জ্যোতিপ্রভা লারমা
ডক্টর রামেন্দু শেখর দেওয়ান আমার আপন ছোট মামা হন। ছোট বেলায় তাঁর সান্নিধ্যে থেকে তাঁকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তিনি আমার চেয়ে কয়েক বছর বয়সে বড় ছিলেন। আজকে তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে কিছু কথা বলবো-
ডক্টর রামেন্দু শেখর দেওয়ান ১৯৪৫ সাল হতে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে থেকে মাওরুম জুনিয়র হাই স্কুলে ৪র্থ, ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেছেন। ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে মেধাবৃত্তি পেয়ে প্রতিমাসে ৬ টাকা পেতেন।
তিনি আমার বাবার অত্যন্ত প্রিয় ছাত্র ছিলেন। বাবা তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি শান্ত-শিষ্ট, নম্র-ভদ্র ও ধীর স্থির স্বভাবের ছিলেন এবং প্রচুর পড়াশুনা করতেন। পড়াশুনার প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ দেখে আমার বাবা তাঁকে আমাদের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি আমার মাকে গৃহস্থালীর কাজে সাহায্য করতেন এবং বাড়িতে অতিথি আসলে আপ্যায়নে সহযোগিতা করতেন। গ্রামের প্রতিবেশীদের সাথে ভালো ব্যবহার করতেন, ফলে প্রতিবেশীরাও তাঁকে খুব ভালোবাসতেন।
আমার বাবার অনুপস্থিতিতে তিনি আমাদের পড়াশুনায় সুদৃষ্টি দিতেন। মামা ডক্টর রামেন্দু শেখর দেওয়ান সবসময় পড়াশুনা ও কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন। পোশাক-পরিচ্ছদে অত্যন্ত সাদা-সিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। বাল্যকাল থেকে মানবদরদী ছিলেন। তাই গরীব-দু:খী মানুষের প্রতি সহানুভূতি ছিলেন এবং তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতেন। তিনি আমার পিতা-মাতার চিন্তা ও চেতনার অনুসারী ছিলেন।
আমার বাবা মাওরুম স্কুলে পড়ার সময় তাঁর নাম রেখেছিল- রক্তোৎপল দেওয়ান। পরে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তির সময় নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় রামেন্দু শেখর দেওয়ান। সেখান থেকে ১৯৫২ সালে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে মেট্রিক পাশ করেন এবং জেলাবৃত্তি অর্জন করে মাসে ৩০ টাকা হিসেবে পেতেন। তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে ১৯৫৫ সালে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাশ করেন।
তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতেন সে সময়ে আমি পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পে এক বছর তেজগাঁও এলাকায় ট্রেনিং-এ অংশগ্রহণের জন্য ঢাকা যাই। তখন আমি মাঝেমাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সাথে দেখা করতে হলে যেতাম। তখন হলে তিনি ও শরবিন্দু শেখর চাকমা এক সাথে থাকতেন। হলে থাকার সময় তাঁকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নও গোছালো জীবন-যাপন করতে দেখেছি।
লেখাপড়ার জন্য বিদেশে যাওয়ার আগে তাঁর সাথে আমার বড়মামার বাড়ি রাঙ্গামাটিতে শেষ দেখা ও কথা হয়েছিল। তিনি আমাকে বলেছিলেন- ভালো থেকো, যোগাযোগ রেখো। আমি যে উদ্দেশ্যে বিদেশে যাচ্ছি, সে কাজে যেন সফল হয়ে ফিরতে পারি প্রার্থনা করো। সে সময়ে তিনি আমার মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানান। লন্ডনে যাবার পরও দু’একটি চিঠি আদান-প্রদান হয়েছিল। তিনি তাঁর শেষ চিঠিতে- বাঁশ কোঁড়ল খাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েছিলেন।
যতদূর জানি তিনি পার্বত্য অঞ্চলকে খুবই ভালবাসতেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের পশ্চাৎপদ ও বঞ্চিত জুম্ম জনগণের স্বাধীকারের কথা ভাবতেন। তাই তিনি তাদের জন্য আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন। তাঁর উদ্দেশ্য পূরণে জুম্ম যুবসমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আন্তর্জাতিক মুখপাত্র ডক্টর রামেন্দু শেখর দেওয়ানের মৃত্যুতে জনসংহতি সমিতি কর্তৃক ভার্চুয়াল মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন উপলক্ষ্যে আয়োজিত স্মরণসভায় স্মৃতিচারণমূলক এই লেখাটি উপস্থাপন করি।
লেখক: জ্যেতিপ্রভা লারমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির সাবেক সভাপতি