বাচ্চু চাকমা
যুগে যুগে পৃথিবীর বুকে নিপীড়িত মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাসে যুগসন্ধিক্ষণে তরুণরাই কেবল সকাল-বেলার উদীয়মান সূর্যের মতোই আবির্ভাব হয়েছে। একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম তরুণরাও নিপীড়িত ও বঞ্চিত জুম্ম জনগণের মাঝে একমাত্র উদীয়মান সূর্যের ন্যায় আলোর দ্যুতি ছড়িয়ে যাবে ও পাহাড়ের প্রতিটি প্রান্তরে নিপীড়িতদের আশা জাগানিয়ার গান শুনাবে এবং নিজেদের আত্মমর্যাদাবোধের বলে জুম্ম জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণে সবসময় সচেষ্ট থাকবে। বৈশাখের প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও জুম্ম তরুণরা লড়াই সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রচনা করার বাসনায় এবং এই মহান উদ্দেশ্য সাধনে তারা সম্ভাবনাময় পথ ধরে অগ্রভাগে এগিয়ে চলেছে। এই ঝড়-বাদলের দিনে গভীর রাত আমার অন্তরাত্মাকে ঘুম পাড়িয়ে অচেতন করতে অক্ষম। শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়-অত্যাচারের শত আঘাতে মনের বেদনা ও যন্ত্রণাকে দমিয়ে রাখতে খুব কষ্ট হয়। ৭০ দশকের জুম্ম তরুণরা দুই যুগের অধিক কাল বৈশাখীর ঝড়-ঝাপটা পার করেছে বনে-জঙ্গলে, প্রকৃতির সকল অন্তরায় অতিক্রম করে শাসকগোষ্ঠীকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছে। সারকথা হল এই, চুক্তি স্বাক্ষর করা যতটাই কঠিন তার চাইতে চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়ন করা আরও বেশি কঠিন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নের স্বার্থে জুম্ম তরুণ প্রজন্মকে প্রয়োজনে আরও অসংখ্য বৈশাখ পার করে এগিয়ে যেতে হবে। শাসকগোষ্ঠীর হিংসা, অবিশ্বাস, ঘৃণা ও দ্বেষ মানবিকতাকে হত্যা করতে আজ উদ্যত। পাহাড় জুড়ে শাসকগোষ্ঠীর বিষাক্ত আবহাওয়ার মধ্যেই জুম্ম তরুণরা অনেকেই শুনতে পেলেন জুম্ম জাতির মুক্তির আহ্বান, নিপীড়িত জুম্ম জনগণ দেখতে পেলেন জুম্ম তরুণদের মাঝে নতুনের আলো। শাসকগোষ্ঠী ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমাদের জুম্ম জাতির উপর, বিপরীতে জুম্ম তরুণরা ক্রমাগত এগিয়ে চলেছেন মুক্তির নতুন সূর্যকে সবার উর্ধ্বে তুলে ধরতে। একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানচিত্রটাকে খামচে ধরে দাপাদাপি শুরু করেছে শাসকগোষ্ঠী। অপরদিকে জুম্ম জাতিকে মুক্ত করতে জুম্ম তরুণদের চলছে প্রস্তুতি।
বিগত ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান আমল তথা অধুনা বাংলাদেশ আমলের ইতিহাস আমি গভীরভাবে মনযোগ সহকারে অধ্যয়ন করার চেষ্টা করেছি, বিশেষ করে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস আমাকে অধিক আকর্ষণ করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ও বাস্তবতা সম্পর্কে নানা জন নানা ব্যাখ্যা ও মত প্রকাশ করে আসছে এযাবত, এবং জল্পনা-কল্পনারও অন্ত নেই। শাসকগোষ্ঠী ও তার তাঁবেদার বাহিনী কাদা ছুঁড়ছে জুম্ম তরুণদের গায়ে। গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামে আজ বিশেষ করে শহর এলাকায় মদ-জুয়া, গাজা, হেরোইন, ইয়াবার আসর জমজমাট। অথচ শাসকগোষ্ঠী এসব বিষয়ে একেবারেই নির্বিকার! আমাদের আন্দোলনের প্রাণশক্তি জুম্ম তরুণ সমাজের কিছু নীতিহীন বিপদগামী অংশকে মদ-জুয়া, হেরোইন, গাজা ও ইয়াবার আসরে মাতাল করে