রুমেন চাকমা
আজ ৩০ শে জুন। ২০১১ সালের আজকের এই দিনে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আদিবাসীদেরকে সাংবিধানিকভাবে আবারও ‘বাঙালি’ বলে আখ্যায়িত করা হয় এবং ৫০ টির অধিক আদিবাসী জাতির জাতিগত পরিচিতিকে আবারও অস্বীকার করা হয়। আধুনিক সভ্য বিশ্বে শুধুমাত্র একটি জাতি নিয়ে একটি রাষ্ট্র পাওয়া যায় না, বরং সেই ধারণাটি আধুনিক গণতন্ত্রের জন্য চরম লজ্জারও বটে!
বাংলাদেশের ইতিহাসে আদিবাসীদের বাঙালিকরণের ইতিহাস নতুন নয়। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে প্রথম সংবিধান যখন প্রণয়ন করা হচ্ছিল, তখনই প্রথম দেশের সকল নাগরিককে বাঙালি বলে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। তৎকালীন সংসদে ভিন্ন জাতির প্রতিনিধি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এবং এর প্রতিবাদে সংসদ থেকে ওয়াকআউটও করেছিলেন।
এ প্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালের গণপরিষদ বির্তকে অংশ নেয়া মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ঐতিহাসিক বক্তব্যটি স্মরণ করা যেতে পারে-
“স্পিকার: আপনি কি বাঙালি হতে চান না?
এম এন লারমা: মাননীয় স্পিকার, আমাদিগকে বাঙালি জাতি বলে কখনো বলা হয় না। আমরা কোনো দিনই নিজেদের বাঙালি মনে করি না। আজ যদি এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানের জন্য এই সংশোধনী পাস হয়ে যায়, তাহলে আমাদের এই চাকমা জাতির অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা আমাদের বাংলাদেশি বলে মনে করি এবং বিশ্বাস করি। কিন্তু বাঙালি বলে নয়।”
মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার তীব্র প্রতিবাদ সত্বেও উগ্র জাত্যাভিমানে দাম্ভিক সেই সংসদ সংবিধানে দেশের সকল নাগরিককে বাঙালি বলে চিহ্নিত করেছিল। সেটা ছিল সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীর ঐতিহাসিক ভুল। বাংলাদেশের সংবিধানে জাতিগত পরিচিতি এবং শাসনতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে পার্বত্যাঞ্চলের জুম্ম জনগণ ধীরে ধীরে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলে। কিন্তু তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী সেদিকে কর্ণপাত না করে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকের ন্যায্য দাবি তথা রাজনৈতিক সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের পরিবর্তে সামরিকভাবে মোকাবিলা করার হঠকারী পথের দিকে পা বাড়ায়।
যদিও জিয়াউর রহমান সরকারের ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারণা সংবিধানে ঠাঁই দেন, কিন্তু বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ধারণাটা গ্রহণ করা হয়েছে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার গণপরিষদের সেই ঐতিহাসিক বক্তব্য থেকে। জিয়াউর রহমান সরকার সকল নাগরিকদের বাংলাদেশী হিসেবে আখ্যায়িত করার আড়ালে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে জাতিগত নির্মূলীকরণের দিকে সবচেয়ে বেশি ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মুখোশ পড়ে ১৯৭৯-৮০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে চার লক্ষাধিক বাঙালি পুনর্বাসন করেন। ফলশ্রুতিতে ১৯৫১ সালে যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের পরিমাণ ছিল মাত্র ৭ শতাংশ, সেখানে মাত্র ৩০ বছরের ব্যবধানে ৪৭ শতাংশে এসে দাঁড়ায় এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে আরো জটিল করে তোলেন। সেই সাথে চলতে থাকে ব্যাপক সামরিকায়ন, যার নাম দেওয়া হয় অপারেশন দাবানল।
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে এরশাদ সরকার সমাধানের চেষ্টা করলেও জনগণের আন্দোলকে খন্ডবিখন্ড করার সব ষড়যন্ত্রও চালাতে থাকেন। একদিকে প্রতিরোধ সংগ্রাম এবং অপরদিকে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের প্রচেষ্টার এক পর্যায়ে ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ঐতিহাসিক সেই চুক্তির মাধ্যমে জুম্ম জনগণ জাতিগত পরিচয়ের স্বীকৃতি না পেলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জন্য শাসনতান্ত্রিক অধিকার অর্জন করে। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী সেই শাসনতান্ত্রিক অধিকারকে পদে পদে ভূলুন্ঠিত করে আবারও ২০০১ সাল থেকে অপারেশন উত্তোরণ নাম দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন পুর্নবহাল করে এবং লঙ্ঘিত হতে থাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির শাসনতান্ত্রিক অধিকারের মৌলিক শর্তসমূহ।
ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে জাতিগত পরিচিতি স্বীকৃত না হলেও জুম্ম জনগণ তথা পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি জুম্ম জনগণের জাতিগত পরিচিতির দাবি থেকে বিন্দুমাত্র সরে আসে নি। বরং এই দাবিকে পাহাড়-সমতলে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকে। আদিবাসীদের সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবেÑএই দাবিকে সামনে রেখে ২০০১ সালে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমাকে সভাপতি এবং সঞ্জীব দ্রংকে সাধারণ সম্পাদক করে পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের সমন্বয়ে যৌথ লড়াইয়ের প্লাটফর্ম ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’ গঠিত হয় এবং জাতিগত পরিচয়ের সংগ্রাম তথা অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নতুন এক দিশা সূচিত হয় যা আজও চলমান রয়েছে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পুনরায় সরকার গঠন করে এবং একক সংখ্যাঘরিষ্ঠতা লাভ করে। সারাদেশের আদিবাসী জনগণ ও সচেতন বুদ্ধিজীবীদের দাবি ছিল- সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এবং আদিবাসীদেরকে সংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করুক। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার আদিবাসীদের সকল দাবি উপেক্ষা করে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ন্যায় ২০১১ সালের ৩০শে জুন পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের সকল জনগণকে ‘বাঙালি’ হিসেবে চিহ্নিত করে জেনেশুনে তাঁর পিতার ন্যায় ঐতিহাসিক ভুল করেন।
বাংলাদেশের জনগণকে ‘বাঙালি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে ১৯৭২ এবং ২০১১ সালের সংবিধান যে ভুলটি করেছিল, শাসকগোষ্ঠীর সেই ঐতিহাসিক ভূলের কারণে আজ আদিবাসীরা বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। একদিকে শাসকগোষ্ঠীর জাতিগত অস্বীকৃতি, অপরদিকে রাষ্ট্রীয় মদদে আদিবাসীদের ধর্মান্তরকরণ, ভূমি-বেদখল, নারী ধর্ষণ, নির্যাতন-নিপীড়ন ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সহজ-সরলতা ও দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে পার্বত্যাঞ্চলের জুম্ম জনগণকে ধর্মান্তরকরণ প্রক্রিয়া দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে। যার জ্বলন্ত প্রমাণ আমরা দেখতে পাই বান্দরবানে আলীকদমে তথাকথিত ‘উপজাতীয় মুসলিম কল্যাণ সংস্থা’ গঠনের মাধ্যমে।
কিন্তু আদিবাসীরা তথা পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ নিজেদের শাসনতান্ত্রিক অধিকার এবং জাতিগত পরিচয়ের দাবিতে বড্ড পরিকর। পাহাড় এবং সমতলের আদিবাসীদের রয়েছে লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। যেমন আজ (৩০ জুন) ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬৬ বছর, যা ‘হুল দিবস’ হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত। তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-নিপীড়নের প্রতিবাদে সিধু-কানুর নেতৃত্বে ১৮৫৫ সালের আজকের এই দিনে ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ সংগঠিত হয়, যা ছিল ব্রিটিশ বিরোধী প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গণ সংগ্রাম। এই সংগ্রাম যুগে যুগে নিপীড়ত জনগণের লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ সুদীর্ঘ কাল থেকেই শাসনতান্ত্রিক অধিকার ও জাতিগত পরিচিতির দাবিতে গণসংগ্রাম পরিচালিত করে আসছে। সময়ে বাস্তবতার তাগিদে এই গণসংগ্রাম নিয়মতান্ত্রিক ও অনিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। শাসনতান্ত্রিক অধিকার ও জাতিগত পরিচিতির অধিকার না পাওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন আপোষহীনভাবে চলমান থাকবে।
সর্বশেষে, জুম্ম জনগণের লড়াই সংগ্রামের অগ্রগামী প্রবাদপুরুষ জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার একটি বক্তব্য দিয়ে শেষ করতে চাই – ‘আজকে জুম্ম জনগণ সংখ্যায় কম হতে পারে। কিন্তু আমাদের অধিকারের জন্য মৃত্যুকে আমরা জয় করেছি। আমরা মৃত্যুকে ভয় পাই না। আমরা আমাদের অধিকারের জন্য জীবিত অবস্থায় মৃত থাকতে চাই না।’
লেখক: রুমেন চাকমা, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক