হিল ভয়েস, ২৭ জুলাই ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: গত ২৫ জুলাই ২০২১ বিকাল ৬:০০ ঘটিকা থেকে প্রধীর তালুকদার রেগার সঞ্চালনায় যুক্তরাজ্য প্রবাসী সদ্য প্রয়াত ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের স্মরণে ‘ড. রামেন্দু শেখর: আমা পজিমর শুকতারা’ (‘ড. রামেন্দু শেখর: আমাদের পশ্চিমাকাশের শুকতারা) শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক অনলাইন স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। স্মরণসভার শুরুতে এবং আলোচনার পূর্বে প্রয়াত ড. আর এস দেওয়ানের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
স্মরণসভার বক্তারা বলেন, ড. আর এস দেওয়ান ছিলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে একজন রাষ্ট্রদূত। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাটি জাতিসংঘ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরেন। তিনি ছিলেন নি:স্বার্থ ও দৃঢ়চেতা ব্যক্তি, একজন আপোষহীন সংগ্রামী। তিনি সাধাসিধে জীবনে অভ্যস্ত ও একজন নীরব প্রচার সৈনিক। তিনি জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলনে অনুপ্রেরণার উৎস, একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র।
প্রধীর তালুকদার রেগার সঞ্চালনায় স্মরণসভার উদ্বোধনী ও সমাপনী বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ থেকে চাকমা সার্কেল চীফ রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়। এছাড়া এতে আলোচক হিসেবে আরো অংশগ্রহণ করেন নরওয়ে থেকে রাজকুমারী চন্দ্রা রায়, বাংলাদেশ থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য গৌতম কুমার চাকমা ও ড. দেওয়ানের স্কুল জীবনের সহপাঠী ডা. সুব্রত চাকমা, কানাডা থেকে ডা. চিরঞ্জীব তালুকদার, ড. আদিত্য কুমার দেওয়ান ও প্রীতিবিন্দু চাকমা, যুক্তরাজ্য থেকে নান্টু চাকমা ও উজ্জয়িনী রায়, অস্ট্রেলিয়া থেকে কুলোত্তম চাকমা, ভারতের ত্রিপুরা থেকে কবি ও সাহিত্যিক নিরঞ্জন চাকমা, বাংলাদেশ থেকে প্রফেসর মংসানু চৌধুরী, পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম শরণার্থী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক সন্তোষিত চাকমা বকুল ও অধ্যাপক মধু মঙ্গল চাকমা প্রমুখ।
এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান, ভারতের ত্রিপুরা থেকে শান্তি বিকাশ চাকমা, কানাডা থেকে প্রীতিবিন্দু চাকমা, অস্ট্রেলিয়া থেকে এমরিপের সদস্য বিনোতাময় ধামাই, জার্মানি থেকে বাবলু চাকমাসহ অনেকেই আলোচনায় সার্বক্ষণিকভাবে যুক্ত ছিলেন। অনলাইন স্মরণসভাটি ফেসবুক পেইজ ‘রেগা কানেক্ট’ ও ‘ধুদুক আগরতলা’ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। রেগা কানেক্ট ফেসবুক পেইজে ১,২০০ ব্যক্তি দেখেছিলেন, ২৭১ জন শেয়ার করেছিলেন এবং ৪৮৪ জন লাইক দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। তবে রেগা কানেক্ট ফেসবুক পেইজটির সাথে সংযোগে সমস্যা করেছিল বলে বিভিন্ন দেশে শত শত নেটিজেন অভিযোগ করেছেন। ফলত অনেকে অনুষ্ঠানটি লাইভ দেখতে পারেননি বলে জানা যায়।
‘তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের দূত হিসেব কাজ করেন’: রাজা দেবাশীষ রায়
রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় প্রধীর তালুকদারকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবং ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের স্মৃতির প্রতি সম্মান ও নমস্কার জানিয়ে উদ্বোধনী আলোচনা শুরু করেন।
রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, একবার কি দুইবার তাঁর সাথে সামনাসামনি দেখা হয়েছে। তবে যোগাযোগ ছিল। আমাদের জুম্মদের জন্য, আদিবাসীদের জন্য তিনি কয়েকটি চিহ্ন বা স্বাক্ষর রেখে গেছেন। কিছু বিষয়ে তিনি আমাদের জন্য এক রোল মডেল। এক. আমরা জানি, জাতিসংঘে জুম্মদের পদার্পণ এবং জুম্মদের অধিকারের পক্ষে কথা বলার কাজটাপ্রথম শুরু করেন রামেন্দু বাবু (ড. আর এস দেওয়ান)। পার্বত্য চট্টগ্রামের ইস্যুটা আন্তর্জাতিক অঙ্গণে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনিই সর্বপ্রথম। এখানে আমার বড় বোন দিদি চন্দ্রা রায় আছেন, তিনি আমার চেয়ে বেশি জানেন, আশাকরি তিনি বলবেন, ১৯৮৪ সালে বা তারও আগে ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ইন্ডিজেনাস পপুলেশন-এ সর্বপ্রথম তিনি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের কথা বলেন। এর পরপরই রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথেরো, এরপর শ্রদ্ধেয় বিমল ভান্তে, এরপর তো কাজেই রাজকুমারী চন্দ্রা রায় গেছেন, অনেকেই গেছেন, জনসংহতি সমিতির সিনিয়র নেতারা গেছেন। আমিও যাই, বিনোতাময় ধামাই এখন এমরিপের সদস্য হিসেবে আছেন। সেই যে রামেন্দু বাবু প্রথমে গেছেন, এরপরই তো অন্যান্যরা যান।
