হিল ভয়েস, ১২ জুন ২০২১, রাঙ্গামাটি: কল্পনা চাকমা অপহরণ দিবস উপলক্ষে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার রাঙ্গামাটি সদরে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় উপস্থিত নেতৃবৃন্দ বলেছেন, ‘আমাদের হতাশ হলে চলবে না। কল্পনা চাকমার অপহরণের বিচার আমাদের পেতেই হবে। বিচারের অধিকার পেতে হলে, আমাদেরকে অবশ্যই রাজনৈতিক আন্দোলন জিইয়ে রাখতে হবে।’
আজ ১২ জুন ২০২১ রাঙ্গামাটিতে কল্পনা চাকমার অপহরণের ২৫ বছর উপলক্ষে ‘অপহরণ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও যথাযথ বিচার নিশ্চিত কর এবং অপহরণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান কর’ দাবিতে হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় নেতৃবৃন্দ একথা বলেন।
হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শান্তি দেবী তঞ্চঙ্গ্যার সঞ্চালনায় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক রিতা চাকমার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কল্পনা অপহরণ মামলার আইনজীবী এডভোকেট জুয়েল দেওয়ান, বিশেষ অতিথি হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট নারী অধিকারকর্মী এডভোকেট সুস্মিতা চাকমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) কেন্দ্রীয় স্টাফ সদস্য আশিকা চাকমা, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সভাপতি সুমন মারমা, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সাগর ত্রিপুরা নান্টু।
আলোচনার শুরুতে কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৫ বছর উপলক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম মহিলা সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের দেওয়া যৌথ বিবৃতি পাঠ করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজ শাখার সভাপতি সোনারিতা চাকমা।
আলোচনা সভার প্রধান অতিথি ও কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলার আইনজীবী এডভোকেট জুয়েল দেওয়ান বলেন, কল্পনা চাকমার অপহরণের প্রতিবাদে পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা পুরো দেশে তথা দেশে বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। তৎকালীন যারা সেই অপহরণের প্রতিবাদ করেছিল, প্রতিবাদ করতে গিয়ে রুপম, সুকেশ, মনতোষ, সমর বিজয়রা শাহাদাৎ বরণ করেছিল। তাদের সেই সাহসী প্রতিবাদের ফলস্বরূপ রাষ্ট্র বাধ্য হয়ে আইনের আওতায় এনে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে তিন (৩) সদস্য বিশিষ্ট একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেন।
তিনি আরও বলেন, আমাদেরকে বিচারের অধিকার পেতে হলে, আমাদেরকে অবশ্যই রাজনৈতিক আন্দোলন জিইয়ে রাখতে হবে। কল্পনা চাকমা অপহরণের তদন্ত করার জন্য সরকার যে তদন্ত কমিশন গঠন করেছিল সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাবেক বিচারপতি আব্দুল জলিল একজন বিচারপতি ছিলেন, সারা জীবন বিচার করে গেছেন। তারও ইচ্ছে ছিল তিনি সত্য উদঘাটন করে প্রকাশ করবেন। কিন্তু তৎকালীন রাষ্ট্রের বিভিন্ন চাপে তারা সত্যটা প্রকাশ করতে পারেননি। সেখানে ১৯৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছিল। সেই জলিল কমিশনের একটা বক্তব্য ছিল যে, স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছেন, তবে কার দ্বারা অপহৃত হয়েছেন সেটি তিনি বলে যান নি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবিধান সকল আইনেরই উর্ধ্বে। সে সংবিধানে বলা হয়েছে রাষ্ট্রের জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস এবং তারা রাষ্ট্রের মালিক। সকল প্রকার অপরাধের বিচার পাওয়াটা রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের অধিকার। কিন্তু, আজ ২৫ বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও রাষ্ট্র কল্পনার অপহরণের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশে উদাসীন। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র যদি এগিয়ে না আসে, তাহলে কল্পনা অপহরণের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা সম্ভব হবে না এবং বিচার হবে না।
