বাচ্চু চাকমা
যুগ যুগ ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের সহজ-সরল জুম্ম জনগণ প্রতিটি শাসকগোষ্ঠীর গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার। সাম্প্রতিক ঘটনাবলী বিশ্লেষণে, সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক ও অনলাইন ভিডিওতে তথ্য সন্ত্রাস, জুম্ম জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ও তাঁর দল জনসংহতি সমিতিকে উদ্দেশ্য করে শাসকশ্রেণির মনগড়া মিথ্যাচারের কোন শেষ নেই। সাম্প্রতিক সময়ে ‘ফেস দ্যা পিপলস অনলাইন’ আলোচনায় অংশগ্রহণকারী পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের ধর্মান্তরকরণে অন্যতম হোতা ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর এজেন্ট ডাঃ ইউসুফ আলী, বহিরাগত ও চরম সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কাজী মজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের সাবেক মহিলা সংসদ সদস্য ও অন্যান্য আলোচকদের মনগড়া ও ভিত্তিহীন বক্তব্যেও তাই পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্বকে চিরতরে বিলুপ্তিকরণের শাসকগোষ্ঠীর বহুমুখী ষড়যন্ত্রের তৎপরতাকে উন্মোচিত করার প্রয়াসে এবং সেই বাস্তব সত্যটাকে জানানোর উদ্দেশ্যে এই লেখাটি হাজির করতে বাধ্য হলাম। সেই সাথে শাসকগোষ্ঠীর লেলিয়ে দেয়া লাঠিয়াল বাহিনী, যৌথ ডাকাত বাহিনী একের পর এক সাঁড়াশি অভিযানের নামে, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের নামে, সন্ত্রাসী দমনের নামে সাধারণ জুম্ম জনগণের উপর একচেটিয়া ধরপাকড়, জেল-জুলুম, নির্যাতন-নিপীড়ন, রাতে-বিরাতে সাধারণ জুমিয়াদের ঘরবাড়ি তল্লাশি ও ঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তছনছ করে মৃত্যুর হুমকি প্রদানের মধ্য দিয়ে গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে।
এমনতরো পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় পার্বত্য চট্টগ্রামে বাক স্বাধীনতা, সভা-সমিতির স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। কাদের অঙ্গুলি হেলনে পার্বত্যাঞ্চলের এই অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি ও বাস্তবতা তৈরি হয়েছে? যার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ অসহায় জুমচাষী পর্যন্ত রীতিমতো নিজের বাড়িতে স্বাভাবিকভাবে ঘুমাতে পারে না। অথচ বারে বারে এসবের দোষ চাপানোর চেষ্টা করা হচ্ছে জুম্ম জনগণের প্রিয়নেতা সন্তু লারমার উপর এবং তাঁর দল জনসংহতি সমিতিকে ইঙ্গিত করে সমস্ত মিথ্যাচার করা হচ্ছে। সন্তু লারমার বিরুদ্ধে আলোচনার টেবিলে, সামাজিক মাধ্যম ফেইসবুক, অনলাইন ভিডিও কিংবা পত্রিকায় এবং টিভির টকশোতে সাম্প্রদায়িক ঢোল বাজাতে বাজাতে বারতা বাজান। কখনও একনায়কতান্ত্রিক, কখনো বা স্বৈরাচারী লেবাস জোরপূর্বক চাপিয়ে দিয়ে নিজেরাই প্রশান্তি লাভ করেন। বাংলাদেশে এধরনের অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া রাজনীতির অপসংস্কৃতি চর্চা আর কতদিন চলবে? যার ফাঁদে পড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের অসহায় নিরন্ন খেটে-খাওয়া জুম্ম জনগণই বলির পাঁঠা হয়ে দাবা গুটির ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। এসবের সমাধান কোথায়? খুঁজতে হবে শাসকগোষ্ঠীর অন্তরালে!