তিনি বলেন, দ্বিতীয় কথাটি হচ্ছে, তিনি জেএসএস’র ইউরোপের প্রতিনিধি ছিলেন, যেটা জেএসএস’র মাননীয় সভাপতি সন্তু লারমা তাঁকে দায়িত্ব প্রদান করেন। এছাড়া তিনি কেবল জেএসএস’র প্রতিনিধি নয়, তিনি বস্তুত আমাদের জুম্মদের, পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের একজন রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করেন বলে বলা যেতে পারে।
তিনি বলেন, এই যে লর্ড এভেবুরীর কথা আমরা তুলেছি। একটা আলমিরাতে নাকি জায়গা হতো না, সপ্তাহে একটা চিঠি তিনি লর্ড এভেবুরীকে রিপোর্ট লিখে পাঠাতেন, আমার বাবা রাজা ত্রিদিব রায়সহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও কর্তৃপক্ষকে তিনি রিপোর্ট পাঠাতেন।
তিনি আরও বলেন, লর্ড এভেবুরী, যিনি ছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি মানবাধিকার কমিটির ভাইস চেয়ার। এই এভেবুরীর সাথে তিনি যোগাযোগ রাখতেন এবং এই লর্ড এভেবুরীকে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের সমস্যাটি তুলে ধরে রিপোর্ট পাঠাতেন। পরে সেই এভেবুরীই চিটাগং হিলট্র্যাক্টস ইন্টারন্যাশনাল কমিশনের কো-চেয়ার ছিলেন। যিনি আমাদের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও যেতেন। কারণ জননেত্রী শেখ হাসিনা যখন লিডার অব দি অপোজিশন ছিলেন, তিনিও লর্ড এভেবুরীর কাছে যেতেন। এই লর্ড এভেবুরী কিন্তু বাংলাদেশের মানবাধিকারের জন্য যেমনি, তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের জন্যও কাজ করেন। এই লর্ড এভেবুরীর সাথে আমাদের যে একটা বন্ধুত্ব হয়েছে, আমি মনেকরি সেটার সূত্রপাত করেন রামেন্দু শেখর দেওয়ান।
রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় আরও বলেন, আমার মনে আছে, ১৯৮০ নাকি কোনো এক সময়, রাজা ত্রিদিব রায় আর আমি, দুই পিতা-পুত্র, লর্ড এভেবুরীর কাছে দেখা করতে যাই। ব্রিস্টনের কাছে তাঁর বাড়িটি ছিল। তিনি আমাদের রামেন্দু শেখর দেওয়ানের চিঠি দেখিয়ে বলেন, এই দেখুন রামেন্দু শেখর দেওয়ানের চিঠি। তিনি (রামেন্দু বাবু) ছিলেন ইংরেজিতে যাকে বলে ‘সেল্ফলেস’ (নি:স্বার্থ), অর্থাৎ একেবারে নিজের স্বার্থের জন্য নয়, পরের স্বার্থে কাজ করা এক মানুষ।
তিনি আরও বলেন, এই লোকটির একটি পিএইচডি ডিগ্রী আছে। তিনি যদি চাকরি করতেন, তাঁর কি টাকার অভাব হতো? অথচ তিনি সেই একটি ছোট ঘরে বসবাস করতেন। আমি তার বাড়িতে যাইনি, শোনা কথা। আমার মেঝো পিসি রাজকুমারী মৈত্রী হিউম বলেন, তিনি নাকি তাঁর কাছে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁকে একটি কম্পিউটার কিনে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা নেননি। পরে নাকি একটা টাইপ রাইটার কিনে দেওয়ার জন্য রাজী করানো হয় এবং একটি টাইপ রাইটার কিনে দেওয়া হয়। সেটা দিয়েই তিনি লেখালেখি করতেন। তিনি নাকি টাকা দিলেও নিতে চান না। জোর করে দিতে হতো। ১৯৮০’তে যখন দেখা হয়, তখন তিনি বেকার ভাতা পেতেন, তা দিয়েই কোনোরকমে চলতেন। এখন তিনি প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর বই, তাঁর লেখালেখির দলিল কী কী আছে আমি জানি না। যারা যুক্তরাজ্যে আছেন, তাদের সেগুলো সংরক্ষণ করে দেওয়া উচিত আমাদের জুম্মদের জন্য।
তিনি বলেন, ১৯৮০ সালে যখন আমরা একত্রিত হই বাবার সাথে। সেখানে বাবা আমাকে কিছু টাকা দেন। সম্ভবত তাঁরা সকালে কথা বলেন। কিন্তু তখন বোধ হয় তিনি টাকাগুলো দিতে পারেননি। বাবা আমাকে বলেন, টাকাগুলো দিয়ে এসো। বাবা বলেন, তিনি নিতে চাইবেন না কিন্তু। তুমি পকেটে রেখে দিয়ে আসবে। আমি তখন ছাত্র। তবে তখন আমি রাজা হয়েছি। লন্ডনে যখন আমাদের দেখা হয়, তখন আমি তাঁকে টাকাগুলো দিতে গেলে তিনি ‘না না..’ বলে নিতে অস্বীকার করেন। আমি বললাম, ব্যক্তিগত কাজের জন্য তো নয়, আপনি জাতির জন্য কাজ করেন, সেইজন্যই বাবা এই টাকাগুলো দিয়েছেন জাতির কাজে লাগাবার জন্য। সেটা এখনও আমার মনে আছে।
রাজা দেবাশীষ রায় আরও বলেন, ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ইন্ডিজেনাস পপুলেশন এখন তো আর নেই। এখন কমিশন অন হিউম্যান রাইটসও নেই। এখন পার্মানেন্ট ফোরাম অন ইন্ডিজেনাস ইস্যুজ হয়েছে, এক্সপার্ট মেকানিজম অন দি রাইটস অফ ইন্ডিজেনাস পিপলস হয়েছে, হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু তখন তিনি ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ইন্ডিজেনাস পপুলেশন-এ আমাদের জুম্মদের জন্য কথা বলতেন। তিনি প্রফেসর ড. এথিকা ডায়াস, আমরা যাকে ইন্ডিজেনাস পিপলস এর মা, মাতামহী বলি, তিনি তখন চেয়ারপার্সন ছিলেন। তখন আমাদের রামেন্দু বাবু মাইক পেলে নাকি ছাড়তেন না। তিনি জুম্মদের কথা বলতেন। শুনেছি, চেয়ারপার্সন নাকি বলতেন, ড. দেওয়ান, দিস ইস নট এ কমপ্লেইন চেম্বার। প্লিজ, প্লিজ, মেক দ্য স্পিচ শর্ট। কিন্তু তিনি নাকি মাইক বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত জুম্মদের জন্য কথা বলা থামাতেন না।
