‘সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন না করে নানাবিধ ষড়যন্ত্র করে চলেছে’ বলে অভিযোগ
হিল ভয়েস, ৫ জুন ২০২১, রাঙ্গামাটি: ‘হে ছাত্র সমাজ, দৃঢ়কন্ঠে ধরো মুক্তির জয়গান, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে আপোষহীন সংগ্রামে হও আগুয়ান’ স্লোগানকে সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) এর ২৫তম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল আজ ৫ জুন সকাল ১০:০০ ঘটিকায় রাঙ্গামাটিতে সম্পন্ন হয়েছে। কাউন্সিলে উপস্থিত প্রতিনিধি ও কেন্দ্রীয় সদস্যদের ভোটে সুমন মারমাকে সভাপতি এবং নিপন ত্রিপুরাকে সাধারণ সম্পাদক ও জগদীশ চাকমাকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট ২৫তম কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়।
প্রতিবছর ২০ মে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পর ২১ মে কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলেও করোনার পরিস্থিতির কারণে এবার পিছিয়ে কাউন্সিল করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিধি মেনে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল ও ছাত্র সম্মেলনে বিভিন্ন শাখা কমিটি থেকে প্রায় ৫০ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। তার বাইরেও দেশের বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেল কলেজে থেকে প্রায় ৩০ জন জুম্ম ছাত্র প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন।
ছাত্র সম্মেলন ও কাউন্সিলে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য সাধুরাম ত্রিপুরা (মিল্টন), বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা শাখার অর্থ সম্পাদক ডা: গঙ্গা মানিক চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের নেত্রীবৃন্দ। কাউন্সিলে সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সভাপতি জুয়েল চাকমা এবং সঞ্চালনা করেন সহ-সাধারণ সম্পাদক সুমিত্র চাকমা।
কাউন্সিলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শহীদ হওয়া পিসিপি’র কর্মীদের স্মরণে এক মিনিটি নীরবতা পালন করা হয়। কাউন্সিলে সামগ্রিক রির্পোট পাঠ করেন সহ সাধারণ সম্পাদক সুমিত্র চাকমা এবং পিসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির আর্থিক প্রতিবেদন পাঠ করেন অর্থ সম্পাদক কাজল চাকমা।
সামগ্রিক রিপোর্টে সুমিত্র চাকমা বলেন, কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতির চরম মেরুকরণ হচ্ছে। যতদিন দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা না হবে ততদিন আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার দাবি করলেও মূলত সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ লালন করে চলেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে সমাধানের জন্য পার্বত্য চুক্তি হয়েছে। কিন্তু সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন না করে দেশে বিদেশে নানাবিধ ষড়যন্ত্র করে চলেছে। প্রতি পদে পদে চুক্তি লঙ্ঘন করে চলেছে। শত বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করে জুম্ম জনগণের অত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠা কল্পে পিসিপি ছাত্র-যুব সমাজকে নিয়ে সর্বদা আন্দোলনরত রয়েছে।
প্রতিনিধি’র বক্তব্যে চট্টগ্রাম শাখার সদস্য অন্তর চাকমা বলেন, ‘করোনার কারণে সবকিছু স্থবির হয়ে গেলেও পিসিপি’র চবি শাখা সর্বদা লড়াইয়ে আছে। বিভিন্ন উদ্যোগী ও সৃজনশীল কর্মসূচি নিয়ে পিসিপি’র চবি শাখা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছে। অদূর ভবিষ্যতেও থাকবে সে আশাবাদ তিনি ব্যক্ত করেন।’
রাজশাহী মহানগর শাখার প্রতিনিধি অমর বিকাশ চাকমা বলেন, ‘নতুন নেতৃত্ব সংগঠনে আসলে নব উদ্দীপণায় কাজ করবে এ আশাবাদ ব্যক্ত করেন।’ রাজশাহী মহানগর শাখা আরো উদ্যমী হয়ে কাজ করবে বলে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
চট্টগ্রাম মহানগর শাখার প্রতিনিধি অনুজ চাকমা আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘বিদায়ী কমিটির সকল ব্যর্থতা ভুলে নব কমিটি চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সাথে আরো জোরালো সমন্বয় রেখে কাজ করবে। তিনি চট্টগ্রাম মহানগর শাখার জন্য লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন।’
