হিল ভয়েস, ২৯ মে ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: গ্রীষ্মের মৌসুম এলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। সমস্যা সমাধানের জন্য স্থানীয় জনগণের আবেদন সত্ত্বেও প্রশাসনের উদাসীনতায় এ সমস্যা সমাধানের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এবারেও খাগড়াছড়ি জেলার দুর্গম এলাকাগুলোতে বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলাধীন গুইমারা উপজেলার সিন্দুকছড়ি ইউনিয়নের ধোগ্যছড়া গ্রামে ১৩টি পরিবার খুব তীব্র পানির সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
গভীর নলকূপ স্থাপনের কথা থাকলেও ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে পাথর থাকায় তা আর সম্ভব হয়ে উঠে নি। তাই ওই পরিবারসমূহ গ্রামের পানের একমাত্র উৎস হিসেবে কুয়ার পানি পান করে আসছে। এক কলস পানির জন্য দুুই-আড়াই ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়, তাও আবার অনেক সময় মানুষ বেশি হলে খালি কলসি নিয়ে ফিরতে হয়। কুয়া পাহাড় থেকে নিচু এলাকায় হওয়ায় ৪শ’ ফুট উঁচু পাহাড় ডিঙিয়ে কুয়া হতে পানির সংগ্রহ করেন তারা। তবে বর্ষামৌসুমে ঝিরি ও কুয়া পানি ঘোলাটে ও অপরিষ্কার হয়ে পড়ায় সেই দুর্ভোগ আরও চরম হয়ে উঠে।
গ্রামের কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী যশোদা ত্রিপুরা জানান, নিজের গ্রামে সুপেয় পানির উৎস বলতে ঝিড়ি ও কুয়া। প্রতিদিন পরিবারের সদস্যদের জন্য অনেক দূর পারি দিয়ে পানীয় জল সংগ্রহ করেন তিনি। শুধু যশোদা ত্রিপুরা নন, একই গ্রামের রনেকা ত্রিপুরা’সহ ১৫-১৬টি পরিবারের সবাই ওই কুয়া থেকে দীর্ঘদিন ধরে পানি সংগ্রহ করে পানি পান করছেন। এ সমস্যা সমাধানে স্থানীয় প্রশাসন ও দায়িত্বপ্রাপ্ত জনপ্রতিনিধিদের দৃষ্টি কামনা করেন তিনি।
স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী রত্না কিশোর ত্রিপুরা মুঠোফোনে জানান, দীর্ঘদিন ধরে আমাদের গ্রাম দোগ্যছড়া’সহ পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামে পানি সমস্যা রয়েছে। সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সুইনুপ্রু মারমার দায়িত্বকালীন সময়েও পানির জন্য বিভিন্ন জনের কাছে আবেদন করেছি। কিন্তু কোনটাই বাস্তবায়ন হয়নি। পাড়ার পাশে ‘তাইয়ংখ’ নামে পাহাড়ের নিচে জলাধার আছে। সেখানে যদি বাঁধ বা পানি জমানোর ব্যবস্থা করে, সেখান থেকে পাইপ এর মাধ্যমে রাস্তার পাশে একটা পানির ট্যাংক বা পানির হাউজ বসানো হয় তাহলে পাড়াবাসী সেখান থেকে সহজে সুপেয় পনি সংগ্রহ করতে পারবে।
ধোগ্যছড়া গ্রামের কার্বারী থোয়াইঅং ত্রিপুরা বলেন, আমাদের এখানে সারা বছরই সুপেয় পানির সংকট থাকে। তবে অন্যান্য বছরের চেয়ে এ বছরে সংকট বেশি। ৪/৫ শ’ ফুট পাহাড়ি পথ ডিঙিয়ে এসব এলাকার মানুষকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। এসব সমস্যা সমাধানে পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর মিলে উদ্যোগ নিলে পানির এই কষ্ট কমবে বলে আশাবাদী তিনি।
স্থানীয় ইউপি সদস্য সবেন জয় ত্রিপুরা জানান, আমার ওয়ার্ডে সমস্যার অভাব নেই। এরমধ্যে পানি সমস্যা অন্যতম। সারা বছর পানির জন্য কষ্ট করতে হয় এখানকার মানুষদের। গভীর নলকূপ বসাতে চাইলেও ভূগর্ভে পাথর থাকায় পানির উৎস পাওয়া যায় না, তখন ঠিকাদাররা কাজ করতে চান না। সমস্যার ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরেও অবগত করেছি, দেখা যাক, তারা কি করে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘জাবারাং’র নির্বাহী পরিচালক ও গবেষক মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, ক্রমাগত পাহাড়ি এলাকার ঝিরি-ঝর্ণাগুলো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এর মূল কারণ হলো বাণিজ্যিকভাবে গাছ কর্তন, পাথর উত্তোলন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি। অন্যদিকে পর্যটকের পরিবেশ বান্ধব আচরণ না করাও একটি কারণ বলে ধারণা করেছেন তিনি।
তিনি বলেন, পাহাড়ে আগেকার দিনে বড় বড় গাছ ছিল। পাহাড় না কেটে আমরা ঘর-বাড়ি তৈরি করতাম। কিন্তু এখন বন উজার হয়ে যাচ্ছে। জঙ্গল আগের মত সবুজ নেই। চারিদিকে ন্যাড়া পাহাড়। যার কারণে পাহাড়ে এখন পানির সংকট।
খাগড়াছড়ি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী রেবেকা আহসান মুঠোফোনে জানান, যেসব পাহাড়ি এলাকায় পানির সংকট কিংবা পানির উৎস নেই, সেসব এলাকায় একটি জরিপ করা হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জেলায় গভীর নলকূপ ও চাপকলের সংখ্যা ৯ হাজার ৬শ’ ৮৩। এর মধ্যে বিদ্যালয়ে বসানো হয়েছে ২শ’ ৩৪টি। চলতি অর্থবছরে ৩৪টি গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ চলছে। খাগড়াছড়ি জেলায় মোট জনগোষ্ঠীর ৫৬ শতাংশকে পানি সরবরাহ করা হয়। অন্যরা প্রাকৃতিক উৎসের (ঝিরি, ঝরনা, কুয়া, ছড়া) ওপর নির্ভরশীল।