হিল ভয়েস, ১০ এপ্রিল ২০২১, টাঙ্গাইল: টাঙ্গাইল জেলাধীন মধুপুর উপজেলার আদিবাসীদের অঞ্চলে আদিবাসীদের ভূমির উপর ইকো-ট্যুরিজম ও আরবোরেটুম বাগানের নামে প্রাচীর ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আদিবাসী নেতৃবৃন্দ। উক্ত নির্মাণ কাজ বন্ধ করা না হলে কঠোর আন্দোলনের হুশিয়ারি দিয়েছেন তারা।
গতকাল ৯ মে ২০২১ সকাল ১১:০০ টায় আদিবাসীদের ভূমির উপর ইকো-ট্যুরিজম ও আরবোরেটুম বাগানের নামে প্রাচীর নির্মাণ ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরির প্রতিবাদে মধুপুরের জলছত্রের পঁচিশ মাইল এলাকায় ‘মধুপুরের বিক্ষুব্ধ আদিবাসী ছাত্র-জনতা’র ব্যানারে আয়োজিত এক মানববন্ধনে বক্তারা এই দাবি জানান ও হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
আবিমা গারো ইয়্যুথ এসোসিয়েশন (আজিয়া) এর সাধারণ সম্পাদক শ্যামল মানখিনের সভাপতিত্বে এবং গারো স্টুডেন্টস্ ফেডারেশন (জিএসএফ) এর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক লিয়াং রিছিলের সঞ্চালনায় মানববন্ধনে সংহতি বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক টনি ম্যাথিউ চিরান, বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন (বাগাছাস) এর কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি জন যেত্রা, গারো স্টুডেন্টস্ ফেডারেশনের সভাপতি প্রলয় নকরেক, বাগাছাস মধুপুর উপজেলা শাখার সহ-সভাপতি বিশ্বজিৎ সিমসাং এবং বাংলাদেশ কোচ আদিবাসী ইউনিয়নের নেতা অন্তর বর্মন প্রমুখ।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, স্মরণাতীত কাল থেকেই মধুপুরের গড়াঞ্চলে গারো, কোচ/বর্মন আদিবাসীদের বসবাস। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনামল, পাকিস্তান শাসনামল পেরিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছরেও অত্র গড়াঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমির মালিকানা ও সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয়নি। উপরন্তু বিভিন্ন সরকারের সময় জাতীয় উদ্যান, ইকোপার্ক, ইকো-ট্যুরিজম, ফায়ারিং রেঞ্জ ও সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণার নামে আদিবাসীদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের নীল নকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন হয়ে আসছে। ১৯৪৯-৫০ খ্রিষ্টাব্দে ‘পূর্ব পাকিস্তান প্রাইভেট ফরেস্ট অ্যাক্ট’ ও “অপয়ঁরংরঃরড়হ ধহফ ঞবহধহপু অপঃ” (১৯৫০) এর আওতায় প্রাকৃতিক শালবন উজাড় করার মাধ্যমে সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণা করা হয়। মধুপুরের টেলকী গ্রামে আদিবাসীদের ভূমি ও প্রাচীন কবরস্থানে ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়নের নামে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে আরবোরেটুম বাগান সৃষ্টি, রেস্ট হাউজ ও প্রাচীর নির্মাণ করে আদিবাসীদের উচ্ছেদ ও প্রান্তিকতার দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত আমারা সহজে মেনে নেব না।
তারা বলেন, বর্তমানে ‘স্থানীয় ও আদিবাসী জনগণের সহায়তায় মধুপর জাতীয় উদ্যানের ইকো-ট্যুরিজম উন্নয়ন ও টেকসই ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’ নামে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পে (১ জুলাই ২০১৮ হতে ৩০ জুন ২০২১ সাল পর্যন্ত গৃহীত) স্থানীয় ও আদিবাসী জনগণের সহায়তার কথা উল্লেখ থাকলেও স্থানীয় আদিবাসীদের সাথে আলোচনা না করে, পূর্বানুমতি না নিয়ে, অবহিত না করে উক্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালা ও শিষ্টাচার বহির্ভূত।
বক্তারা আরও বলেন, সারা বিশ্ব আজ করোনা ভাইরাসে জর্জরিত হলেও মধুপরের আদিবাসীদের আজ জীবন ও ভূমি রক্ষার জন্য আন্দোলনে নামতে হচ্ছে। রাষ্ট্র কতটা পাষাণ হলে করোনা ভাইরাসের মধ্যে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নাগরিকের জীবনমান রক্ষার দিকে মনোযোগ না হয়ে উচ্ছেদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। ইকোট্যুরিজম প্রকল্পের নামে প্রাচীর ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ তা বিনোদন পার্কের রূপান্তর মাত্র এবং এই ধরনের প্রকল্প স্থানীয় আদিবাসীদের স্বার্থ ও জীবন-জীবিকার সাথে সাংঘর্ষিক এবং মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকারের লংঘন বলে স্পষ্টত প্রতীয়মান।
মানববন্ধনে বক্তারা অবিলম্বে আদিবাসীদের ভূমির উপর ইকো-ট্যুরিজম ও আরবোরেটুম বাগানের নামে প্রাচীর নির্মাণ ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরি বন্ধ করার জন্য জোর দাবি জানান এবং অন্যথায় মধুপুরের আদিবাসী জনগণ কঠোর আন্দোলন করতে বাধ্য হবে বলে হুশিয়ারি দেন।
মানববন্ধন শেষে আদিবাসীরা ডাকযোগে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বরাবর চারটি দাবি জানিয়ে স্মারকলিপি পেশ করেন। দাবীসমূহ-
১। টেলকি গ্রামে তথাকথিত আরবোরেটুম/ উদ্ভিদ সংরক্ষণ উদ্যানের নামে আদিবাসীদের পূর্ব পুরুষদের বিদ্যমান প্রাচীন শ্মশান (মাংরুদাম) এর স্থানে প্রাচীর নির্মাণ, সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্থাপনাসহ প্রকল্প বাস্তবায়ন অবিলম্বে বন্ধ করা।
২। চলমান প্রকল্প এলাকা ও তৎসংলগ্ন স্থানীয় আদিবাসীদের দখলীয় কৃষি ও ফসলি (বাইদ/চালা) জমিতে কোন ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন না করা।
৩। জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষণা বাতিল করে মধুপুরে স্থানীয় আদিবাসীদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ ষড়যন্ত্র বন্ধ করা।
৪। আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান ও সমতলের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠন করা।