অথবা চেপে যান অথবা স্থানীয়ভাবেই মিটিয়ে ফেলেন। সংবাদসূত্রে জানা গেছে, আদালতে ভুক্তভোগী নারীর উত্থাপিত অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন উজিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এমতাবস্থায় যারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধকে আড়াল করতে চায় কিংবা গোপন অথবা অস্বীকার করতে চায় কিংবা মিটমাট করে ফেলতে চায় বা করে তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ও বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করেন নাগরিকরা। তা নাহলে বাংলাদেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকারের বিপন্নতা রোধ করা যাবে না বলেও অভিমত তাদের।
উক্ত বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী বিশিষ্ট নাগরিকরা হলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, ঐক্য ন্যাপ সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সহ-সভাপতি রামেন্দু মজুমদার, মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম, গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট জাহিদুল বারী, মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির, উন্নয়ন কর্মী রোকেয়া কবির, ঢাবি অধ্যাপক ড. এম. এম. আকাশ, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদ, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী এ্যাডভোকেট পারভেজ হাসেম, আরেক আইনজীবী এ্যাডভোকেট তবারক হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সামাদ পিন্টু, ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশ (ইনসাব) এর সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা, গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক জীবনানন্দ জয়ন্ত, উঠোন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভাপতি অলক দাস গুপ্ত, আনন্দন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ক এ কে আজাদ, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের বরিশাল জেলার সাধারণ সম্পাদক কাজী এনায়েতে হোসেন শিবলু এবং সংস্কৃতি মঞ্চের আহ্বায়ক সেলিম রেজা প্রমুখ।