রেখেছে এবং চাকচিক্যময় জীবনের রঙ্গ, তামাশায় মত্ত রাখার সমস্ত আয়োজন পাকাপোক্ত করে রেখেছে শাসকগোষ্ঠী। জুম্ম সমাজের কিছু নীতিহীন, আদর্শহীন যুবকের মাধ্যমে এই সমাজবিরোধী মাদক ধরিয়ে দিয়ে জুম্ম জাতির মুক্তির লড়াইয়ের স্বপ্নকে চূর্ণবিচূর্ণ করার গভীর ষড়যন্ত্রে মেঠে উঠেছে শাসকগোষ্ঠী। তারপরও জুম্ম তরুণরা কখনো মাঝপথে থামতে পারে না। মনে রাখবেন, একজন যথার্থ বিপ্লবী মায়াবাদের পূজারী না হয়ে থাকতে পারে না। একটা সুদূরপ্রসারী কল্পনাই জুম্ম তরুণদের টেনে নিয়ে যাবে মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধনে। শত বাধা, অপমান, সমালোচনা সত্ত্বেও জুম্ম তরুণরা এগিয়ে যাবে জুম্ম জাতির মুক্তির বাসনায়। জুম্ম তরুণদের মনে একদিকে পাহাড়সম স্বপ্ন ও আশা, অপরদিকে শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া বেদনা ও যন্ত্রণা। অতীতেই ফেলে আসা তিক্ততার স্মৃতিগুলো আমাদের হৃদয়ে অনবরত ছোবল মারছে। এমনতরো পরিস্থিতির ডামাডোলেও আমাদের জুম্ম তরুণদের আপসহীন ও ধীরস্থিরভাবে পথ চলতে হবে। মানুষের আবেগকে আমরা যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেবোই, কিন্তু কেবলমাত্র আবেগের তোড়ে ভেসে যাওয়ার মতো তরুণ আমরা নই।
প্রতিটি বস্তুকে ভাল-মন্দ সবদিক বিচার-বিশ্লেষণ করে ন্যায়ের পথে এবং আন্দোলনের সঠিক পথ ধরে হাঁটার দৃঢ়তার সাথে শপথ নিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি ও বাস্তবতার নিরিখে শোষণের শৃঙ্খল ভাঙবার জন্য প্রয়োজনে বিরাট শূণ্যতার মাঝে একক অবস্থান হলেও তা মেনে নিতে হবে জুম্ম তরুণদের। পাহাড়ের নৈরাজ্য ও অরাজকতার বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে সুস্থ মানুষও পাগল হয়ে যেতে পারে, এমনতরো পরিস্থিতিতেও তরুণদের সুস্থ ও সবল মন নিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করতে হবে। মনে রাখবেন, হুট করে কোনকিছুই লাভ করা যায় না এবং জুম্ম জাতির সামগ্রিক অধিকার ও মুক্তি হুট করে পাওয়া সম্ভব নয়। তার জন্য প্রয়োজন কঠোর সংগ্রাম, শ্রম, ত্যাগ, পাহাড়সম মনোবল ও ধৈর্য্যরে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে জুম্ম তরুণদের হৃদয়ের অন্তরালে। দীর্ঘ যাত্রায় আমাদের কোনো কোনো সময়ে অনশনও করতে হবে, এক বেলা খেয়ে হয়তো দু’বেলা উপবাসে-অনশনে দিনগুলো কাটাতে হবে এবং সময়ের দাবিতে অপেক্ষমান জুম্ম তরুণরা প্রচন্ড ঝড়ের মুখেই এক সময় সব কিছু পাল্টে দিতে পারবে। ভাগ্যের সাথে পাঞ্জা লড়ে হেরে যাওয়াটাতে তরুণদের মানায় না এবং দুঃসাহসিক মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে জাতির মুক্তির প্রয়োজনে তরুণদের সর্বস্ব ঢেলে দিতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি ও বাস্তবতা তরুণদেরকে স্পষ্টভাবে জানান দিয়ে যায়, শাসকগোষ্ঠী আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া সংস্কৃতি, সন্দেহ, অবিশ্বাস ও আশঙ্কা জমাট বেঁধে রেখেছে নিজের ইচ্ছানুযায়ী। ভারী বাতাসে অবশ্যই দম নিতে কষ্ট হয়, সর্বত্রই যেন বারুদের গন্ধ আর দুরভিসন্ধিমূলক আচরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে দিন দিন। জুম্ম জনগণের মনের বেদনা শুনবার জন্য মানসিকতা শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে একেবারেই হীন হয়ে যাচ্ছে। জুম্ম জাতির অবর্ণনীয় নির্যাতন, নিপীড়নের বাস্তবতা ও পাহাড়সম মনোবেদনা শুনবার মতো মানসিকতা আর কারুর নেই। এরই মধ্যে শাসকগোষ্ঠী ও জুম্ম জনগণের মধ্যেকার ফাটল ধরিয়ে দেওয়ার আবর্জনার কীট পতঙ্গের কোন অভাব নেই। সেজন্য দিন দিন শাসকগোষ্ঠীর প্রতি জুম্ম জনগণের জাতীয় জীবনে তীব্র ঘৃণা, অবিশ্বাস, দূরত্ব ও গভীর হতাশা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। যেকোন সময়ে তা প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটতে পারে! শাসকগোষ্ঠীর সাথে জুম্ম জনগণের কাছাকাছি যাওয়ার সম্ভাবনাটুকুও আমাদের চোখের সামনে নিঃশেষে মুছে যাচ্ছে। একটা বিরাট অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনায় জুম্ম জনগণকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। শাসকগোষ্ঠী এখনও জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব বিলুপ্তিকরণের নীতি প্রয়োগ করে উল্লাসে মেতে উঠছে। অনবরতই উগ্র ইসলামী ধর্মান্ধ ও উগ্র বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী এবং সম্প্রসারণবাদীর নীতির ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের পাঁজর ভেঙ্গে দেওয়ার সুগভীর ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। জুম্ম জনগণের বিলুপ্তকরণের পথ জোরদার করতে শাসকগোষ্ঠীর এগিয়ে চলার সাথী হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন নতুন আগাছার অসংখ্য কীটের জন্ম দিচ্ছে এবং কীটগুলো শাসকগোষ্ঠীর সাথে আঁতাত করে এক টেবিলে বসে জুম্ম জনগণের ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে। শাসকগোষ্ঠী চাপা উল্লাসে তার তাঁবেদার বাহিনীকে হুকুম দিচ্ছে, এবং সেনা-সমর্থিত সন্ত্রাসীরা শাসকগোষ্ঠীর খাসা রঙের তাস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা-সমর্থিত জুম্ম জাতির কুলাঙ্গার, বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতকরা জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় মেতেছে। প্রিয় মাতৃভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল ও অশান্তির কারাগারে নিক্ষেপ করছে। এসব অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে একদিন পাহাড়ের বুকে নিপীড়িত ও লাঞ্ছিত পতাকা উড়িয়ে ছাড়বেই অজেয় জুম্ম তরুণরা। কঠিন মনোভাব নিয়ে জুম্ম তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে যেতে হবে।
ভারতবর্ষের সুউচ্চ পাহাড়-পর্বত নিজের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যকে সমুন্নত রেখে স্বমহিমায় নিজ নিজ স্থানে দাঁড়িয়ে থাকবে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের ফুরোমোন, কেওক্রাডং, আলুটিলা পাহাড়গুলোরও ঠিক একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবার অধিকার রয়েছে। ৪৭-এর আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতবর্ষের একটা অংশ ছিল, তাহলে আমরা নিশ্চয়ই ভারতবর্ষ থেকে বেশি দূরে নয়। ভারতবর্ষের সকল শ্রেণির পেশার মানুষ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। লক্ষ-কোটি ভারতবর্ষের মানুষ সেই সময় হাজার হাজার মাইল পাহাড় কিংবা সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়েছে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার মহান উদ্দেশ্যকে সাথে নিয়ে। মৃত্যুর ভয়কে জয় করে