নারী অধিকার কর্মী এডভোকেট সুস্মিতা চাকমা বলেন, আজ কল্পনা চাকমার অপহরণের ২৫ বছর পূর্ণ হয়ে গেল। ইতিমধ্যে ৩৯ জন তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয়েছে এবং তারা সর্বশেষ চূড়ান্ত রিপোর্ট দিয়েছে যে, এখানে কোনো কিছুই পাওয়া যায়নি। কিন্তু, আমরা তাদের সেই চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করিনি ও করতে দিইনি এবং সেটা গ্রহণযোগ্য না। কল্পনা চাকমাকে যে গুম করা হয়েছে, তাকে অপহরণ করা হয়েছে, একটা তরুণ তাজা প্রাণ যে হারিয়ে গেছে, সেটা তো সত্য এবং বাস্তব। তার অপহরণের চাক্ষুষ সাক্ষী রয়েছে। রাষ্ট্র কিন্তু এটা মিথ্যে বলতে পারেনি এবং তারা এও বলতে পারে না যে কিছুই হয়নি। কিছু একটা তো হয়েছে। সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ করার দায়িত্ব কিন্তু রাষ্ট্রের। কিন্তু তারা সেটি সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে গেছে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের হতাশ হলে চলবে না। আমাদের কল্পনার অপহরণের বিচার আমাদের পেতেই হবে। সেজন্য আমাদের আরো সোচ্চার হতে হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার কত বছর পরে হয়েছে, আমাদের কল্পনা চাকমাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে সংগঠিত সকল প্রকার নিপীড়ন নির্যাতন, হত্যা, গুম সহ সকল ধরনের অপরাধের বিচার হবেই। ফৌজদারি অপরাধের বিচার কিন্তু সময়ের অভাবে হারিয়ে যায় না, আমরা যদি সেটা হারাতে না দিই।
পিসিজেএসএসের কেন্দ্রীয় স্টাফ সদস্য আশিকা চাকমা বলেন, আজকে জুম্ম জনগণ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। শাসকগোষ্ঠী আমাদের উপর তথা যারা অধিকারের পক্ষে কথা বলছে তাদের উপর কেন এত নিপীড়ন, কেন এত নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে তা আমাদের জুম্ম নারী সমাজকে বুঝতে হবে। বর্তমান বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক পন্থায় পরিচালিত হচ্ছে। রাষ্ট্র আমাদের ওপর সবসময় বিমাতাসুলভ আচরণ জারি রেখেছিল, এখনো রেখেছে। আমরা ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর হওয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি যথাযথ বাস্তবায়নের দাবিতে যখন আন্দোলন করছি, আমাদের অধিকারের সপক্ষে কথা বলছি, তখনই সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের পরিবর্তে উল্টো চুক্তি বিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কর্তৃক ঘোষিত অধিকতর আন্দোলনে জুম্ম তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সভাপতি সুমন মারমা বলেন, ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিজয় কেতন চাকমা তথা জুম্ম জনগণ মহান জাতীয় সংসদে যেন প্রতিনিধিত্ব করতে না পারে, সেজন্য কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা হয়েছিল। কল্পনাকে অপহরণ করে জুম্ম নারী সমাজের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রের আগ্রাসী চেহারা ইতিমধ্যে সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছে। আমরা অনেক ধৈর্য্য ধরেছি। যে রাষ্ট্র নিজেরাই কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করেছে, সে রাষ্ট্রের কাছেই আমাদের আজকে বিচার চাইতে হচ্ছে। আজকে সরকার বিচার ব্যবস্থাকে ভঙ্গুর করে দিয়ে নিজেদের করায়ত্বে নিয়ে এসেছে এবং সেটাকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করছে।
তিনি আরো বলেন, আজকে ২৫ বছর পরও কেন কল্পনা চাকমার খোঁজ মেলেনি, কেন তাকে অপহরণ করা হয়েছিল সে বিষয়ে বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে আলোকপাত করতে হবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতির রাঙ্গামাটি জেলা শাখার সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সাগর ত্রিপুরা নান্টু বলেন, রাষ্ট্র তার ভূখন্ডে বিচারহীনতার সংস্কৃতি জারি রেখেছে। তারই অংশ হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পর হতে আজ পর্যন্ত জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই জিইয়ে রাখা পিসিজেএসএস ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ তথা তাদের সমর্থকদের ওপর অঘোষিত দমন-পীড়ন জারি রেখেছে। শুধু কল্পনা চাকমা নয়, স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্মদের উপর সংগঠিত গণহত্যা, খুন, ধর্ষণ, সাম্প্রদায়িক হামলার প্রত্যেকটি ঘটনা বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমে সুষ্ঠু বিচার না হওয়া পর্যন্ত ছাত্র যুব সমাজকে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানান তিনি।
স্বাগত বক্তব্যে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ম্রানু মারমা বলেন, আজ দীর্ঘ ২৫ বছর পার হয়ে গেলেও রাষ্ট্র এখনো কল্পনা চাকমার খোঁজ দিতে পারেনি। তার অপহরণের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। একটা মানুষ ২৫ বছর ধরে খোঁজ নেই, হদিশ নেই অথচ রাষ্ট্র নির্লজ্জভাবে কালক্ষেপণ করে কল্পনা চাকমার অপহরণের প্রতিবেদন প্রকাশ করছে না। এটা মেনে নেওয়া যায় না।