হিল ভয়েস, ৮ জুলাই ২০২১, ঢাকা: পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার ছ আনি পাড়ার ছয়টি রাখাইন পরিবারকে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক উচ্ছেদের প্রক্রিয়ার প্রতিবাদে এবং অধিগৃহীত জমির যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনসহ আদিবাসী রাখাইন জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিকার সুরক্ষার দাবিতে আজ (৮ জুলাই ২০২১) এক সংবাদ সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
নাগরিক সমাজের আয়োজনে অনুষ্ঠিত এই অনলাইন সংবাদ সম্মেলনটি আদিবাসীদের অনলাইন সংবাদ মাধ্যম আইপিনিউজ এর ফেসবুক পেইজে সরাসরি সম্প্রসারিত হয়েছে।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং এর সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে সংযুক্ত ছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল, বাপা’র সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল, জনউদ্যোগের সভাপতি ডা মোস্তাক হোসেন, ছ আনী পাড়ার স্থানীয় বাসিন্দা চিংদামো রাখাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরীণ কণা, নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য মেইনথেইন প্রমিলা প্রমুখ।
উক্ত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার ছয় আনি পাড়ার ৬ টি রাখাইন পরিবারকে কোনো প্রকার ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের পাঁয়তারা চলছে। পায়রা তৃতীয় সমুদ্রবন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণের আওতায় পড়ায় প্রায় তিনশ বছরের প্রাচীন আদিবাসী রাখাইনপল্লী নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।
বন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণের সময় পাড়াটিকে বাদ দেয়ার দাবি জানিয়ে আসলেও কর্তৃপক্ষ তাদের দাবি তোয়াক্কা না করে কয়েক মাস আগে থেকে বারংবার নোটিশ দিয়ে আসছিল দাবি করে তিনি আরো বলেন, বাড়িঘরসহ বিদ্যমান অবকাঠামোর বিপরীতে ক্ষতিপূরণ ও যথাযথ পুনর্বাসনের জন্য দাবি জানানো হলেও সেটির সুরাহা না করেই প্রতিদিন যন্ত্রপাতি নিয়ে একটু একটু করে গ্রামের বিভিন্ন জায়গা ভাঙ্গা হচ্ছে। গত ১০ জুন রাতের আঁধারে রাখাইন পাড়ার প্রবেশ পথ কেটে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়। প্রথা অনুযায়ী প্রতি রাখাইন গ্রামে দুটি শশ্মানভূমি থাকে। যার মধ্যে শতবছরের পুরাতন শশ্মানভূমি পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ কোন রকম অনুমতি ও আলোচনা ছাড়াই ইতোমধ্যে বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলে। অন্য শশ্মান ভূমির উপর রাস্তা নির্মাণ চলছে। বালু ফেলে নষ্ট করে দেয়া হয়েছে তাদের সংরক্ষিত সুপেয় পানির পুকুর। এতে পাড়ার রাখাইনদের মধ্যে বিরাজ করছে ক্ষোভ, অসন্তোষ আর উচ্ছেদ আতঙ্ক। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন তাদের অস্তিত্ব ভয়াবহ সঙ্কটাপূর্ণ।
রোবায়েত ফেরদৌস আরো বলেন, রাখাইন দের জমি, পুকুর, শ্মশানসহ সবকিছু দখল হয়ে যাচ্ছে বলেই নিজভূমি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন তারা। জালিয়াতির মাধ্যমে জমি জবরদখল, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও স্বার্থান্বেষী দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ক্রিয়তার কারণে তারা তাদের ভূমি হারাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। অবিলম্বে কলাপাড়া উপজেলার ছয় আনি রাখাইন পাড়ার ৬টি আদিবাসী পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও তাদের সংস্কৃতি ও জীবনধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এমন জায়গায় পুনর্বাসন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, মৃতদেহ সৎকারের জায়গা এবং বৌদ্ধ বিহার নির্মাণের জায়গা ও অর্থ বরাদ্দ এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পায়রা বন্দরে তাদের চাকুরির ব্যবস্থা করা সহ চার দফা দাবিনামাও তুলে ধরেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ছ আনি পাড়া গ্রামের পরিবারের সংখ্যা ছয়-এ ঠেকে গেল কেন। তাঁদের উচ্ছেদ মেনে নেওয়া কঠিন। ১৯৭০ সালে তখনকার রাখাইন নেতা উ সুয়ে ২২ হাজার ভোট পেয়েছেন। ১৯৭০ সালে যেখানে এক লক্ষাধিক মানুষ ছিল সেখানে আজকে আড়াই হাজারে নেমে গেছে তা মেনে নেয়া কঠিন। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বলে গর্ব করার জায়গাটি দিন দিন লোপ পাচ্ছে। বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজ ও বহু জাতির ও বহু সংস্কৃতির মিলিত মানুষের ফুলের বাগানটি আজ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এককেন্দ্রিক করে ফেলা হচ্ছে। তিনি এই ছয় পরিবারকে বাজার দরের তিনগুন ক্ষতিপূরণ দেয়াসহ পুনর্বাসনের দাবিও করেন এই প্রবীণ নেতা।
আলোচনায় যুক্ত হয়ে বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেন, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটি দেশ পেয়েছি। উন্নয়ন তো করতে হবে। কিন্তু আমরা কেবল মাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাইনি। আমরা রাজনৈতিক উন্নয়ন চেয়েছি, সামাজিক উন্নয়ন চেয়েছি এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়ন চেয়েছি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উন্নয়ন বলেননি। তিনি বলেছেন ‘মুক্তির’ কথা, অধিকারের কথা। আমরা সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে নির্দেশনা নিয়েছি যেখানে বলেছি এমন একটি সমাজ গড়তে চাই যেখানে সাম্য থাকবে, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে। এইসব কি শুধু বলার জন্য লেখা হয়েছে নাকি বিশ্বাস থেকে বা চেয়েছি বলে লেখা হয়েছে তা তিনি বর্তমান যারা দেশ পরিচালনায় আছেন তাঁদের কাছে প্রশ্ন করেন।
তিনি আরো বলেন, এসবের অঙ্গীকার ও প্রত্যয়ের ব্যত্যয় আমরা নিজেরাই ঘটাচ্ছি। এখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায়। প্রকৃত বিরোধীদল বলে কিছু নেই। কিন্তু এখন ক্ষমতায় যারা বসে আছেন তারা নিজেদের বিরোধীতা নিজেরাই করছে বলেও দাবি করেন তিনি। জনস্বার্থে পায়রা বন্দর তৈরী করা হচ্ছে। কিন্তু এই ‘জন’রা হচ্ছে মানুষ। বিদ্যমান বন্দরগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার না করে নতুন একটা বন্দর তৈরী করা হচ্ছে যার মাধ্যমে মানুষকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, পরিবেশ ও প্রতিবেশকে ধ্বংস করা হচ্ছে বলেও মত দেন তিনি।এই ছয়টি রাখাইন পরিবারের অধিকার রক্ষা করতে না পারি তবে মনে করতে হবে মানুষের অধিকার ও নাগরিকের অধিকার রক্ষা করতে পারলাম না।
সংবাদ সম্মেলনে জনউদ্যোগের সভাপতি ডা. মোস্তাক হোসেন বলেন, আমরা গর্ব করি, বাংলাদেশ রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করেছি সকল প্রকার জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে ও সকল প্রকার স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ও সকল প্রকার বৈষম্যের বিরুদ্ধে। যারা জমি দখল করেন এবং সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর চেষ্টা করেন তাদের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল মানুষকে এক হতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও দেশের একজন নাগরিককে তাঁর শ্মশান রক্ষার জন্য আকুতি জানাতে হয়। ভূমি ফিরে পাওয়ার জন্য ব্যকুলতা জানাতে হয়। সরকার নাগরিকদের এই ব্যকুলতা অনুভব করতে পারবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। একটি সমাজ ও রাষ্ট্র কতখানি গণতান্ত্রিক তার বিচার্য বিষয় এই রাখাইন মানুষরা কেমন আছে তার উপর বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।
উক্ত সংবাদ সম্মেলনে আরো বক্তব্য রাখেন এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, বাপা’র সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল, ছ আনি পাড়ার স্থানীয় বাসিন্দা চিংদামো রাখাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরীণ কণা ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য মেইনথেইন প্রমিলা ও নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন প্রমুখ।