নিয়ে স্বাধীনতার জন্য লড়েছে অসংখ্য ভারতীয়। সেই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তান্ডব চলেছে দুনিয়াজুড়ে। ঠিক এমন দিনেই গোটা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষ দেশে-দেশে সচকিত হয়ে উঠেছিল স্বাধীনতার সাধ উপভোগ করার জন্যে। মানুষের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার সবারই অধিকার রয়েছে। তবে, অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, অধিকার আদায় করে নিতে হয় এবং অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়। লড়তে লড়তে মৃত্যুর ভয়কে জয় করে নিয়ে মুক্তিকামী পরাধীন জাতির মানুষেরা এক সময় তাদের নিজেদের অধিকার ফিরে পাবে নিশ্চয়ই।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের ময়দানকেও সদা সর্বদাই জাগ্রত রাখতে হবে এবং আপসহীন সংগ্রামের ডাকে জুম্ম তরুণদের সাড়া দিতে হবে। নিপীড়িত জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অংশগ্রহণ করা বড় কথা নয়, লড়াইয়ের ময়দানে টিকে থাকাটাই সবচেয়ে বড় কথা। শুরুটা যেন শুরুতেই না থাকে এবং শুরুটা যেন শেষ হয়েও না যায়-এই কথাটির মর্মার্থ যেন জুম্ম তরুণরা হাড়ে-হাড়ে গভীরভাবে উপলদ্ধি করতে পারে। জুম্ম জাতিকে বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর দমনপীড়নের স্টিমরোলার থেকে মুক্ত করবার দুর্নিবার আকাক্সক্ষায় অত্যাচারীদের শত বাধা অতিক্রম করে চূড়ান্ত লক্ষ্যে জুম্ম তরুণদের পৌঁছাতে হবে। দীর্ঘ যাত্রায় জুম্ম তরুণদের ক্লান্ত হলে মানায় না এবং দূর যাত্রায় ক্লান্তিহীনভাবে পথ চলতে শিখতে হবে। একেবারে অজানা-অচেনা ও অপরিচিত পরিবেশে কপর্দকশূন্য হলেও আমাদের সংগ্রামকে জারী রাখতে হবে। বাস্তবমুখী বাস্তবতা ও আত্মমুখী প্রস্তুতির এই ধারাকে বাস্তবে প্রয়োগ করে যেকোনো পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। যুগে যুগে তরুণরা পৃথিবীর বুকে আজন্মই আশাবাদী, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্যই তরুণদের মহাযাত্রা শুরু হয়েছে। তরুণদের সামনে অনিশ্চিত ভয়ংকরতা থাকবেই, তবুও নিপীড়িত মানুষের মুক্তির এই যাত্রা থামানোর কোনো সুযোগ নেই! দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের দুর্নিবার প্রতিজ্ঞা থেকে জুম্ম তরুণদের কাউকে ফেরানো যাবে না। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত জুম্ম জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা সন্তু লারমা জেএসএস এর দশম জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বজ্রকন্ঠে বলেছিলেন, ‘জুম্ম জনগণ সংখ্যায় কম হতে পারে, কিন্তু আমরা আমাদের অধিকারের জন্য মৃত্যুকে আমরা জয় করেছি। আমরা মৃত্যুকে ভয় করি না, আমরা আমাদের অধিকারের জন্য আমরা জীবিত অবস্থায় মৃত থাকতে চাই না। আমরা চাই মানুষের মতো বেঁচে থাকতে, এবং বীরের মত মৃত্যুবরণ করতে।’ প্রিয় নেতার এই উক্তি হৃদয়ে বেঁধে নিয়ে তরুণদের এগিয়ে যেতে হবে। ত্যাগের মহিমায় মৃত্যুবরণে জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার শপথে যে অপূর্ব ঐতিহ্য রচিত হবে, সেটাই অনন্তকালে দেশে-দেশে নানান প্রান্তে নিপীড়িত মানুষের মুক্তির পক্ষে লড়াইয়ের প্রেরণা যোগাবে। মনে রাখবেন, প্রভাতের আগে দেখা দেয় অন্ধকার-জুম্ম জাতির মুক্তি হবেই, হবে একদিন!
