মিন্ট অং
পিসিজেএসএসের সাথে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেছে অথচ খেয়ালে রাখবেন সরকারের রাষ্ট্রীয় বাহিনী পিসিজেএসএসকেই দমন-পীড়ন ও চাপে রেখেছে। অপরদিকে সরকারী দলের স্থানীয় নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর একটি মহল ও তাদের মদদপুষ্ঠ বিভিন্ন গণমাধ্যম বরাবরই পিসিজেএসএস-কে সন্ত্রাসী-বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দেয়ার অপপ্রয়াস চালায়। অথচ সরকারের সাথে যারা ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু (জামায়াত ইসলাম, হেফাজতে ইসলাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ) তারা সরকারি ক্ষমতার ছত্রছায়ায় হয়ে যাচ্ছে জঙ্গী-সন্ত্রাসী। বলা যায়, যাদের সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠার কথা তাদেরকে সর্বদা সন্ত্রাসীর আখ্যা দিয়ে আসছে সরকার। অথচ, জঙ্গীদের সাথে যাদের ওঠাবসা সে সকল সংগঠনের সাথে দহরম মহরম সম্পর্ক সরকারের। উল্লেখ করার মতো, পাহাড়ে দীর্ঘদিন ধরে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও সহিংসতা বাধানোর চেষ্টা চালাচ্ছে তথাকথিত সেটেলার বাঙালিদের একটি ভূঁইফোড় সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদ। সম্প্রতি সেই পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের বান্দরবান জেলার সভাপতি কাজী মুজিবর রহমান এক ত্রিপুরা নও মুসলিম হত্যাকান্ডের জন্য সরাসরি পিসিজেএসএকে দায়ী করেন। অথচ ঘটনার সাথে জেএসএসের কোন সম্পর্ক নেই। তা সত্ত্বেও ভিত্তি ছাড়া কথা বলার যাদের অভ্যাস তারা হলেন এই ভূঁইফোড় সংগঠনের সদস্যরা। কাজী মুজিব নিজেই একজন বরিশাল থেকে চলে আসা কট্টরপন্থি সেটেলার। রোয়াংছড়িতে সংঘটিত ঘটনার পরবর্তীতে ওমর ফারুক ত্রিপুরা মুসলিম এর স্ত্রী এবং মেয়ে বাদী হয়ে স্থানীয় থানায় অজ্ঞাতনামায় মামলা করেছেন। ওমর ফারুকের হত্যাকারী কারা এবং তার সাথে পাহাড়ে নয়া জঙ্গী সংগঠন দাওয়াতুল ইসলামের কী সম্পর্ক সে রহস্য মোটেও কাটছে না।
দাওয়াতুল ইসলাম ২০১৬ সালে বাংলাদেশের গুলশানে হলি আর্টিজানে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর উদ্ধারকৃত রুমাল থেকে জানা যায় তারা ঘটিয়েছে সে ঘটনা। তারা বাংলাদেশে পার্বত্য এলাকায় অসহায় ও অস্বচ্ছল মানুষের দুর্বলাতাকে কাজে লাগিয়ে ধর্মান্তরিত করতে থাকেন। তাছাড়াও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ডোনেশন ব্যবহার করতে থাকেন ইসলামী ধর্মান্তরকরণ প্রকল্পে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিগত বিএনপি সরকারের জমানায় নাইক্ষ্যংছড়ির গহীন জঙ্গলে রোহিঙ্গা জঙ্গী গোষ্ঠীকে অস্ত্র এবং রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দিয়েছিল দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপি সরকারের শরিক দলের জামায়াত ইসলামীর এক উচ্চ পদস্থ এক নেতা। তখনকার সময়েও জঙ্গী বিষয়ে সুশীল সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। ধীরে ধীরে সেটি ধামাচাপা পড়ে যায়।
পাহাড়ে অসংখ্য জঙ্গীগোষ্টীর সদস্য আত্মগোপনে রয়েছেন। তারা কোন না কোনভাবে আল-কায়েদা মতাদর্শিক হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে যা প্রথম আলোর ১৪ জুলাই এর প্রতিবেদনে দেখা যায়। সন্দেহাতীত হলো এই, জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোর সাথে পাহাড়ে শান্তি বিনষ্টকারী একটি অংশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকতে পারে। দেখা যায় যে, যারা এ মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে তারা সকলে ইসলামী ভাবধারার। লক্ষ্য করার মতো হলো, পাহাড়ে পার্বত্য চুক্তি সম্পাদন হবার পরে মুসলিমদের একটি অংশ ঘোরতরভাবে বৌদ্ধ ও খ্রীশ্চিয়ান দর্শন বিরোধী ভূমিকায় অবস্থান নিতে শুরু করে এবং সেজন্য সরকারও চায় পার্বত্য অঞ্চলকে ইসলামী শাসনতন্ত্রের অধীনে এনে শাসন করতে। এতে বাংলাদেশের কমবেশি সকল ইসলামী ভাবধারার দলগুলো খুবই আগ্রহী। মূলত তার জন্যেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিও পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন হতে পারছে না।