উল্লেখ্য যে, গত ২৩ জুন ২০২১, ‘ফেস দ্যা পিপলস অনলাইন’ ভিডিও আলোচনায় ডাঃ ইউসুফ আলী ও কাজী মজিবুর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রামের একমাত্র কান্ডারী সংগঠন জনসংহতি সমিতি এবং সমিতির সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান মহোদয়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বক্তব্য দিয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি ও বাস্তবতাকে অস্থিতিশীল ও ঘোলাটে করার লক্ষ্যে ডাঃ ইউসুফ আলী ও কাজী মজিবুর রহমানের মতো এই নোংরা কীটদের মনগড়া, মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভিত্তিহীন অপপ্রচার কেবলমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামে নয়, পুরো দেশের অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিমনা ব্যক্তি ও সংগঠনের দৃষ্টিগোচর হয়েছে বলে আমার পরিষ্কার ধারণা। এহেন পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় আমরা কখনো নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারি না। তাই শাসকগোষ্ঠীর পোষ্যপুত্র, দালাল ও পাহাড়ের পরিবেশ-পরিস্থিতি ধ্বংসকারী নোংরা কীটদের তথ্য সন্ত্রাস ও গোয়েবলসীয় প্রোপাগাণ্ডার বিরুদ্ধে লড়াই করা-সকল প্রকার অন্যায় ও অপপ্রচারকে ঘৃণা করার জন্য এবং সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে লড়াই জাগ্রত রাখতে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস। বিগত সময়ে সময় সংবাদে, পার্বত্যনিউজ.কম সংবাদে ও নানা টিভি চ্যানেলে পার্বত্য চট্টগ্রামে দায়িত্বরত সাবেক ও দায়িত্বকালীন কিছু সেনা কর্মকর্তা প্রিয়নেতা সন্তু লারমাকে একনায়কতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী লেবাস দিয়ে জনবিচ্ছিন্ন নেতা বলে মিথ্যার বেসাতি করেন। সন্তু লারমার প্রতি জুম্ম জনগণের আস্থা, বিশ্বাস ও আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার উপর সন্দেহের বিষ ঢালানোর ব্যর্থ অপচেষ্টা চালানো হয়েছে বারবার। অতঃপর এই মিথ্যাচারীরা অনেকেই ব্যর্থ হয়ে নিজের পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে নিজের পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে।
আমার জানামতে, সন্তু লারমাকে কোনোদিন এধরণের আচরণ করতে দেখা যায়নি। সব সময় জনগণের একজন সত্যিকার নেতা হিসেবে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন তিনি। জীবনে কখনও কোনোদিন শাসকগোষ্ঠীর কাছে হার মানেননি এবং নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও নিজের জীবনের সকল মায়া ত্যাগ করে জুম্ম জনগণের সামগ্রিক স্বার্থে এখনও নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন। শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত করেননি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর সন্তু লারমাকে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদানের প্রস্তাব করেছিল সরকার। কিন্তু সেই মন্ত্রীত্বকে আন্তরিকতার সহিত প্রত্যাখান করে জুম্ম জনগণের সামগ্রিক স্বার্থকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে দীর্ঘ বছরের পর বছর ধরে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান এর দায়িত্ব পালন করে চলেছেন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের অধিকারের কথা তুলে ধরে চলেছেন। কিন্তু সেখানেও সন্তু লারমাকে চক্রান্তকারীরা শান্তিতে থাকতে দেবে না, কুৎসা রটনা করে চলেছে প্রতিনিয়ত এবং আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন হয় না কেন এমনই অযৌক্তিক প্রশ্ন ভরিভরি? নির্বাচনের কথা উঠলে সংবিধান পরিপন্থী নানা শর্ত জুড়ে দিয়ে নির্বাচনে বাঁধা সৃষ্টির অভিযোগ তোলা হয় যা সম্পূর্ণভাবে ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত বলে সহজে অনুমান করা যায়। সন্তু লারমা আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান পদে একচ্ছত্র ক্ষমতায় বসে রয়েছেন, চেয়ারম্যান এর পদ নাকি ছাড়তে চান না, সন্তু লারমার মহোদয়ের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নন, পাসপোর্ট ছাড়া তিনি বিদেশে ভ্রমণ করেন, তিনি বাংলাদেশের জাতীয় প্রোগ্রামগুলোতে অংশগ্রহণ করেন না- এমনই ভিত্তিহীন ও মনগড়া অপপ্রচারের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করার চেষ্টা করে চলেছেন স্বার্থান্বেষী মহল! প্রিয়নেতা সন্তু লারমাকে নিয়ে যারা কুৎসা রটনা করেন এবং এসব বলে নিজের পকেট ভারী করেন, দালালী ও শাসকগোষ্ঠীর লেজুড়বৃত্তি করে চলেছেন, জুম্ম জাতির কাছে তারা সবসময় শয়তান হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকেন। জুম্ম জাতির এই সংকটের জন্য শাসকশ্রেণিকে একদিন নয় একদিন খেসারত গুণতে হবে।