ইতিহাসের প্রমাণ অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামের এক পর্যায়ে সেই সময়ের বাংলাদেশের সেনা প্রধানের মুখে শুনা গিয়েছিল, আমরা রণ-ক্লান্ত! তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের রণাঙ্গনে তখন শাসকগোষ্ঠীর পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছিলো। পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত জুম্ম জনগণ ও বাংলাদেশের অপরাপর প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন ব্যক্তিরাও বুঝতে পেরেছিলেন যে, শাসকগোষ্ঠীর পরাজয় কেউই রুখতে পারবে না। আজ হয়তোবা বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী উগ্র ইসলামী ধর্মান্ধ ও উগ্র বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী ও সম্প্রসারণবাদের লালসায় ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে প্রতি পদে পদে লঙ্ঘন করে চলেছে। চুক্তির পূর্বের ন্যায় আজ সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনব্যবস্থাকে সামরিক বাহিনী, সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থার হাতে তুলে দিয়েছে সরকার। শাসকগোষ্ঠীর এমন ভ্রান্ত নীতি প্রয়োগের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আবারও চুক্তি পূর্বের ন্যায় যুদ্ধের পরিবেশ তৈরি হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। পাহাড়ের চারিদিকে এমনই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির উদ্ভবের কারণে জুম্ম তরুণদের মনে ব্যাপক বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামের দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র লড়াই সংগ্রাম থেকে শাসকগোষ্ঠী যথাযথ শিক্ষা না নিলে জুম্ম তরুণরা অসংখ্য বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে অভিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকবে। পাহাড়ের রণাঙ্গনে ৭০ দশকের জুম্ম তরুণদের ন্যায় বর্তমান তরুণ প্রজন্মও শাসকগোষ্ঠীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মরণপণ লড়াইয়ে সামিল হবে। অসময়ে বর্ষা এসে আমাদের জুম্ম জাতীয় জীবনকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে তা ঠিক, কিন্তু সেই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে মুক্তির লড়াইয়ে সামিল হবে অজেয় জুম্ম তরুণ সেনানীরা। আমরা দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস ও প্রিয় অগ্রজদের সম্ভাবনাপূর্ণ যুদ্ধের প্রচেষ্টা এবং পাহাড় ডিঙিয়ে এগিয়ে চলার সাহস, মনোবল, ধৈর্য্য ও কৌশল আজও ভুলিনি। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত এই পাহাড় ডিঙিয়ে চলার বুদ্ধি-কৌশল এবং আমাদের সাহস ও পাহাড়সম মনোবল তরুণদের শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিকড় গেঁড়েছে। কাজেই শাসকগোষ্ঠীর উচিত আমাদেরকে আমাদের মতো করে থাকতে দেওয়া। আমরা কারোর ক্ষতি হোক তা কামনা করি না, আমরা মানুষের মত মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার অধিকার চাই।
আমাদের প্রিয় অগ্রজরা প্রকৃতির খাদ্য আধা-সিদ্ধ করে খেয়ে, আধপেটা খেয়েও শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে মরণপণ লড়াই চালিয়ে গেছেন। কোনো কোনো সময় না খেয়েও দিনের পর দিন উপবাসে থেকে সম্ভাবনাপূর্ণ যুদ্ধের প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন এবং বহু প্রতিকূলতার ঝাপটায় অনেক সহযোদ্ধা তছনছ হয়ে গেলেও জুম্ম জনগণের ন্যায়ের পক্ষে লড়াই সংগ্রাম থেকে এক বিন্দুও পিছপা হয়নি। অভুক্ত থাকার পরেও মুখে তার একমাত্র মন্ত্র, ‘জুম্ম জাতির সামগ্রিক মুক্তি’! বীর শহীদের রক্তে রাঙা প্রিয় পার্বত্য চট্টগ্রামের মাটি পবিত্র হয়ে রইল চিরদিনের জন্যে। যা পার্বত্য চট্টগ্রামের বীর শহীদের অপ্রতিরোধ্য