হিল ভয়েস, ২৪ মে ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: বান্দরবান পার্বত্য জেলার চিম্বুক পাহাড়ে সেনাবাহিনী ও শিকদার গ্রুপ কর্তৃক নির্মাণাধীন বিতর্কিত বিলাসবহুল ফাইভ স্টার হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণ প্রকল্পটি বাতিলের জন্য সহযোগিতা চেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা), পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সাব-কমিটি-১ এর আহ্বায়ক ও সাংসদ দীপঙ্কর তালুকদার এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমার নিকট স্মারকলিপি দিয়েছেন স্থানীয় ম্রো জনগোষ্ঠী।
গতকাল ২৩ মে ২০২১ রাঙ্গামাটিতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সাব-কমিটি-১ এর আহ্বায়ক ও সাংসদ দীপঙ্কর তালুকদার এর নিকট একই বিষয়ে আলাদাভাবে এই স্মারকলিপি দেয় চিম্বুক পাহাড়ের ম্রো জনগোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দ। এরপর তারা আজ (২৪ মে ২০২১) দুপুরের দিকে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমার নিকট স্মারকলিপি প্রদান করেন।
স্মারকলিপিকে ম্রো জনগোষ্ঠী বলেন, ‘বিগত দীর্ঘ আট মাস ধরে আমরা চিম্বুকবাসীরা স্বত:স্ফূর্তভাবে বিভিন্ন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মাধ্যমে পাঁচতারকা হোটেল ও বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণের প্রতিবাদ জানিয়ে আসা সত্ত্বেও একটি মহল বিষয়টিকে তথাকথিত ম্রো জনপ্রতিনিধি ও গ্রামবাসীদের বরাত দিয়ে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে ম্রোদের সম্মতি আছে মর্মে প্রতিষ্ঠিত করার নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজে লিপ্ত রয়েছে। আমরা আবারও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই যে, চিম্বুক পাহাড়ে আমরা কোনো ধরনের হোটেল কিংবা পর্যটন কেন্দ্র চাই না।’ তারা উক্ত তিন পার্বত্য কর্তৃপক্ষের নিকট তাদের অস্তিত্বের স্বার্থে ‘ম্যারিয়ট হোটেল ও বিনোদন পার্ক’ প্রকল্পটি বাতিলে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও ভূমিকা কামনা করেন।
উল্লেখ্য, স্থানীয় আদিবাসী ম্রোদের উচ্ছেদ করে এবং তাদের জীবন-জীবিকা ও পরিবেশের হুমকি সৃষ্টি করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও শিকদার গ্রুপ চিম্বুক পাহাড়ে ফাইভ স্টার হোটেল ও বিনোদন পার্কসহ বিলাসবহুল পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করছে বলে ম্রো জনগোষ্ঠীসহ দেশে-বিদেশে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ ও তা বাতিলের দাবি অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু সেনাবাহিনী ও শিকদার গ্রুপ তবুও জোর করে এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
চিম্বুক এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে মেনরাও ম্রো, লংঙান ম্রো, মেনচিত ম্রো প্রমুখ স্বাক্ষরিত পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যানের বরাবরে পেশকৃত স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়, ‘২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে বান্দরবান পার্বত্য জেলার চিম্বুক পাহাড়ের ৩০২ নং লুলাইং মৌজার নাইতং পাহাড়ে ও ৩৫৫ নং সেপ্রু মৌজার কাপ্রুপাড়া, ডলাপাড়া ও এরাপাড়া ঘেঁষে আদিবাসী ম্রো অধ্যুষিত অঞ্চলে শিকদার গ্রুপের অঙ্গ সংগঠন আর এন্ড আর হোল্ডিংস লিমিটেড এবং ২৪ পদাতিক ডিভিশন ও বান্দরবানের ৬৯তম ব্রিগেড এর যৌথ উদ্যোগে ‘ম্যারিয়ট হোটেলস্ এন্ড রিসোর্ট’ নামে একটি পাঁচতারকা হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এর ফলে চিম্বুক ও নাইতং পাহাড়ে শতাব্দী কাল ধরে জুমচাষ করে আসা ম্রো জনগোষ্ঠী তাদের বসতভিটা শ্মশান, পবিত্র পাথর, পবিত্র বৃক্ষ, পানির উৎস ইত্যাদি থেকে উচ্ছেদ হবে। প্রায় ১০০০ হাজার একরের বেশি ভূমি থেকে ৬টি গ্রাম সরাসরি উৎখাত হবে এবং ১১৬টি পাড়ার আনুমানিক ১০ হাজার বাসিন্দার ঐতিহ্যবাহী জীবিকা বিভিন্নভাবে স্থায়ী ক্ষতির মুখে পড়বে।’