সন্তু লারমা ও তাঁর দল জনসংহতি সমিতি এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে নিয়ে যে মিথ্যাচার; পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান এর পদটাকে দখল করে আছেন বলে যে মিথ্যাচার তা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছাড়া অন্য কিছুই নয়। সন্তু লারমা ভারতের পাসপোর্ট নিয়ে চলাচল করেন বলে এমনটাই অভিযোগ করা হয়েছে অনলাইন ভিডিও বার্তায়। সন্তু লারমা আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান পদে থেকে ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে তিনি মজে আছেন বলে মনগড়া মন্তব্য করা হয়েছে আলোচনায়। তিন পার্বত্য জেলায় তিন জন এমপি পাহাড়ি, তিন জেলা পরিষদের তিন জন চেয়ারম্যান পাহাড়ি, আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান পাহাড়ি, উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পাহাড়ি, পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী একজন পাহাড়ি ইত্যাদি চুক্তির সাথে সাংঘর্ষিক বক্তব্যের আলোকে বহিরাগত সেটেলার বাঙালি, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও সংগঠনগুলোকে উস্কে দিয়ে এতোদিন নিজের স্বার্থকে চরিতার্থ করে এসেছিলেন। বাঙালিদের এখানে অংশগ্রহণ নেই বলে চিল্লাচিল্লি করেন! বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীকে গুলি করে হত্যা করার অভিযোগ এনে উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে জনসংহতি সমিতিকে দোষারোপ করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের সময় জনসংহতি সমিতি নাকি অকেজো অস্ত্রগুলো জমা দিয়েছে এবং আসল অত্যাধুনিক অস্ত্রগুলো জমা দেওয়া হয়নি- তাদের এই আলোচনাগুলো রূপকথার গল্পের কাহিনীর মতোই শুনা যায়। জনসংহতি সমিতির বর্তমান অত্যাধুনিক অস্ত্রগুলো চায়না এবং ইউএসএ হতে সংগ্রহ করা হয়েছে বলেও আলোচনাতে মিথ্যার বেসাতি করা হয়। অথচ ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পর জনসংহতি সমিতি সমস্ত অস্ত্র জমা দিয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশে চলে এসেছিল। তারপরও জনসংহতি সমিতি ও সন্তু লারমার অবৈধ অস্ত্র রয়েছে বলে ভিত্তিহীন গোয়েবলসীয় প্রোপাগাণ্ডা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বার বার।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে অনেকগুলো সেনাক্যাম্প গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে ডাহা মিথ্যে কথাও বলা হয়েছে। সরকারের মতে, প্রায় ৫০০ শতাধিক অস্থায়ী সেনাক্যাম্প হতে ২৪০টি ইতিমধ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু জনসংহতি সমিতির মতে, তিন দফায় মাত্র ১০০টি অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছিল। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে এখনো ৪০০-এর অধিক অস্থায়ী সেনাক্যাম্প রয়েছে। অধিকন্তু ক্যাম্প প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া ২০০৯ সাল থেকে সরাসরি বন্ধ রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা তো দূরের কথা, বরঞ্চ দিন দিন নতুন নতুন সেনাক্যাম্প নির্মাণ ও সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক মজিবুর রহমান আরও উল্লেখ করেন, চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা হয়েছে, ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং ৯টি ধারা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়াও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় ৩০টি, খাগড়াছড়ি জেলায় ৩০টি এবং বান্দরবান জেলায় ২৮ টি সরকারি বিভাগ হস্তান্তর করা হয়েছে বলে চুক্তি বাস্তবায়নের পক্ষে শাসকগোষ্ঠীর ওকালতি করে কেবলমাত্র গাণিতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উপরোক্ত বিষয়গুলো বাধা কিনা প্রশ্ন করা হলে প্রিয়নেতা সন্তু লারমার উপর সকল দোষ চাপিয়ে দিয়ে আসল কথাটি পাশ কাটিয়ে সরাসরি মিথ্যার আশ্রয় নেন। পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠন, আঞ্চলিক পরিষদ গঠন, পার্বত্য মন্ত্রণালয় গঠন- এভাবে চুক্তির ধারাগুলো উল্লেখ করে চুক্তি বাস্তবায়নের ফিরিস্তি শুনান! মজিবুর রহমান আরও অভিযোগ করে বলেন যে, সন্তু লারমা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে না এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালিদের চলে যেতে হবে-সন্তু লারমার বিরুদ্ধে এমন মিথ্যা অভিযোগ ভুরি ভুরি। অথচ মুক্তিকামী আদিবাসী মানুষের অন্যতম জনপ্রিয় একজন নেতা, শোষিত-বঞ্চিত জুম্ম জনগণের মুক্তির সংগ্রামের অন্যতম জ্বলন্ত প্রতীক সন্তু লারমা। আশ্চর্য উদ্দাম-বেগে সংগ্রামের প্রত্যেক আকাশে, সূর্যদীপ্ত রক্তের তরঙ্গের ন্যায় ভেসে আসে পার্বত্য চট্টগ্রামের এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্তে, যেখানে মুক্তির লড়াই সেখানেই আমাদের এই প্রিয়নেতা সন্তু লারমা। আমরা প্রত্যক্ষ করেছি, তাঁর মধ্যে নির্ভীক মন, লৌহদৃঢ় সংকল্প যা সমস্ত বাধাবিপত্তি লঙ্ঘনে অকুতোভয়, দাসত্ব ও নির্যাতনের প্রতি সুতীব্র ঘৃণা- যা নিপীড়িত জুম্ম জনগণের সৃজনীশক্তির উপর অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে এবং বিশাল সাংগঠনিক প্রতিভা, এসবই প্রিয়নেতা সন্তু লারমার মধ্যে অসাধারণ মূর্তভাবে প্রকাশ পেয়েছে, যা নিপীড়িত মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা হিসেবে গোটা বিশ্বের গরীব, মেহনতি মানুষের কাছে সমাদৃত এবং প্রশংসিত।
পৃথিবীর ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি যে, বুদ্ধের সময় যেমনি ছিলেন দেবদত্ত, রাম-লক্ষণের সময় রাবনও, মহাভারতের কাহিনীতে শ্রীকৃষ্ণ গোবিন্দের বিপরীতে ছিলেন মামা শকুনি, পলাশীর যুদ্ধের সময় সিরাজুদ্দৌলা পতনের অন্যতম কারিগর কাপুরুষ মীর জাফর-এভাবে ইতিহাসের যুগের সন্ধিক্ষণে ভাল মানুষের পাশাপাশি খারাপ মানুষেরও জন্ম হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আদায়ের আন্দোলনেও তার জ্বলন্ত প্রমাণ হলো বিভেদপন্থী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রদের আবির্ভাব। লক্ষণীয়ভাবে দেখা গেছে যে, গত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ইন্ডিয়ার নর্থ ইস্ট নাও অনলাইন পত্রিকায় “Bangladesh: Push for Chittagong Hill Tracks Accord” শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে- যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিপীড়িত জুম্ম জনগণের একমাত্র কান্ডারী সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমাকে উদ্দেশ্য করে তা অপপ্রচার করা হয়েছিল। এরপরের কাহিনী শুরু হয়েছিল শাসকগোষ্ঠীর মিথ্যাচার! প্রিয়নেতা সন্তু লারমাকে নিয়ে পার্বত্যনিউজ.কম ও PROTHOMBANGLADESH.NET সহ আরও অনেক ভূয়া সংবাদপত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম প্রিয়নেতার বিরুদ্ধে মিথ্যার বেসাতি করার কোন শেষ ছিল না। আমার জানামতে, সন্তু লারমা মূলত বিদেশে বিশেষত ভারতে যান চিকিৎসার জন্য। ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ উক্ত সংবাদ এর বিষয়ে জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগ কর্তৃক প্রচারিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও তা বলা হয়েছে, “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার মাতৃ-পিতৃ তর্পণ ও ধর্মীয় আচারাদি সম্পাদন উপলক্ষে ভারত গমন..” করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ পত্রিকায় শিরোনাম করা হলো “চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়নে হস্তক্ষেপ কামনা করতে ভারতে গেলেন সন্তু লারমা”। বিষয়টিতে আরও মিথ্যার নানান রঙ মিশিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড়সড় করে অপপ্রচার করা যেমনি লজ্জাজনক তেমনি হাস্যকরও বটে!