পাহাড়ের সমস্যা যত দিন যাচ্ছে তত মহা সংকটে পরিণত হচ্ছে। রাজনৈতিক সহিংসতা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তদ্রুপ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অপতৎপরতা চালাচ্ছে। যেমনটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের দুই যুগ অতিক্রম হবার পর এ ধরনের সমস্যা আরও প্রকট হচ্ছে।
পার্বত্য এলাকায় গহীন জঙ্গল ব্যবহার করতে বরং সরকারই সুযোগ করে দিচ্ছে জঙ্গীদের। সরকারের একটি মহল দাবী করছে, পাহাড়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পরিচালিত হচ্ছে। নানা উয়িং এর মাধ্যমে তারা বলতে চাচ্ছে জেএসএস সন্ত্রাসীর দল।কাজেই তাদের কার্যক্রম বন্ধ করার উপায় হিসেবে সরকার পাহাড়ের গহীন জঙ্গল ব্যবহার করতে দিচ্ছে জঙ্গীসহ বিদেশী গ্রুপ এএলপিকেও। মিয়ানমারের অনেক বিদ্রোহী গোষ্ঠী পার্বত্য এলাকায় আশ্রয় নিয়ে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালিত করছে। আরসা, আরএসও এবং এএলপির মতো সন্ত্রাসী দলগুলো সরকারে আশ্রয়-প্রশ্রয় পেয়ে বাংলাদেশের ভূখন্ডে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এবং পরিতাপের বিষয় হলো, সরকার তাদেরকে আশ্রয় দিয়ে রেখেছে একমাত্র রাজনৈতিক ফায়দা লুটানোর জন্য। দেখা যায়, বিগত সংসদ নির্বাচনের সময় এএলপিকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসে এবং নির্বাচনে সরকারি দলের পক্ষে কাজ করার জন্য নির্দেশনাও দেয়া হয়। পাহাড়ে মারমা অধ্যুষিত অঞ্চলে তাদের গ্রহণ যোগ্যতা পাইয়ে দিতে এএলপিকে মগ লিবারেশন পার্টি নামে কাজ পরিচালিত করতে দিচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে সেই আরাকান লিবারেশন পার্টি(এএলপি) তাদের মিশন হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপর আঘাত করেছে যা খুবই দুঃখজনক এবং নিন্দনীয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর অবস্থান নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে ধোঁয়াশা কাটছে না আসলে তারা কী চায় পাহাড়ে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মতো একটি দেশমাতৃকা রক্ষার গৌরবজ্জ্বল প্রতিষ্ঠানকে কলংকিত করা হয়েছে। একটি মহল অভিযোগ করছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদোশের অবিচ্ছেদ্য অংশ সুতরাং পাহাড়েও সেনাবাহিনী থাকবে। এটা নিয়ে কোন দ্বিধা নেই সেনাবাহিনী অবশ্য পাহাড়েও থাকবে। তবে ভাবতে বাধ্য করে তারা আদতে কার অধীন। নিশ্চয় রাজনৈতিক সরকার বা প্রতিষ্ঠানের অধীন। সমতলে চাইলে সেনাবাহিনী মাঠে নামতে পারে না। রাজনৈতিক সরকারের প্রয়োজনে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে তারা মাঠে নামতে পারে। তার আগে নয়। পাহাড়েও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুসারে, বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের অধীনে চলার কথা বলা হয়েছে সেনাবাহিনীকে। অর্থাৎ, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের অধীনে তিন জেলায় তিনটি ক্যান্টনমেন্ট এবং রুমা, আলীকদম এবং দীঘিনালায় মোট ছয়টি ক্যান্টনমেন্ট থাকার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সরকার-সেনাবাহিনী তা এখনও মানতে পারেনি। যার কারণে পাহাড়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অচলাবস্থায় রয়েছে।
পাহাড়ে বিশাল সংখ্যক সামরিক, আধা-সামরিক, পুলিশ বাহিনী থাকতে কীভাবে জঙ্গী গোষ্ঠীগুলো পাহাড়ে আস্তানা বাঁধে। প্রশ্ন থাকে যে, সেসব বাহিনী কি শুধু পাহাড়ে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকারী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে? পাহাড়ের বুকে দীর্ঘ সময়ব্যাপী আদোলন নেই। গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতেই পারছে না অধিকারকামী সংগঠনগুলো। গুটি কয়েক সরকারের লেজুরবৃত্তি করা সংগঠনগুলো বাদে কেউ অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারছে না। তাই এই ফাঁকা মাঠে গোল দিচ্ছে উগ্রসাম্প্রাদায়িক সংগঠনগুলো। তাদের বক্তব্যে সর্বদা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক জেএসএস বিরোধী ভাষা প্রয়োগ করা হয়।