স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়, ‘আমাদের ভূমি হারানোর তিক্ত ইতিহাস রয়েছে, যেখানে দেখা গেছে অতীতে বিভিন্ন উন্নয়ন এবং পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের ফলে আমরা আমাদের পিতৃপুরুষের ভিটেমাটি হারিয়ে আমাদের হাজার বছরের নিজ বসতভূমিতে পরবাসী হয়ে পড়েছি। ১৯৯১-৯২ সনে বাংলাদেশ সেনা ও বিমান বাহিনীর গোলন্দাজ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (ফায়ারিং রেঞ্জ) স্থাপনের জন্য ভূমি অধিগ্রহণের কারণে সুয়ালক ও তংকাবতী ইউনিয়নের প্রতিটি মৌজা (৩১৪ সুয়ালক, ৩১৫নং রেনিক্ষ্যং ও ৩০৮নং উত্তর হাঙ্গর) থেকে আমাদের ৩১৮টি ম্রো পরিবার উচ্ছেদ হয়। ২০০৬-২০০৭ সনে আবারও ঐ অধিগ্রহণকৃত এলাকা থেকে আরও তিন শতাধিকেরও অধিক পরিবার উচ্ছেদ হয়ে যায়। এরপর নীলগিরি হিল রিসোর্টস স্থাপিত হলে অনেক ম্রো ও মারমা পরিবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এভাবে একের পর এক বসতভিটা হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে আমাদের মানুষদেরকে শেষাবধি চিম্বুক পাহাড়ে এসে আশ্রয় নিতে হয়েছে।’
এতে আরও বলা হয়, ‘জেলা পরিষদ সেনাবাহিনীর সাথে যে ২০ একর পাহাড়ি জায়গা ৪০ বছরের জন্য লীজ দিয়ে চুক্তি করেছিল তারও কোনো আইনি ভিত্তি নেই। কারণ ভূমি বন্দোবস্তি ও লীজ প্রদানের এক্তিয়ার এখনও জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত হয়নি। বর্তমানে যেখানে ২০ একর জায়গায় প্রকল্পের কাজ সীমিত থাকার কথা, সেখানে উদ্যোক্তারা নির্ধারিত সীমানার চেয়েও অনেক বেশি এলাকা ঘিরে রেখে তাদের স্থাপনার কাজ শুরু করে দিয়েছে এবং আমাদের শ্মশানঘাট, পবিত্র পাথর, পবিত্র বৃক্ষ ও পানির উৎসে যাতায়াতে বাধা সৃষ্টি করছে।’
সাংসদ দীপংকর তালুকদারের নিকট লিখিত স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়, ‘মহোদয়, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে আমরা নাইতং পাহাড়ে পাঁচতারকা হোটেল নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান, প্রতিবাদী সাংস্কৃতি সমাবেশ, প্রেস বিজ্ঞপ্তি, ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ লং মার্চ ইত্যাদি বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন করে আসছি। সর্বশেষ গত মার্চ মাসে ঢাকায় আমরা সংহতি সমাবেশ করেছি। আমাদের ন্যায্য দাবির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ, ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠন, সাংসদ, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবর্গ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বিবৃতি প্রদান করেছে, জাতিসংঘের একাধিক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার আমাদের উপর চেপে বসা আসন্ন সংকটের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে। কিন্তু আমরা উদ্বেগের সহিত লক্ষ্য করছি যে, এতসব বিবৃতি, প্রতিবাদ ও বিরোধিতা সত্ত্বেও পাঁচতারকা হোটেল নির্মাণের কাজ থেমে নেই। প্রাণঘাতী করোনা নিয়ন্ত্রণে আরোপিত লকডাউনের মধ্যেও নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের কাজ নিয়মিত চলছে। আমাদের হতাশা, বঞ্চনা ও বেদনার কথা শোনার কি তাহলে কেউ নেই? চিম্বুক পাহাড়ের দশ হাজার ম্রো-বাসীর জীবনের কি কোনো মূল্য নেই?’