স্বৈরাচারী ও একনায়কতন্ত্রীর লেবাস দিয়ে সন্তু লারমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করে, গণতন্ত্রের পোশাক পড়িয়ে যারা সরকারের ঢোল বাজিয়ে নিজেদের ভাল মানুষ সেজে টিভির পর্দায় হাজির হন এবং বানোয়াট ও মনগড়া প্রোপাগাণ্ডার ঝড় তুলেন- আপনাদের উদ্দেশ্যে বলি, বাংলা অভিধানে ‘স্বৈরাচার’ শব্দের অর্থ কি তা একটু ভাল করে পড়বেন। ‘নিজের ইচ্ছানুযায়ী আচরণ’ করাকে তো স্বৈরাচার বলা হয়। তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে কারা নিজের ইচ্ছানুযায়ী আচার-আচরণ করছে, কারা রাতকে দিন, দিনকে রাত বা সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে শাসন-শোষণ করে চলেছেন? মনে রাখবেন, সন্তু লারমার নিজস্ব দল আছে, তাঁর দলের তৃণমূল পর্যায়ে কর্মী হতে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের যথোপযুক্ত ও বাস্তব সম্মত মতামত নিয়ে তিনি আন্দোলন পরিচালনা করে চলেছেন। জুম্ম জনগণের অধিকারের প্রশ্নে তিনি একমুহূর্তেও শাসকগোষ্ঠীর কাছে আপোষ করেননি এবং শাসকগোষ্ঠীর সকল প্রকার অন্যায়, অত্যাচারের ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে নিজের আখের গোছাননি। সন্তু লারমা কখনও স্বৈরাচারী নন, গোটা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ তথা সারা বাংলাদেশের আদিবাসীদের তিনি প্রাণপ্রিয় নেতা এবং একই সাথে সারা বাংলাদেশের নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত জাতি ও মানুষের মুক্তির জন্য এখনও আপোষহীনভাবে লড়াই করে চলেছেন। বাংলাদেশের খেতে খাওয়া, গরীব, মেহনতি মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কতিপয় গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিমনা ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিও একজন অন্যতম। সন্তু লারমার বিরুদ্ধে এহেন মিথ্যাচার পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে দিন দিন অস্থিতিশীল ও সংঘাতময়তার দিকে ঠেলে দেওয়ার ইঙ্গিত ছাড়া আর কিছুই নয়।
একনায়কতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী ও স্বার্থপর মনোভাব পোষণকারী কারা? পৃথিবীতে বহুকাল আগে স্বৈরাচারী রাজারা রাজ্য শাসন করতেন নিজের ইচ্ছানুযায়ী। জার্মানিতে হিটলারের স্বৈরাচারী শাসন, ইতালিতে মুসৌলীনী আর স্বয়ং বাংলাদেশের স্বৈরাচারী এরশাদের শাসন আপনাদের নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা। তাহলে আপনাদের স্বৈরাচারকে বুঝতে হবে গণতান্ত্রিক বিধি-বিধান, আচার-আচরণ ও মূল্যবোধের বিপরীতে। এখন যদি প্রশ্ন করি বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রকে কি স্বৈরতন্ত্র বলা হয়? তার উত্তর খুঁজে পেতে হলে আমাদেরকে দেখতে হবে এখানে কি গণতান্ত্রিক বিধিবিধান, আচার-আচরণ ঠিকমত পরিচালিত হচ্ছে কিনা? তাহলে স্বৈরতন্ত্রকে বুঝতে হবে তার যাবতীয় রাজনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে। আগেই বলেছি যে, স্বৈরাচার শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো ‘শাসক তার নিজের ইচ্ছানুযায়ী দেশ শাসন করেন, দেশের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী নয়’। উদাহরণ স্বরূপ বলতে পারি, সংবিধানকে পরিবর্তন করে স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান, স্বৈরশাসক হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ স্বৈরশাসন চালিয়েছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে তথ্য সন্ত্রাস-এর পেছনে সরাসরি রাষ্ট্রীয় মদদ রয়েছে এবং ডাঃ ইউসুফ আলী ও কাজী মজিবুর রহমানদের মিথ্যাচারের সাথে শাসকগোষ্ঠী ওতোপ্রোতভাবে জড়িত বলে প্রতীয়মান।
উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে লিখতে হলে বাংলাদেশের জাতীয় পরিস্থিতির কথাও কিছুটা উল্লেখ করতে হয়। আমরা লক্ষ্য করেছি যে, ২০১৭ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দেওয়ার পর প্রধান বিচারপতি অপসারণের ঘটনা ঘটেছিল তা আমাদের স্পষ্ট করে জানা আছে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটা কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে লিখিত থাকবে। যার কারণে বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নীতিতে বিচারিক কাজ চালু করতে চাওয়াতে এসকে সিনহাকে প্রধান বিচারপতির পদ থেকে জোরপূর্বক অপসারণ করা হয়েছিল। বিচারপতি এসকে সিনহাকে শুধুমাত্র অপসারণ করে ক্ষান্ত হননি, নিজের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ত্যাগ করে ভিনদেশের মাটিতে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। তাহলে শাসকগোষ্ঠীর এমনতর আচরণকে কী বলে আখ্যা দেওয়া হবে? এযাবতকালীন বাংলাদেশের সাংবিধানিক ধারার যাবতীয় ক্ষমতাকে একজন ব্যক্তির হাতে পুঞ্জিভূত করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে একব্যক্তির হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা হয়েছে। এভাবেই একব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন কাঠামোর যাত্রা শুরু হয়েছিল বহুকাল আগে, যা আজও চলমান রয়েছে। উল্লেখ্য যে, নতুন স্বৈরাচারীরা আজ শুধুমাত্র শারীরিক দমন-পীড়নে বিশ্বাস করেন না, শারীরিক দমন-পীড়নের চাইতে তারা মগজের ভয় অধিক পরিমাণে পুনরুৎপাদন করে চলেছেন। সেখানে একজন স্বাভাবিক মানুষকে মানসিকভাবে নির্যাতন করে পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। একই সাথে এধরনের ভয় মানুষের মগজের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে গুম, হত্যা, ক্রসফায়ার, তথ্য নিয়ন্ত্রণ, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে একেবারেই পঙ্গু করে রাখা হয়েছে। এভাবে সুক্ষ্মভাবে ভয়ের একটা পরিবেশ তৈরি করে নতুন স্বৈরাচারীরা তাদের কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা চলমান রেখেছেন বলে সহজে অনুমান করা যায়। তাহলে এবার কি আপনাদের স্পষ্ট হলো স্বৈরাচারী ও একনায়কতন্ত্র কাকে বলা হয়?
প্রাসঙ্গিকভাবে আমি আরও উল্লেখ করতে চাই, ফেরাউন ছিলেন প্রাচীন দুনিয়ার নিষ্ঠুরতম স্বৈরশাসক। আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থায় নতুন করে অ্যাডলফ হিটলার স্বৈরতন্ত্রের সূচনা করেন। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে নানা দেশে নানাভাবে স্বৈরতন্ত্রের দুনিয়াকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে নব্য স্বৈরশাসকরা। কেউ গণতন্ত্রের লেবাস পরে স্বৈরশাসক আবার কেউ ঘোষিত স্বৈরশাসক। আমরা নিশ্চয়ই একমত হবো স্বৈরশাসকদের কারণে বিশ্বের মানবতার অপমৃত্যু ঘটেছে বার বার। তখনই কিন্তু মুক্তিকামী মানুষ জেগে উঠেছে, শুরু হয়েছে শাসক আর শোষিতের লড়াই। যখন প্রতিবাদী ও মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলনে কেঁপে উঠে স্বৈরতন্ত্রের জোয়াল তখনই লেজ গুটিয়ে পালানোর পথ খুঁজেছে বারংবার। আজ সহজ-সরল পার্বত্যবাসীকে দাবার গুটি বানিয়ে ক্ষমতার যাঁতাকলে পিষ্ট করছে বাংলাদেশ শাসকশ্রেণি। তারা নিজের তৈরি আইনের মাধ্যমে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে গ্রাস করতে চায়। পৃথিবীব্যাপী এমনই স্বৈরশাসকের পরিচয়, মনে রাখবেন তাদের শেষ পরিণতিও মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। হিটলারের রাজ্যজয় ও বর্ণবাদী আগ্রাসনের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। ৬০ লক্ষ ইহুদিকে পরিকল্পনা মাফিক হত্যা করা হয়েছে। ইহুদি নিধনের এই ঘটনাটি ইতিহাসে হলোকস্ট নামে খ্যাত। বর্তমান সময়ে স্বৈরশাসকদের শাসন-শোষণের নীতি-কৌশল যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পদ্ধতি পাল্টাতে বাধ্য হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে, বহু অনলাইন মিডিয়া, নিউজ পোর্টাল নিজেরাই সৃষ্টি করে, দেশের সমস্ত টিভি চ্যানেলগুলো নিজেদের আয়ত্তের মধ্যে রেখে এবং স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকাগুলো নিয়ন্ত্রণ করে তথ্য সন্ত্রাস ও গোয়েবলসীয় কায়দায় প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানো হচ্ছে।
নিজের ইচ্ছানুযায়ী আচার-আচরণ বা শাসন যিনিই করেন তাকে মূলত স্বৈরাচারী হিসেবে আখ্যায়িত করা চলে। কিন্তু বাংলাদেশ শাসকশ্রেণি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সেনা-সমর্থিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জুম্ম জনগণের প্রিয়নেতা সন্তু লারমার বিরুদ্ধে নানা ধরনের কুৎসা রটনা করে চলেছেন। নিজেরাই স্বৈরশাসকের ভূমিকা পালন করে দোষ চাপানো হয় সন্তু লারমার উপর। বাংলাদেশ সরকার তথা সরকারের সামরিক বেসামরিক আমলা, মন্ত্রী ও এমপি অনেকেরই স্বৈরাচারী, একনায়কতান্ত্রিক ও স্বার্থপর মনোভাবই তাদের আচার-আচরণে পরিষ্কারভাবে ফোটে উঠে। দীর্ঘ ৪৭ বছর ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে কারা গণতান্ত্রিক পন্থা পদ্ধতির বিপরীতে স্বৈরাচারী ভূমিকা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামকে শাসন-শোষণ করে চলেছেন? দীর্ঘ এত বছর যাবত পার্বত্য চট্টগ্রামের সহজ-সরল পার্বত্যবাসীদের সেনাবাহিনীর বুটের তলায় পিষ্ট করে রেখেছে কারা এবং কেন? জোরপূর্বক জুম্মদের জায়গা কেড়ে নিয়ে নিজেদের ইচ্ছামত বহিরাগত সেটেলার বাঙালিদের বসিয়ে দিয়েছেন কেন? ৭১ এর মহান স্বাধীনতার পর হতে এখনও পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বাধীন মতামতের উপর কারা দৃশ্যমানভাবে হস্তক্ষেপ করে চলেছেন? তাহলে স্বৈরশাসক কে হবেন, একনায়কতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী উপাধিতে ভূষিত হবেন কে? জুম্মদের উপর জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়া হয়েছে কাপ্তাই বাঁধ, চাপিয়ে দিলেন জোরপূর্বক জাতি হিসেবে বাঙালি পরিচিতি, আরও জোরপূর্বক চাপিয়ে দিলেন সংবিধানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, উপজাতি, সম্প্রদায় ও জাতিসত্তা, জোরপূর্বক আরও চাপিয়ে দিলেন উচ্চ শিক্ষার নামে বহিরাগত শিক্ষিত বাঙালিদের পুনর্বাসন করে নয়া ঔপনিবেশিক নীতি বাস্তবায়ন করতে রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, উন্নয়নের নামে অদৃশ্য শক্তির অর্থায়নে হাজির করলেন ঠেগামুখ স্থল বন্দর, সড়ক নির্মাণ, পর্যটন শিল্প, অপারেশন উত্তরণের নামে এক ধরনের সেনাশাসন। জুম্মদের উচ্ছেদ করে সেনাক্যাম্প সম্প্রসারণ, বিজিবি ক্যাম্প সম্প্রসারণ জোরপূর্বক চাপিয়ে দিলেন, স্থানীয় জুম্ম জনগণের কাছ থেকে কোন মতামত নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেননি, নিজের ইচ্ছানুযায়ী আচার-আচরণ করে তা বাস্তবায়ন করে চলেছেন। তাহলে চুড়ান্ত অর্থে কে স্বৈরাচারী?