তিনি আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরণা, চলার পথে নক্ষত্রের মতো: রাজকুমারী চন্দ্রা রায়
রাজকুমারী চন্দ্রা রায় আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, রামেন্দু বাবুর সাথে আমার প্রথম যোগাযোগ হয় যখন আমি লেখাপড়া করছিলাম, ল’ পড়ছিলাম। আমি রামেন্দু বাবুকে বলেছিলাম, একটি চিঠি লিখেছিলাম যে, রামেন্দু বাবু আমি তো আমার দেশের জন্য কাজ করতে চাই। আপনিতো আমাদের মধ্যে সবার সেরা, আপনি কী সহযোগিতা করতে পারবেন? তিনি আমাকে পরামর্শ দেন, না, এখন নয়, তুমি আগে লেখাপড়া শেষ করো। আমাদের আইনজীবী লাগবে, এরপরেই তুমি কাজে নামবে।
তিনি বলেন, রামেন্দু বাবুর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় জেনেভায়। খুব সম্ভব জাতিসংঘের একটি অধিবেশনে। সেখানে যখন যাই রামেন্দু বাবুর সাথে দেখা হয়। রামেন্দু বাবু তিন পৃষ্ঠার একটি সুন্দর বক্তব্য লেখেন। রামেন্দু বাবু সকালে এসে আমার নামটিও তালিকায় তুলে দেন বক্তব্য রাখার জন্য। প্রথমে তিনি আমাকে একটি বড় আকারের স্যান্ডুইচ এনে দেন। আমাকে বলেন, এটা খাও, কোমর শক্ত করো, তারপরে কাজে নামবে। তখনই প্রথম জাতিসংঘের অনুষ্ঠানে যাই। প্রথমবার কক্ষে প্রবেশ করে তো একটু ভয় ভয় লাগছিলো। সেখানে অনেক মানুষ। তিনি আমাকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলেন, এখানে বস, এখান থেকে নড়বে না।
চন্দ্রা রায় স্মৃতিচারণ করে বলেন, তিনি (রামেন্দু বাবু) বলেন, জাতিসংঘের সভায় যখন একবার তোমার নাম বলবে, তখন যদি তুমি কথা বলতে নাপারো, তাহলে তোমার সুযোগটা চলে যাবে। তিনি আমাকে বললেন, তুমি তো ইংরেজি জানো, গড় গড় করে পাঠ করে যেয়ো। তিনি আমার পেছনে বসেছিলেন আমার ভালোমন্দ দেখতে। কিন্তু গড় গড় করে বললেও পাঁচ মিনিটে বলা সম্ভব নয়। তাই আমি একটু সংক্ষিপ্ত করে বলি। তখন নাকি আমাদের প্রথমবার পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধিকে থামিয়ে দেয়া হয়নি। এর আগে নাকি প্রতিবার থামিয়ে দেয়া হতো। তবে রামেন্দু বাবু আমাকে দিয়ে খুব বেশি খুশি হতে পারেননি, কারণ বক্তব্যটা পুরোটা আমি পড়তে পারিনি। আপনারা তো জানেন, তাঁর লেখা এক পৃষ্ঠা যেমন ঘন, তেমন নিখুঁট। সেটাই ছিলো রামেন্দু বাবুর সাথে আমার প্রথম দেখা। তখন থেকে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা।
চন্দ্রা রায় আরও বলেন, আমার বাবার সাথে তাঁর খুব ভালো যোগাযোগ ছিলো। বাবা যখন লন্ডনে যেতেন, তখন প্রতিবার তার সাথে দেখা করতেন। তিনি সর্বদা আমাদের সকলের জন্য একজন অনুপ্রেরণা, যাকে বলে চলার পথে এক নক্ষত্রের মতো, আমাদের জাতি ও দেশের জন্য কাজের ক্ষেত্রে।
তিনি বলেন, এটা আমাদের সকলের জন্য, জাতির জন্য সৌভাগ্য যে তাঁর মত একজন বিরাট ব্যক্তিত্ব আমাদের ছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের নামটা তো তিনিই আন্তর্জাতিকভাবে তুলে আনেন। সার্ভাইভাল ইন্টারন্যাশনাল, জাতিসংঘে তিনিই তো প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামের নামটি নিয়ে যান।
তিনি আরও বলেন, রামেন্দু শেখর দেওয়ানের আরও একটি বড় কাজ হচ্ছে, সেটা হচ্ছে আপনারা তো সবাই মার্টিনেজ কোবোর জাতিসংঘে গবেষণার কথাটি জানেন। সেই গবেষণা কর্মটি ছিলো আদিবাসীদের উপর প্রথম লেখা, ৪ খন্ডে লিখিত একটি বই। সেখানেই রামেন্দু বাবু পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে লিখিত তথ্য পাঠিয়ে দেন। মার্টিনেজ কোবোর বইয়ের প্রথম খন্ডে যে পার্বত্য চট্টগ্রামের কথাটি উঠে এসেছে সেটা রামেন্দু শেখর দেওয়ানের কারণেই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
তিনি বলতেন, ঐক্যবদ্ধ থাকলে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব: নান্টু চাকমা
নান্টু চাকমা বলেন, তাঁর সাথে প্রথম দেখা হয় জার্মানির বন শহরে। আগে তাঁর সম্পর্কে শুনতাম। আমি লিভারপুলে থাকতাম। ম্যানচেষ্টার থেকে মাত্র দেড় ঘন্টার দূরত্বে। আমি/আমরা দেখা করতে যেতাম। তিনি থাকতেন ছোট্ট ঘরে। মাত্র দুটি কক্ষ। তিনি হিটারও ব্যবহার করতেন না।
নান্টু চাকমা আরও বলেন, তিনি (ড. আর এস দেওয়ান) বলতেন, আমরা জুম্মরা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকি তাহলে অবশ্যই পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। তিনি বলতেন, যতদিন বেঁচে থাকবেন জাতির জন্য কাজ করে যাবেন।