পাহাড়ে যারা যুগ যুগ ধরে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে যাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দিয়ে তাদের ঘর ছাড়া করেছে কারা তা সকলের কাছে জ্ঞাত। পার্বত্য এলাকায় একটি ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে আরেকটি ঘটনার জন্ম দেয়া হয়। তাছাড়া পাহাড়ে সংবাদ প্রচারে মিডিয়াগুলো ‘পোষ্ট-ট্রুথ- তত্ত্ব অনুসরণ করে এবং নিয়ন্ত্রন করা হয় সামরিক অফিস থেকে। এতে করে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায় না। সে সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি জঙ্গী গোষ্ঠীগুলো। যে সময়ে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য এলাকায় গিয়ে নিরাপত্তা সংক্রান্ত মিটিং করে সে সময়ে জঙ্গীরা জানতে পারে তাদের বিরুদ্ধে নয় বরং সেই মিটিং এর উদ্দেশ্য ছিল জেএসএসের বিরুদ্ধে। এতে করে তাদের সাহস আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে।
২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর, রাঙামাটিতে সেনা গোয়েন্দার মহাপরিচালক, র্যাবের মহাপরিচালক, বিজিবির মহাপরিচালক, আনসার বাহিনীর মহাপরিচালক, পুলিশ মহাপরিদর্শক, ২৪তম ডিভিশনের জিওসিসহ সরকারের সিনিয়র সচিবদের উপস্থিতিতে সন্ত্রাসীদের কথা উচ্চারিত হয়। তবে পাহাড়ে কারা সন্ত্রাসী, কারা জঙ্গী কোন কিছুই সরকারী আমলাদের কাছে জানা নেই। কোন একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে এসব কথা বলে থাকেন তারা। এতে করে প্রকৃত সন্ত্রাসী কারা সেটা আড়ালে থেকে যায়। খাগড়াছড়িতে প্রশাসনের নাকের ডগায় টোল পয়েন্ট বসিয়ে চাঁদা আদায় করছে সন্ত্রাসীরা। রাতের আঁধারে যে সকল সাংবাদিক সন্ত্রাসী খোঁজার নাম করে নাটক করে তারাই মূল সন্ত্রাসী। বন্দুক-পিস্তল গুঁজে দিয়ে যারা সন্ত্রাসী খোঁজেন তারাই আসলেই জঙ্গী সন্ত্রাসীদের মদদ দাতা ও প্রশ্রয় দাতা।
পাহাড়ে জঙ্গী দলগুলো আস্তানা বেঁধেছে। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী এতদিন কোথায় ছিলেন। যার নাম উঠে এসছে মাওলানা মাহমুদুল হাসান গুনভী তিনি তো দীর্ঘদিন ধরে কট্টর ইসলাম ধর্ম প্রচার করে যাচ্ছেন পাহড়ে। তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেক অসহায় জুম্ম আদিবাসীরা ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রশাসন কি জানত না? পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরীহ বৌদ্ধদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে হাজারও গুনভী জড়িত আছেন নিঃসন্দেহে বলা যায়। গুভীদের কাছে ধর্ম একটি ব্যবসা, ধর্ম একটি শোষণের হাতিয়ার, তাদের কাছে কোন ধর্মেরই গুরুত্ব নেই। গুরুত্ব শুধু ধর্মকে কাজে লাগিয়ে জঙ্গী-সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করা।
পাহাড়ে ইসলামী শাসন কায়েম করতে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করছে। পাহাড়ে মাদ্রাসা স্থাপন, মসজিদ নির্মাণ, ধর্মান্তরিতকরণ এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কাজে বহু উগ্র সাম্প্রদায়িক ইসলামী ব্যক্তিকে নিযুক্ত করা হয় এবং টাকাও খরচ করা হয়। সমতল এলাকার মসজিদের মৌলভীদের আচরণ খুব ভাল। কিন্তু পাহাড়ের মসজিদগুলোর ইমামরা অন্য ধর্মাবলম্বীদের মোটেও ভাল চোখে দেখে না। এটাই প্রমাণ করে, তাদেরকে পার্বত্য এলাকায় ইসলামী শাসন কায়েম করতে প্রশিক্ষণ দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এবং যারা সে পরিবেশে বাস করে তারাও একই প্রকৃতির হয়ে উঠে।
কাজেই আসুন, জেনে নিই পাহাড়ে প্রকৃত সন্ত্রাসী এবং জঙ্গী কারা। কারা পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি বিনষ্ট করছে। কারা পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সামনে বড় বাধা। আধিবাসী জুম্মসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ব্যতীত পাহাড়ে কোনদিন শান্তি ফিরবে না। সমস্যা সমাধান শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন ছাড়া কোন বিকল্প নেই।