আমি যতটুকু সন্তু লারমাকে কাছ থেকে দেখেছি, তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম, ঘাম ও রক্তের বিনিময়ে পার্বত্যাঞ্চলের পশ্চাৎপদ, গুণেধরা সহজ-সরল জুম্ম জনগণকে ভালবেসেছেন গভীরভাবে। সেই সাথে সারা বাংলাদেশের আদিবাসী ও বাংলার খেটে খাওয়া নিপীড়িত মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে লড়েছেন আপোষহীনভাবে। শাসকগোষ্ঠীর রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে প্রতিবছর বাংলাদেশের রাজধানীর বুকে শাসকশ্রেণির নাকের ডগায় নিপীড়িত মানুষের অধিকারের জন্য নিষ্কন্টক ভূমিকায় নিজের গুরুদায়িত্ব পালন করে চলেছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জুম্ম জনগণের প্রাণের নেতা, নিপীড়িত মানুষের একমাত্র আশা-ভরসার প্রতীক, যাকে ঘিরে জুম্ম জনগণ আগামীর স্বপ্ন বুনেন, স্বপ্ন দেখেন বেঁচে থাকার ও সামনে এগিয়ে যাবার, সেই জুম পাহাড়ের স্বপ্নদ্রষ্টা আমাদের জীবন্ত কিংবদন্তী সন্তু লারমাকে নিয়ে শাসকশ্রেণির নানাবিধ মিথ্যাচার অব্যাহত রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে ‘ভাগ কর, শাসন কর’ এই নীতি এম এন লারমা ও সন্তু লারমা সৃষ্টি করেননি, সৃষ্টি করেছেন অত্যাচারী শাসকশ্রেণি যা ব্রিটিশ আমল থেকে আজাবধি চলমান রয়েছে। তাই, স্বাভাবিকভাবে শাসকশ্রেণি তাদের রাজনৈতিক স্বার্থকে চরিতার্থ করার জন্য প্রতিনিয়ত দোষ চাপিয়ে দেন সন্তু লারমার উপর। পাহাড়ের যেকোন ঘটনা ঘটলেই দোষের নিশানা কেবল সন্তু লারমার দিকে, তা কেন? পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে চলছে আওয়ামী লীগের দূঃশাসন তথা যুগ যুগ ধরে চলে আসা নির্দয় সেনাশাসন। এখানে সন্তু লারমার শাসন চলে না। সন্তু লারমার ক্ষমতা একজন সেনাবাহিনী সদস্যর চেয়েও কম, কারণ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনকে অগ্রাহ্য করে সন্তু লারমাকে ঢাল নেই-তলোয়ার নেই, নিধিরাম সদ্দার করে রাখা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে সন্তু লারমার নিজের খেয়াল খুশিমত শাসন চালাতে চান, এমনই অভিযোগ ভুরি ভুরি তথ্য সন্ত্রাসকারী তথা শাসকশ্রেণি মহলের। পাহাড়ের খুন, গুম, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী সকল কর্মকাণ্ডের দোষ চাপানো হয় সন্তু লারমার উপর। লিখতে গেলে অনেক ফিরিস্তি সামনে হাজির হয়, কিন্তু শাসকশ্রেণি তাঁর খেয়াল খুশিমত পার্বত্য চট্টগ্রামকে শাসন-শোষণ করে চলেছেন, নিজেরাই স্বৈরাচারী ভূমিকা পালন করেন-জোরপূর্বক দোষ চাপানোর চেষ্টা করেন সন্তু লারমার উপর। শাসকশ্রেণির এধরনের রাজনীতির নামে অপরাজনীতির সংস্কৃতি এবং স্বৈরাচারী আচরণ জুম্ম জনগণের অস্তিত্বের সরাসরি হুমকি ছাড়া অন্য কিছুই নয়। অথচ আমরা জুম্ম জাতি অধিকারহারা, নিজের অধিকার ও অস্তিত্বের জন্য লড়াই করছি, আমাদের আন্দোলন কোন বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে নয়, আমাদের আন্দোলন উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ, উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদ, মৌলবাদ ও ইসলামী সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে। যারা আমাদেরকে অধিকার দিতে চায় না, আমাদেরকে শোষিত-বঞ্চিত করে রাখতে চায়, পৃথিবীর মানচিত্র থেকে আমাদের অস্তিত্বকে যারা চিরতরে বিলুপ্তি করতে চায়, তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের এই ন্যায়সঙ্গত লড়াই। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ও তাঁর দল জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে তথ্য সন্ত্রাস ও মিথ্যাচার বন্ধ করে নিপীড়িত জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের লড়াই সংগ্রামের সাথে একাট্টা হোন!
আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, উন্নয়নসহ সকল বিষয় স্থানীয় সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে এবং ঔপনিবেশিক কায়দায় এখনও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ শাসিত, শোষিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িত হচ্ছে। এমনতর পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সামগ্রিক পরিস্থিতি আজ অস্থিতিশীল, উদ্বেগজনক ও হতাশাব্যাঞ্জক এবং শাসকগোষ্ঠীর সাথে জুম্ম জনগণের অবিশ্বাস ও সন্দেহের দূরত্ব ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে সহজে অনুমান করা যায়। আজ জুম্ম জাতীয় জীবনে একদিকে চরম হতাশা সৃষ্টি হয়েছে, অপরদিকে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছে। নিরাপত্তাহীন ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ভাবনায় জুম্ম জনগণ আজ কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন। জুম্ম জাতির জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে বিষয়টি গভীরভাবে অনুভব ও উপলদ্ধির দাবি রাখে বলে আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।
লেখক: পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সভাপতি