তিনি বলেন, তিনি কমই রান্না করে খেতেন। প্রায়ই ছোলা ভিজিয়ে খেতেন, ফলমূল খেতেন, দুধ খেতেন, সেভাবেই থাকতেন। আমরা মাঝেমধ্যে ভাত-তরকারি রান্না করে নিয়ে গিয়ে খাওয়াতাম।
মি: নান্টু আরও বলেন, তিনি সবসময় আমাদের মাঝে থাকবেন। এখন আমাদের চেষ্টা করতে হবে তাঁর স্বপ্ন আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার যেন প্রতিষ্ঠা করতে পারি।
তার মৃত্যুর খবর শুনে খুব খারাপ লাগে: ডা. সুব্রত চাকমা
ডা. সুব্রত চাকমা বলেন, আর এস দেওয়ান আমার স্কুল ও কলেজজীবনে সহপাঠী ছিলেন। তবে পরবর্তী জীবনে তার সাথে আর দেখা হয়নি। তিনি বলেন, তিনি সেই সময় এম এন লারমা ও সন্তু লারমাদের বাসায় থাকতেন। ছোট মহাপূরম স্কুলে পড়ার জন্য। স্কুলটি তখন ভালো স্কুল হিসেবে পরিচিত। আমরা উভয়েই প্রাথমিক মেধাবৃত্তি পাই। ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম পর্যন্ত তিনি মহাপূরম থেকে মেধাবৃত্তি পান। আমি রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পাই।
তিনি আরও বলেন, তিনি ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত ফার্স্টবয় ছিলেন। ১০ম শ্রেণিতে তিনি জেলা বৃত্তি পান। পরে আমরা চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ভর্তি হতে যাই। এরপর আমি ১৯৫৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। রামেন্দু বাবু আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। ইঞ্জিনিয়ারিং তিনি শেষ করতে পারেননি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে এমএসসি পাশ করেন। এরপর তিনি সাইন্স ল্যাবরেটরিতে জুনিয়র সাইন্টিস্ট হিসেবে যোগদান করেন। এতে কয়েক বছর চাকরি করেন। এই অবস্থায় তিনি যুক্তরাজ্যে একটি বৃত্তি পান। লন্ডনে যাওয়ার পর তার সাথে আর দেখা হয়নি। তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে আমার খুব খারাপ লাগে।
তিনি এত কাজ করে গেছেন, কোনোদিন প্রচার করেননি: ডা: চিরঞ্জীব তালুকদার
কানাডা থেকে ডা.চিরঞ্জীব তালুকদার বলেন, রামেন্দু বাবুকে আমি বিলেতে থাকতে চিনতাম ১৯৬৮ সাল থেকে। যদিও বিলেতে থাকতে আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম, তবু রামেন্দু বাবুর সাথে আমার অনেকবার দেখা হয়েছে সেখানে। রামেন্দু বাবু তাঁর জীবনটা বিসর্জন দিয়েছেন। তিনি সালফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের শিক্ষক ছিলেন। তিনি জুম্মদের সাহায্য করার জন্য এবং জুম্মদের উপর যে দমন-পীড়ন সেটার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গণে প্রচার করার জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে তার সমস্ত জীবনটা জাতির জন্য উৎসর্গ করেন।
ডা. তালুকদার আরও বলেন, লর্ড এভেবুরীর সাথে আমার বহুবার দেখা হয়। শেষবার দেখা হয় তাঁর মৃত্যুর দুই বছর আগে। তখনও তিনি রামেন্দু বাবুর রিপোর্টগুলো দেখান। রামেন্দু বাবু আমাকেও পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতি সংক্রান্ত অনেক রিপোর্ট পাঠাতেন। আমার কাছে সেই রিপোর্টগুলো এখনও আছে। আরও অনেক কাগজপত্র আমি কুলোত্তম বাবুকে দিই। তিনি অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যান। আমার কাছে যেগুলো আছে সেগুলো আমি জুম্মদের জন্য সহজে প্রাপ্তির ব্যবস্থা করবো।
তিনি বলেন, রামেন্দু বাবুর জীবনটা ছিল ‘এক্সট্রিমলি সিম্পল’। যেখানে তিনি বসবাস করেন সেটা ছিল জর্জরিত অবস্থা। রামেন্দু বাবুকে আমি বহুবছর আর্থিকভাবে সহযোগিতা করেছি। টাকা প্রদান করলে গ্রহণ করেন না। কিন্তু ডাকে পাঠালে পেতেন কিনা তা জানতাম না, তবে সেগুলো আর ফেরত আসতো না।তাঁর ছিল একটি ভাঙাচোরা টাইপ রাইটার। এত ভালো ইংরেজি লেখেন তিনি যা পড়ার মত। একেবারে পুরনো ব্রিটিশ ইংরেজি।
তিনি আরও বলেন, রামেন্দু বাবুকে যে আমরা স্মরণ করতে পারছি এজন্য আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। তিনি যে এত কাজ করে গেছেন, তিনি কোনোদিন প্রচার করেননি। তিনি চরমভাবে বিনয়ী ছিলেন।
তাঁর আগে যুক্তরাজ্যে ও ইউরোপে কেউ পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাটি তুলে ধরেননি: উজ্জয়িনী রায়
উজ্জয়িনী রায় ড. রামেন্দু বাবু বিষয়ে চমৎকার আন্তর্জাতিক সম্মেলন করার জন্য প্রধীর তালুকদার ও প্রীতিবিন্দু চাকমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তাঁকে আমরা কখনো ভুলতে পারবো না। একজন ক্যাম্পেইনার হিসেবে রামেন্দু বাবুর অবদান অনস্বীকার্য। কারণ তাঁর আগে যুক্তরাজ্যে এবং ইউরোপে কেউ এভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যাটি তুলে ধরেননি। এটা ছিল তাঁর অশেষ অবদান। তিনি যে বিভিন্ন সংগঠনে/প্রতিষ্ঠানে তথ্যবহুল রিপোর্ট পাঠাতেন সেগুলো এক পাতা, দুই পাতা নয়, ছিল তথ্যপূর্ণ প্যাকেট। সেই সময়ে (ডিজিটাল যুগের আগে) এগুলো মোটেও সহজ কাজ ছিল না। নিজে টাইপ করে, নিজের টাকায় তিনি এসব রিপোর্ট পাঠাতেন।