বান্দরবান জেলা প্রতিনিধি অলকা তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, ‘বান্দরবানে পরিস্থিতি খুবই নাজুক অবস্থা বিরাজমান। তারপরও আমরা বান্দরবানের থানা কমিটি, ইউনিয়ন কমিটি সচল রাখার জন্য সর্বদা তৎপর আছি। অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদে মানববন্ধন ও মিছিল সফল করেছি। পিসিপি’র বান্দরবান জেলা শাখা দৃঢ় সংকল্প নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিত রয়েছে।’
রাঙ্গামাটির জেলা প্রতিনিধি খোকন চাকমা বলেন, ‘রাঙ্গামাটি জেলার অনেক কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে, তা এখনো পুনর্গঠন করা হয়ে উঠেনি।’ সেজন্য তিনি নব গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির সহায়তা কামনা করেন।
ঢাকা মহানগর প্রতিনিধি রেঙ ইয়ঙ ম্রো বলেন, ‘কঠিন পরিস্থিতির সময়ে যারা জনগণের পাশে ছিলেন তাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। আমি সবসময় সৃজনশীল নেতৃত্বে বিশ্বাস করি। বর্তমান জেনারেশন লড়াই সংগ্রামের সংজ্ঞা নিজেদের মত করে নিয়েছে। সেজন্য আমাদের নেতৃত্বকে প্রয়োজনে আন্দোলনে ডিজিটালাইজেশনও করতে হবে। না হলে অনেক বড় শক্তি আমরা আন্দোলনের সঙ্গে তাদের পাবো না। মহান নেতা এম এন লারমার বিখ্যাত তত্ত্ব গ্রামে ‘ফিরে যাও’, আমাদেরকে এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে।’
বিদায়ী বক্তব্যে সহ-সাধারণ সম্পাদক সুলভ চাকমা বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের পার্টির আন্দোলনকে জাতীয় মুক্তির আন্দোলন মনে করি। এই আন্দোলনে শুধু ছাত্র, যুব সমাজের বা রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে অংশ করলে হবে না, সমগ্র জুম্ম জনগণের অংশগ্রহণ করতে হবে। পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাংগঠনিক সংস্কৃতি, মূল্যবোধ মেনে চলা উচিত। সবক্ষেত্রে আমাদেরকে মনোযোগ নিতে হবে। জুম্ম জনগণের চলমান আন্দোলনে যা কিছু প্রয়োজন একজন কর্মী হিসেবে সবসময় ভেঙে নতুন ভাবে গড়ে তুলতে হবে।’
বিশেষ অতিথি ডা: গঙ্গা মানিক চাকমা বলেন, ‘পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলনে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের অবদান অনস্বীকার্য। জুম্ম জনগণের অধিকারের জন্য পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের আরো ব্যাপকভাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ পাহাড়ী সমাজ আশা করে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে সম্যক ধারণা রাখার জন্য অধ্যয়ন করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে শাসকগোষ্ঠী সবসময় ষড়যন্ত্র করে চলেছে। সেজন্য আমাদেরকে সবসময় সাবধানে পা ফেলতে হবে। জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ে মহান নেতা শ্রী সন্তু লারমার নির্দেশ মোতাবেক আমাদেরকে আন্দোলন জোরদার করতে হবে।’
প্রধান অতিথি শ্রী সাধুরাম ত্রিপুরা বলেন, ‘কোভিড ১৯ এর মধ্যে কাউন্সিল করা নিঃসন্দেহে সাহসিকতার বিষয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র দিনদিন মৌলবাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা বাংলাদেশী হতে পারি, কিন্তু বাঙালি হতে পারবো না, এর প্রতিবাদে পার্বত্য চট্টগ্রামে আন্দোলন সূচিত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, চুক্তি বাস্তবায়নের আন্দোলন অনেকদূর মনে হলেও এতদূর নয়, আর কাছে মনে হলেও, ততদূর কাছে নয়। নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা না থাকলে জুম্ম জনগণের আন্দোলন ব্যাহত হবে। সেজন্য যোগ্য নেতৃত্ব অর্জন করতে হবে। পিসিপিকে সে নেতৃত্বে হাল ধরতে হবে।’
বিদায়ী কমিটির সভাপতি জুুয়েল চাকমা বলেন, ‘পিসিপি সর্বদা আমার কাছে আবেগের। দীর্ঘ পথচলার এক পর্যায়ে আজকে ইতি টানতে হচ্ছে। আমাদের রক্ত পিচ্ছিল পথ চলা থেকে সরে দাঁড়ানোর কোন যুক্তি নেই। মহান পার্টির আদর্শ ধারণ করে প্রত্যেক কর্মীকে আন্দোলনে সামিল হতে হবে।’
আলোচনা সভা শেষে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট নবগঠিত ২৫তম কেন্দ্রীয় কমিটিকে শপথ বাক্য পাঠ করান বিগত কমিটির সভাপতি জুয়েল চাকমা।