লড়াই সংগ্রামের বীরত্বপূর্ণ ইতিহাসকে আমাদের জুম পাহাড়ের প্রজন্মের পর প্রজন্ম আজও ভুলতে পারেনি! বীর শহীদের রক্তের দাগ আজও শুকায়নি, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি পাহাড়-পর্বত, গিরিশৃঙ্গ, ঝিরি-ঝর্ণা ও কর্ণফুলী, কাচালং, চেঙ্গি, মাতামুহুরি নদীগুলোর বহমানতা দেখলে আমাদেরকে অতীতের লড়াইয়ের ইতিহাস মুহূর্তের মধ্যে স্মরণ করিয়ে দেয়। অতীতের লড়াইয়ের কলাকৌশল ও সম্ভাবনাপূর্ণ লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা অসম শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে পারি। ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির আন্দোলন কোনোকালেই ব্যর্থ হয়নি। এরই সূত্র ধরে বলতে চাই, পার্বত্য চট্টগ্রামের একের পর এক আত্মত্যাগের কাহিনী আমাদের মুক্তিকামী মানুষের মন থেকে মৃত্যুভয়কে মুছে দিয়ে যায়। যার প্রেক্ষাপট ধরে আবারও জুম্ম তরুণদের সমাবেশ ঘটিয়ে শুরু হবে নবজাগরণের জোয়ার। জুম্ম তরুণ সেনানীদের অংশগ্রহণে জুম্ম জনগণের জাতীয় জীবনে আশার সঞ্চার হবে এবং মুক্তিকামী মানুষের মনে বিপুল প্রেরণা সৃষ্টি করবে। এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে পরে শাসকগোষ্ঠীর ভিত নড়ে উঠবে এবং দীর্ঘ সময় এভাবে চলতে থাকলে বিপ্লবের জোয়ারে ভেসে যেতে হবে এই ভয়ে শাসকগোষ্ঠী লেশ গুটিয়ে পালানোর রাস্তা খুঁজবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
অক্ষম আমার এই লেখনী বুঝি আমাদের জুম্ম তরুণদের লড়াই সংগ্রামের সাহস ও মনোবলকে ম্লান করে ফেলে। তরুণদের এগিয়ে চলার সাহস, শক্তি ও মনোবলকে যথাযথ বর্ণনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করা আমার পক্ষে সত্যিই সম্ভব নয়। তবে একথা বলতে আমার কোন দ্বিধা নেই যে, নিপীড়িত জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলন সংগ্রামের উপর গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে জুম্ম তরুণরা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে বাল্যকাল থেকে নির্দয় ও নিষ্ঠুর সেনাশাসনের আবহাওয়ায় এবং শাসকগোষ্ঠীর ইসলামীকরণের গভীর ষড়যন্ত্র ও জুম্ম জনগণের সাথে বিরুদ্ধাচারণ দেখে দেখে পাহাড়ের তরুণরা বেড়ে উঠেছে। তবে অতীত ও বর্তমানের জুম্ম তরুণদের জাতিপ্রেম ও স্বদেশপ্রেম সম্পর্কে কলম সৈনিকের ন্যায় লিখতে আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করে তুলেছে। জুম্ম জাতির স্বাধিকার অধিকারের জন্য তরুণ প্রজন্ম জীবনের সবকিছু বিসর্জন দিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ, কারণ এর চেয়ে বড় জিনিস কিছু আর তাদের মধ্যে নেই! জুম্ম তরুণরা আমাদের বন্ধুর মতো, সাথীর মতো। তাছাড়া জুম্ম তরুণরা অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করার লোক নয় এবং জুম্ম জাতির সম্মান ও মর্যাদা কোন কিছুরই পরিবর্তে হারাতে রাজি নয়। সেজন্য লড়াইয়ের ময়দানে জুম্ম তরুণরা নিজেদেরকে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে বারবার। তরুণদের অভিন্ন ভাবনার গভীরে গিয়ে উপলদ্ধি করতে হবে যে, অন্যরা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে-এই প্রত্যাশা যেন না করি, আমাদের নিজের শক্তিবলেই জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে। অধিকার হারা জুম্ম জাতির সন্তান তরুণরা, জীবন তাদের আসলেই এক মহৎ উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত হওয়ার সম্ভাবনা। এই জীবন উৎসর্গের প্রেরণা থেকে শত দুঃখ-কষ্টকে আপন করে নিয়ে লড়াই সংগ্রামে সামিল হবে। জুম্ম জাতির মুক্তির প্রশ্নে জুম্ম তরুণরা হবে আপসহীন ও বলিয়ান, জাতিকে যোগাবে স্বপ্ন ও আশা ভরসা কিন্তু ধ্বংস ও যন্ত্রণা নয়। অনাগত দিনে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে জয়ের ইতিহাস রচনা করবে। শাসকগোষ্ঠীর