তিনি আরও বলেন, আমাদের রাজ পরিবারের অনেকের সাথে তাঁর খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। আমার সাথেও ভালো যোগাযোগ ছিল। তিনি ছিলেন অনন্য এক ব্যক্তিত্ব। ভদ্র, বিনয়ী। আর তিনি ছিলেন অত্যন্ত উদার প্রকৃতির মানুষও। আমি আশাকরি, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে তাঁর জন্য কিছু করতে পারবো। জুম্মদের মুক্তির ব্যাপারে তিনি খুব আশাবাদী ছিলেন। তিনি বলতেন, আগামী বছরই কিছু একটা হবে।
তিনি সবসময় পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন: ড. আদিত্য কুমার দেওয়ান
ড. আদিত্য কুমার দেওয়ান বলেন, আমার যোগাযোগ হয় ১৯৯১ বা ১৯৯২ সাল, আমার ঠিক মনে নেই। জয়তি গ্রেসআমাকে সাহায্য করতে পারে। আমি এখানে জয়তিকে দেখতে পাচ্ছি। আমরা একসঙ্গে ৩য় পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্মেলনে যোগ দিই। যেটা অনুষ্ঠিত হয় জার্মানিতে। আমি কানাডা থেকে সেখানে অংশগ্রহণ করি। সেখানে দীপঙ্কর তালুকদার ও রাশেদ খান মেননও যান। সেখানে আমরা লিখিত বক্তব্য রাখি। আরো অনেকেই অংশগ্রহণ করেন সেখানে। ভারত থেকেও অনেক প্রতিনিধি সেখানে আসেন। সেখানেই রামেন্দু বাবুর সাথে আমার প্রথম দেখা। এরপরও যখন আমি ইংলন্ডে যাই, তখন দুই/তিন বার দেখা হয় তাঁর সাথে। তাঁর বাড়িতে যাই ইন্দুদার সাথে, যখন ইন্দু দা বেঁচে ছিলেন।
তিনি বলেন, সংক্ষেপে বলি, পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনের ইতিহাসে তিনি ছিলেন গোড়াপত্তন ব্যক্তি। তিনিই হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যিনি সেই আন্দোলন শুরু করেছিলেন। যেটা রাজাবাবু ও চন্দ্রাও বলেছেন, ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ইন্ডিজেনাস পপুলেশন, যেটা এখন জাতিসংঘ স্থায়ী ফোরাম হয়েছে, সেটার সাথে যুক্ত ছিলেন রামেন্দু বাবু। তারপর এন্টি স্লেভারি সোসাইটি এবং আরো অনেক মানবাধিকার সংগঠন আছে, এ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল, ইবগিয়া, ওয়াচ গ্রুপ ফর ইন্ডিজেনাস পিপলস, সেগুলোর সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। একসময় আমরা যে সম্মেলনে যাই সেটাই ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম কমিশন, সেটা আয়োজন করেন ওলফগ্যাং মে। আমি প্রথমত বলবো যে, আন্তর্জাতিক পরিসরে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত প্রচার আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন রামেন্দু বাবু। দ্বিতীয়ত বলবো, রামেন্দু বাবুর দুটি জিনিস ছিল। একটি হচ্ছে তাঁর মিশন, আর অন্যটা হচ্ছে তাঁর ভিশন।
ড. আদিত্য কুমার আরও বলেন, তাঁর মিশনটি ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের বাইরে প্রচারাভিযান এবং তিনি সেখানে ছিলেন। তিনি সবসময় পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। আমি এটা তুলনা করছি যখন নাকি আমেরিকায় সামাজিক অধিকার আন্দোলন শুরু হয়, তখন ড. মার্টিন লুথার কিং বলতেন, আমার একটি স্বপ্ন আছে। একইভাবে ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানও স্বপ্ন দেখতেন, জুম্মদের মুক্তির স্বপ্ন।
হোচিমিনের সাথে তাঁর অনেক মিল দেখি: কুলোত্তম চাকমা
কুলোত্তম চাকমা বলেন, আমি যখন প্রথম অস্ট্রেলিয়ায় আসি ১৯৮৯ সালে, তখন তাকে আমি একটি চিঠি লিখি। তিনি তখন তাড়াতাড়ি আমার চিঠির উত্তর দেন এবং তখন থেকে তিনি সবসময় আমাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতি সংক্রান্ত চিঠি পাঠাতেন। আপনারা জানেন, এভাবে তিনি বহুজনকে চিঠি পাঠাতেন তাঁর সময় ও অর্থ ব্যয় করে। তিনি যে কত উৎসর্গীকৃত ছিলেন সেটা বলার নয়। এমন সময়ে তিনি আমাদের জন্য কাজ করেন, যখন আমাদের জন্য ছিল খুব কঠিন সময়। ১৯৭৫ হতে শুরু করে ২০১০ এই সময়ে আমাদের উপর অত্যাচার হয়। তিনি যদি আমাদের কাহিনীগুলো ডকুমেন্ট না করতেন, হয়তো সেগুলো হারিয়ে যেতো বা বিশ্ববাসীর কাছে অজ্ঞাত থেকে যেতো।
