হিল ভয়েস, ২০ মে ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিয়োজিত ও নিবেদিত আপোষহীন লড়াকু ছাত্র সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ৩২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ।
১৯৮৯ সালের ৪ মে সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক সংঘটিত পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম বর্বরোচিত গণহত্যা ‘লংগদু গণহত্যা’র প্রতিবাদ করতে গিয়ে ২০ মে ঢাকার বুকে তৎকালীন অধিকার সচেতন পাহাড়ি ছাত্ররা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)’ নামে পাহাড়ি ছাত্রদের নতুন একটি বৃহত্তর ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। পিসিপি প্রতিষ্ঠার সময়টায় ছিল দেশজুড়ে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রকাশ্যে কোন রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানো ছিলো নিষিদ্ধ। জুম্ম ছাত্র ও যুবদের উপর সেনা ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নজর ছিলো তীক্ষ্ণ এবং আগ্রাসী। দিন দিন নিপীড়ন-নির্যাতনের মাত্রা সীমা ছড়িয়ে যাচ্ছিল। একের পর এক হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হতে থাকে। নির্বিচারে খুন-গুম হয়ে উঠে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। ঘরে বাইরে কোথাও ছিলো না সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা। প্রতিটি রাত ছিলো আতঙ্ক ও অনিশ্চিতে ভরা। এমনি এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতেও সেসময় প্রতিবাদী ও সচেতন পাহাড়ি ছাত্ররা সেনাশাসনের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ফুঁসে উঠেছিল এবং অপরিমেয় স্পর্ধায় শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে জুম্মদের উপর চলমান অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার ও অমানবিকতার বিরুদ্ধে নি:সংকোচ আওয়াজ তুলেছিল। আর কাঁধে তুলে নিয়েছিল জুম্মদের মানুষের মত মানুষ হিসেবে বাঁচার একমাত্র পথ আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের কঠিন ও গৌরবময় অংশীদারিত্ব।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে পিসিপি সরকার ও সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায় গড়ে উঠা বিভিন্ন লাঠিয়াল বাহিনী, মুখোশ বাহিনী ও বাঙালি সেটেলারদের উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠনের বিরুদ্ধে ইস্পাত কঠিন আন্দোলনে গড়ে তোলে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে পরিচালিত জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে। ষাট দশক ও সত্তর দশকের প্রথম দিকের পাহাড়ী ছাত্র সমিতির পর পিসিপির নেতৃত্বে ছাত্র-সমাজ আরও একবার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দুর্বার প্রাণশক্তি হয়ে উঠে। অমর বিকাশ, ক্যজাই মারমা, লাল রিজার্ভ বম, রূপম, সুকেশ, মনতোষ, সনজিৎ তঞ্চঙ্গ্যা, মংচসিং মারমা, পেসকা মারমাসহ আরো অনেক কর্মী জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শহীদ হন।
১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের পরও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে চলমান পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের আন্দোলনে তার গুরুদায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে পিসিপি। সংগঠনটি অবিচল সংগ্রামী চেতনা ও অদম্য সাহস নিয়ে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের যেকোনো লড়াই সংগ্রামে সদা প্রস্তুত রয়েছে। নানা চড়াই-উতরাই অতিক্রম করে সংগঠনটি আজ ৩২তম বছর পূর্ণ করেছে।
এই ৩২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সংগঠনটি করোনার মহামারী পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আজ অনলাইনে এক আলোচনা সভা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজ “ঠড়রপব ড়ভ চঈচ-কেওক্রডং” থেকে অনলাইন আলোচনা সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন কণা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক বসু মিত্র চাকমা, পিসিপি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জাতিসংঘের এক্সপার্ট মেকানিজম অন দ্যা রাইটস অফ ইনডিজিনাস পিপলস (এমরিপ) কাউন্সিলের সদস্য বিনোতাময় ধামাই, সাংবাদিক নজরুল কবির, পিসিপির সহ-সভাপতি সুমন মারমা, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মো: ফয়েজ উল্লাহ, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন প্রিন্স, বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সহ-সভাপতি চন্দ্রা ত্রিপুরা, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অলিক মৃ, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা এবং সভাপতিত্ব করবেন পিসিপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি জুয়েল চাকমা।
অনলাইন আলোচনা ছাড়াও সংগঠনটি প্রতিষ্ঠবার্ষিকী উপলক্ষে একটি বিবৃতি প্রকাশ ও প্রচার করেছে। প্রচারিত বিবৃতিতে বলা হয়, দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় ধরে জুম্ম জনগণের প্রবল প্রতিরোধ, দেশে ও বিদেশে ব্যাপক চাপের মুখে পড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষে তৎকালীন আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন সরকার পার্বত্য অঞ্চলে অধিকারহারা জুম্ম জনগণের একমাত্র লড়াকু রাজনৈতিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সাথে ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের পর যে আশা সঞ্চারিত হয়েছিল, চুক্তির ২৩ বছর পার হয়েও মৌলিক বিষয়সহ দুই-তৃতীয়াংশ ধারা বাস্তবায়িত না হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের উপর পূর্বের ন্যায় বর্তমান সরকার দমন-পীড়ন চালাচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে লঙ্ঘন করে, দেশে ও বিদেশে প্রবল প্রতিবাদের মুখেও সেনাবাহিনী ও সিকদার গ্রুপ কর্তৃক স্থানীয় আদিবাসী ম্রোদের জুম ভূমি দখল করে নাইতং পাহাড়ের বুকে পাঁচতারা হোটেল ও পর্যটন স্থাপনা নির্মাণে সরকার কোন ধরনের ভূমিকা না নেওয়ায় বিবৃতিতে সমালোচনা করা হয়। বলা হয়, চুক্তি লঙ্ঘন করে, ম্রোদের উচ্ছেদ করে পাঁচতারা হোটেল নির্মাণ কখনোই রাষ্ট্রের জন্য শুভ ফল বয়ে আনবে না। তাই অনতিবিলম্বে নাইতং পাহাড়ের বুকে পাঁচতারা হোটেল ও পর্যটন স্থাপনা নির্মাণের সকল প্রকল্প বন্ধসহ বাতিল করার দাবি জানানো হয়।
বিবৃতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখতে অবিচল সাহস ও ত্যাগের মহিমায় যুগের ঐতিহাসিক দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে জুম্ম জনগণের এই দুর্দিনে জুম্ম ছাত্র-যুব সমাজকে দৃঢ় কন্ঠে মুক্তির জয়গান গেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে জোরদার করার আহবান জানানো হয়।
এ উপলক্ষে পিসিপি’র সহ-সাধারণ সম্পাদক সুমিত্র চাকমা বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে আমরা এ বছর আমাদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী অনলাইন আলোচনা সভার মধ্যে দিয়ে পালন করব।