নির্মম নির্যাতন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পর লড়াই জয় করে সৌভাগ্য ও গৌরবের চরম শিখরে পৌঁছাতে সক্ষম হবে-এই প্রত্যাশা কেবলমাত্র আমার একার নয়-সমগ্র জুম্ম জনগণেরই। আমরা সবাই জানি, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক তরণী ভীষণরকম তুফানের মাঝেই চলছে, কিন্তু সুদক্ষ নেতৃত্বের পরিচালনাগুণে আপদ-বিপদ থেকে বারবার রক্ষা পেয়ে আসছি বলে আমার ধারণা। শাসকগোষ্ঠীর দুরভিসন্ধিমূলক আচরণই পাহাড়ের তরুণ প্রজন্মকে দীর্ঘস্থায়ী লড়াই সংগ্রামে টিকে থাকবার প্রেরণা জোগাবে।
জুম্ম তরুণরা যে পথে চলছে, সেই পথে পরাধীনতা ও বন্ধনমুক্তির সাধনায় অকুতোভয় আত্মাহুতি, সকল প্রকার শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বিশেষতঃ শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বঞ্চিত জাতি ও মানুষেরা পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হবে-এটাই তরুণদের শেষ কথা। বিজাতীয় শাসকগোষ্ঠীর শ্যেনদৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে নিপীড়িত জুম্ম জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নতুন উদ্যমে জুম্ম তরুণরা এগিয়ে যেতে থাকবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস। পরাধীনতাকে জুম্ম তরুণরা অন্যায় বলে মনে করে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের ব্যবস্থাকেও অন্যায় বলে ধরে নিয়েছে তারা। রাজনৈতিক ও সামাজিক শোষণ ব্যবস্থাগুলিকে জুম্ম তরুণরা চরম অন্যায় বলে মনে করে আসছে এযাবতকালে। আর এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামই ছিল জুম্ম তরুণদের সংগ্রামী জীবনের মূলমন্ত্র। অত্যাচারীদের সাথে আপস নয়, শোষণের সাথে কোনো রফা নয়, পরাধীনতার বন্ধনের কোনো স্বীকৃতি নয়-এটাই হোক জুম্ম তরুণদের দৃপ্ত প্রত্যয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে শাসকগোষ্ঠীর চরম অন্যায়ের হাত থেকে মুক্তি, অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি, পরাধীনতার বন্ধনের হাত থেকে মুক্তি ও শোষণের হাত থেকে মুক্তি-এগুলোই সত্যিকার অর্থে হয়ে উঠুক জুম্ম তরুণদের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নগুলো তরুণদের সব সময় তাড়া করবে এবং রাত-দিন এক মুহূর্তের জন্যেও শান্তিতে নিদ্রা লাভ করতে দেবে না। মনে রাখবেন, জুম্ম জাতির এই মুক্তি আসতে পারে কেবলমাত্র জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়েই। নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই গড়ে নেবার সামগ্রিক অধিকার এবং সকল প্রকার সুযোগ জুম্ম জনগণের থাকতে হবে। একদিকে শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-শাসন ব্যবস্থার চাপে জুম্ম জনগণ চরম দুঃখ ও কষ্টের কবলে মৃতপ্রায় আমাদের জুম্ম জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব। অন্যদিকে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী তার শোষণযন্ত্রকে আরও দৃঢ়ভাবে জুম্ম জনগণের উপর স্থাপন করবার চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সংকটময় মুহূর্তে পাহাড়ের বুকে সমস্ত সংগ্রামী শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে শাসকগোষ্ঠীর বিলুপ্তিকরণের সুগভীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই হবে জুম্ম তরুণদের মহান দায়িত্ব ও কর্তব্য। এই মহান কর্তব্য সাধনে দৃঢ় শপথই জুম্ম তরুণরা গ্রহণ করতে এগিয়ে আসুক। মহাননেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার প্রদর্শিত চেতনায় প্রিয় জুম্ম তারুণ্যের সঞ্জীবনীতে নতুন করে রণশিঙা বেজে উঠুক। জুম্ম জনগণের সামগ্রিক মুক্তি যতদিন না হবে-লড়াই চলবে ততদিন পর্যন্ত!
লেখক: বাচ্চু চাকমা, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের প্রাক্তন সভাপতি