মি: চাকমা আরও বলেন, তাঁর ডকুমেন্টগুলো কোয়ালিটি অব ডকুমেন্টেশন, যা বলার মত নয়। তিনি এমনভাবে ডকুমেন্ট করেন, ভিকটিমদের বয়স থেকে শুরু করে গ্রাম, কার মেয়ে, কার ছেলে, সবগুলোই তিনি ডকুমেন্ট করে রাখতেন। আমি বলবো, তিনি যে ডকুমেন্টগুলো দিয়ে গেছেন সেগুলো আমাদের জাতীয় সম্পদ। এগুলোর দরকার আছে একারণে যে, আমরা যদি বাইরে থেকে সহানুভূতি পেতে চাই, এ ডকুমেন্টগুলো আমাদের খুব কাজ দেবে ভবিষ্যতে। যেমন ইহুদীরা যেহেতু দেখাতে পেরেছেন হিটলার তাদের মেরেছে, তাই ১৯৪৮ সালে যখন ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন করেছে তখন বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র তখন তাদের পক্ষে ছিল। যে কারণে তারা ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আমরাও হয়ত রামেন্দু বাবুর এইসব ডকুমেন্টের কারণে বহির্বিশ্ব থেকে সহানুভূতি অর্জন করতে পারবো।
তিনি বলেন, আরেকটি অবদানের কথা আমার খুব মনে পড়ে। যখন নাকি চেঙ্গি ভ্যালী প্রজেক্ট হচ্ছিল, তখন অস্ট্রেলিয়া সরকার রাঙ্গামাটি হতে খাগড়াছড়ি, দিঘীনালার দিকে একটি তিন/চার লেনের একটি মহাসড়ক নির্মাণ প্রকল্প উদ্বোধন করে। সেটা যদি হতো তাহলে আমাদের পাহাড়িদের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হতো। তিনি অস্ট্রেলিয়া সরকারকে চিঠি লিখে সেই প্রজেক্টটি বন্ধ করে দেন। বাংলাদেশ সরকারজুম্মদেরআরও অনেক জায়গা বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করতে চেয়েছিল, যেটা হলে জুম্মরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হতো, অনেকে ভূমি হারাতো, উচ্ছেদ হতো, সেটাও তিনি চিঠি লিখে বন্ধ করে দেন।
তিনি আরও বলেন, তাঁর আরও অনেক অবদান আছে। এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, সার্ভাইভাল ইন্টারন্যাশনাল, জাতিসংঘ, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তিনি বক্তৃতা দিতেন। কোরিয়ায় গিয়ে তিনি বক্তৃতা দিতেন আমাদের পক্ষে, ইত্যাদি বহু দলিল রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে যখন তিনি কথা বলতেন, তখন তাঁর কথা থামেনা। তিনি অনেককিছু বলতে চাইতেন। আমাদের তাঁর দলিলগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। তাঁর যে স্বপ্ন, সেটা যেন আমরা পরিপূর্ণ করতে পারি তার চেষ্ট চালিয়ে যেতে হবে।
কুলোত্তম চাকমা আরও বলেন, হোচিমিনের সাথে তাঁর অনেক মিল দেখি। হোচিমিনও ২৫ বছর বয়সে ভিয়েতনাম থেকে ফ্রান্সে যান। ভিয়েতনামের পক্ষে কাজ করার জন্য। আমাদের রামেন্দু বাবুও যখন আমাদের দেশ থেকে বাইরে যান তখন ১৯৬৭-৬৮ সাল তাঁর বয়স হয়তো তখন বড়জোর ৩০ বছর। এরপর ৫০ বছর ধরে তিনি আমাদের পক্ষে কাজ করে যান। তিনি আর কোনদিন দেশে ফিরেননি। হোচিমিনও দেশে ফেরেন ৩০ বছর পর। দেশে ফিরে তাঁর যে স্বপ্ন ভিয়েতনামকে মুক্ত করার, তাঁর জীবিতাবস্থায় সেই স্বপ্নের মাত্র অর্ধেক অর্থাৎ নর্থ ভিয়েতনাম উদ্ধার করেন। যখন তিনি মারা যান তখন ১৯৬৭ সাল, তাঁর মৃত্যুর ৭ বছর পরই ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনামিরা ভিয়েতনাম উদ্ধার করতে সক্ষম হন।
তিনি জ্ঞান অর্জনের জন্য পড়ার পরামর্শ দিতেন: প্রফেসর মংসানু চৌধুরী
প্রফেসর মংসানু চৌধুরী বলেন, আমি যতদূর স্মরণ করতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে তাঁকে এক/দুইবার দেখেছি। তিনি প্রায়ই আমাদের জুম্ম ছাত্রদের পড়ার জন্য পরামর্শ ও উৎসাহ দিতেন। শুধু পাশের জন্য পড়া নয়, তিনি জ্ঞান অর্জনের জন্য পড়ার পরামর্শ দিতেন।
তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে অগ্রগামী। কী পরিমাণ কমিটমেন্ট থাকলে এটা সম্ভব তা তিনিই একমাত্র উদাহরণ। তিনি জুম্মদের মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন এবং বিশ্বাস করতেন।
মংসানু চৌধুরী আরও বলেন, নির্বাসিত অবস্থায় আমৃত্যু তিনি যে জাতীয় অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন, জীবন দিয়েছেন, তাঁর জন্য আর কোথাও অনুষ্ঠান করা হয়েছে কিনা জানি না। যারা আমাদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন তাদের তালিকা আছে কিনা জানি না।
ভারতের ত্রিপুরা থেকে বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক নিরঞ্জন চাকমা ড. আর এস দেওয়ানের উপর সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ শেষে নিম্নোক্ত চাকমা কবিতাটি পাঠ করেন:
কবিতার নাম “এক আচানক রাজপুত্র”
দেঘা নেই, শুনো নেই, জানা নেই–আবাধা গরি লন্ডন ইউনিভার্সিটির কুইন এলিজাবেথ কলেজর শিঙোর ফুরি উধি এল এক আচানক রাজপুত্র রামেন্দু শেখর দেবান: সনারতুক মাধাত দি, ধল ঘরা পিদিত চড়ি, হাদত দেবা ঝিমিলানি সান এক্কান চিমচিম্যে হিরিচ হলেব দোকদোক্যে আগুন রাঙা ইক্ক্য কলম। তে এক্কুপ মারি আগাজত লিঘি দিলঅ–রানি এলিজাবেথরে। “তুই আমার হিল চাদিগাঙ দেশ্চান বেইনজেবে আ বলাজুড়ে কারি লোইয়োচ। তুমি ফিরিবার অক্তত আমারে আমা দেশ্চান হধেহৎ ফিরেই ন দি কিত্থেই সিয়েন কাজর কুলুকমন একদাঘি অভন্ড মানুজর আহদত গোজেইদি গেলে?”
ইত্তুক আহমক হোই রানি এলিজাবেথ নিগুচ নরম র মেলি কলহ, “তুমি মরে মাপ গচ্চ্য, সেই গল্লত্থান ইক্কিনে সুধুরেবার নয়। ভ-ভাক্কা নেই। সেই অক্তত আঘাত্যে এক দেবা পেরাগত রাঙামাত্যা রণখলা ছিধি গেল ইউরোপ-আমেরিকার রাজপধত। আহ আমা রাজপুত্র রামেন্দু শেখর দেবান অগমানে ধলঘড়া পিধিত্তুন লামি এল লন্ডনর রাজপধত, আহ সিত্তুন ধরি তে যুদ্ধর নাঙে কলম ইক্ক্য ধরি আহদি বেড়েল লন্ডন, ইউরোপ- আমেরিকার পধে পধে। তে তার সুগোর সংসার হেভাদি গোজেন বুদ্ধর সান জিঙহানির তিরোচ-নাল নাদিনেই চাঙমা জাদর তপ্পেত্তুন জনমান পিত্থিমীর রাজপধত নিরেল কীজেক সারি গেল – কীজেক সারি গেল- কীজেক সারি গেল জীংহানি থুম হয় সং।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্নেহ কুমার চাকমা ও আর এস দেওয়ানের ভূমিকা অগ্রগণ্য: গৌতম কুমার চাকমা
গৌতম কুমার চাকমা বলেন, ১৯৩২ সালের জানুয়ারি মাসে যে সময়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন তখন কিন্তু বিশ্বব্যাপী একটা অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল। এরপর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ হয়। এর পরপর দেশভাগ হয়। দেশভাগের পর পাকিস্তান আমলের যে নানা নির্যাতন-নিপীড়ন এসব তিনি প্রত্যক্ষ করেন। আর অপরদিকে যখন পড়াশোনা করেন তখন আমাদের প্রয়াত নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এবং বর্তমান নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার পিতা চিত্ত কিশোর চাকমা তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন, যিনি তাঁকে শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেননি, রাজনৈতিক বিষয়েও দীক্ষা দেন বলে জানা যায়, যে কারণে ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত ছিলেন। এসব কারণেই আসলে আমাদের রামেন্দু শেখর দেওয়ান লন্ডন গমন করেন। তিনি সেখানে যান মূলত জুম্ম জনগণের অধিকারের পক্ষে কাজ করার জন্য।
মি: চাকমা আরও বলেন, ১৯৭৪ সালে যখন এম এন লারমা কমনওয়েলথ সম্মেলনে লন্ডনে যান, এম এন লারমা তার সাথে দেখা করেন। এম এন লারমা তাঁকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য কাজ করতে অনুরোধ করেন। সেই অনুযায়ী তিনি কাজ করেন। তিনি ছিলেন এক সংগ্রামী সাধক। আমরা ত্রিপুরায় আরও একজন মানুষকে দেখি যাঁর নাম স্নেহ কুমার চাকমা, দেশভাগের সময় যদি তিনি ভারতে না যেতেন তাহলে পরবর্তীতে অনেক ঘটনা পার্বত্য চট্টগ্রামে হতে পারতো। পার্বত্য চট্টগ্রামের আন্দোলনে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা আসার ক্ষেত্রেও তিনি ভূমিকা রাখেন। অপরদিকে ইউরোপ জুড়ে ছিল আর এস দেওয়ানের ভূমিকা। আরও অনেকেই আছেন, অনেক সাধনা করেছেন, তবে এই দুইজনের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য।
তিনি বলেন, আর এস দেওয়ান যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করেন, আমি মনেকরি তিনি সফল। আমি মনেকরি, তাঁর সাধনায় তিনি সিদ্ধি লাভ করেছেন। পুরোপুরি না হলেও একটা পর্যায়ে গিয়ে আমরা যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করতে পেরেছি, এর পেছনে স্নেহ কুমার চাকমা ও আর এস দেওয়ানের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।
গৌতম কুমার আরও বলেন, ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ানের মৃত্যুর খবরটি আমাদের কাছে পৌঁছে নান্টু বাবুরা যখন তাঁকে দেখতে যান, তার একদিন পর। এরপর আমার নেতা সন্তু লারমার সাথে দেখা হয়, তিনিও জানান, বিষয়টি সত্য। এখন অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যাপারটি হচ্ছে-যেহেতু অন্যেরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেও বৌদ্ধধর্ম অনুসারে নিজের আত্মীয়-স্বজনদেরও করতে হয়, সেজন্য তাঁর যে আত্মীয়-স্বজন আছেন তারা ইতোমধ্যে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেছেন।
তিনি বলেন, এই স্মরণসভা করার পেছনের কারণ হচ্ছে, এই যে তিনি জীবনটা উৎসর্গ করলেন, এই যে তিনি সাধনা করে গেছেন, এখান থেকে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম যাতে তাঁকে স্মরণ করতে পারে এবং সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের আন্দোলনে যাতে তারা উজ্জীবিত হতে পারে। তাঁর দলিলগুলো নিয়ে আর্কাইভ করা যায়, যেটা রাজাবাবুও তুলে ধরেছেন। আরেকটি হচ্ছে, তাঁর একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করা যায় কিনা। বাংলা-ইংরেজি উভয় ভাষার লেখা নিয়ে যদি স্মারকগ্রন্থ বের করা যায় তাহলে বোধ হয় ভালো হয়। তিনি বলেন, আর শুধু রামেন্দু শেখর দেওয়ান বলে নয়, অন্যান্য যাঁরাই অবদান রেখেছেন তাঁদের স্মৃতিগুলি ধরে রাখার জন্য তথ্যগুলো সংরক্ষণ করা যায় কিনা তার উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম যুগ যুগ ধরে স্মরণ করতে পারে। সেইজন্য লাইব্রেরি, জাদুঘর ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা যায়। তিনি বলেন, তবে আমি বলতে পারি, আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে এটা করার মত পরিস্থিতি নেই।
গৌতম কুমার চাকমা বলেন, এই যে রামেন্দু শেখর দেওয়ান মারা গেলেন, তিনি জনসংহতি সমিতির স্পোকসম্যান হিসেবে ইউরোপে কাজ করেন। সতরাং সে হিসেবে জনসংহতি সমিতির একটি দায়িত্ব বর্তায় তাঁর স্মরণে কোনো অনুষ্ঠান করার, তাঁর উদ্দেশ্যে স্মরণ সভা করার। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে এমন একটা পরিস্থিতি বিরাজ করছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির শুধু কেন্দ্রীয় কার্যালয় নয়, জেলা পর্যায়ের কার্যালয়, ইউনিয়ন পর্যায়ের কার্যালয় ইত্যাদি সব বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ প্রত্যেকের পেছনে একের পর এক মামলা। মামলার কারণে সবাই এখন ফেরারি। যে কারণে জনসংহতি সমিতি কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করলেও বিপদ হওয়ার পরিস্থিতি এখনও কেটে যায়নি। কিছুদিন আগেও জনসংহতি সমিতির সভাপতির সাথে দেখা হয়। তিনি কোনো অনুষ্ঠান করার বিষয়ে বলেন, এখন তো পরিস্থিতি খুব প্রতিকূল। আমিও অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে বলতে চাই, পরিস্থিতি খুব খারাপ। এবিষয়ে যদি কোনো ত্রুটিও হয়ে থাকে আমি সবার কাছে অনুরোধ জানাবো, যাতে তারা বিষয়টি বিবেচনায় রাখে। তিনি বলেন, আদিত্য বাবু (ড. আদিত্য কুমার দেওয়ান) কমিটি গঠনের কথা বলেছেন, সেটা ভালো প্রস্তাব। আজকে হয়ত সেটা সম্ভব নয়। তবে প্রধীর বাবু, প্রীতিবিন্দু বাবু ও কুলোত্তম বাবুকে এব্যাপারে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।
গৌতম কুমার চাকমা আরও বলেন, রামেন্দু শেখর দেওয়ানের যে সাধনা সেটা যেন বরবাদ হয়ে না যায়। এখানে ইহুদীদের কথা এসেছে। লিও টলস্টয় একটি কথা বলেছেন, সময় আর ধৈর্য্য হচ্ছে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। সময় না হলে যেমন মায়ের পেট থেকে সন্তান বের হয় না, তেমনি আন্দোলন-সংগ্রামও সফল হয় না। ১৯৯৭ সালে যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হয়েছে এটা একটা সফলতা। এটার বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদেরকে আন্দোলন-সংগ্রামে এগিয়ে যেতে হবে। ভূমি কমিশন আইন হয়েছে ২০০১ সালে, যেটা সংশোধন হতে সময় লেগেছে ১৫ বছর, ২০১৬ সালে। রামেন্দু শেখর দেওয়ানের কাছ থেকে শেখার রয়েছে। তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, সাহসী ছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রামে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি একজন খাঁটি জুম্ম জাতীয়তাবাদী ছিলেন।
এমন মানুষের কথা কেবল রূপকথায় শোনা যায়: সমাপনী বক্তব্যে রাজা দেবাশীষ রায়
সমাপনী বক্তব্যে রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় আরও বলেন, ড. রামেন্দু শেখর দেওয়ান এমন একজন মানুষ যে ধরনের মানুষের কথা কেবল রূপকথায় শোনা যায়। সেই মানুষটির সকল তথ্য যেন আমরা সংরক্ষণ করতে পারি, যাতে নতুন প্রজন্ম, ভবিষ্যত প্রজন্ম জানতে পারে, যাতে জাতির ভালোর জন্য, সমাজের ভালোর জন্য কাজ করতে পারে। তিনি এমন একজন মানুষের স্মরণে এই স্মরণ সভার উদ্যোগ গ্রহণের জন্য প্রধীর তালুকদার ও প্রীতিবিন্দু চাকমাকে কৃতজ্ঞতা জানান।