হিল ভয়েস, ১০ এপ্রিল ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: আজ ১০ এপ্রিল ২০২১ খ্রিস্টাব্দ, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার পানছড়ি উপজেলার লোগাং এলাকায় সংঘটিত পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসের অন্যতম নৃশংসতম ও মানবতাবিবর্জিত লোগাং গণহত্যার ২৯ বছর। ১৯৯২ সালের আজকের এইদিনে পাহাড়ের জুম্মদের বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের বিজু, বৈসু, সাংগ্রাইং, বিষু, বিহু ও সাংক্রান উৎসবের মাত্র দুই দিন আগে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক সংঘটিত হয় এই বর্বরোচিত হত্যাকান্ড। শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও এটি ‘লোগাং গণহত্যা’ নামে পরিচিত হয়। দেশ-বিদেশের সকল মানবতাবাদী মানুষের কাছে এটি নিন্দিত ও ঘৃণিত হয়।
সেদিন এক সেটেলার বাঙালি রাখাল বালককে শান্তিবাহিনী হত্যা করেছে এমন অভিযোগ তুলে বাছবিচার না করে সেনাবাহিনী, বিডিআর (বর্তমান বিজিবি), আনসার-ভিডিপির সহযোগিতায় সেটেলার বাঙালিরা এই হত্যাকাণ্ড চালায়। সেটলাররা ধারালো দা, বটি, কুড়াল দিয়ে নিরীহ আদিবাসীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সেনাবাহিনী ও বিডিআর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এ হত্যাকান্ডে শিশু, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ নর-নারী কেউ রেহায় পায়নি সেদিন। দুই শতাধিক পাহাড়ি আদিবাসী মারা যায়, অনেকে নিখোঁজ হয়। আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হয় প্রায় ৭ শ’র বেশি জুম্মদের বাড়িঘর।
বর্বর এই হত্যাকাণ্ডের কারণে আদিবাসী পাহাড়িদের ঐতিহ্যবাহী প্রাণের বিজু, বৈসু, সাংগ্রাইং, বিষু, বিহু ও সাংক্রান উৎসবের আনন্দ মুহূর্তে মহাশোকে পরিণত হয়। ১৩ এপ্রিল যেদিন উৎসবে মেতে ওঠার কথা সেদিন খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে হাজার হাজার লোকের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, লেখক-সাংবাদিক বিক্ষুব্ধ জনতার সাথে সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভে শামিল হন। হাজার হাজার প্রদীপ জ্বালিয়ে গণহত্যায় নিহতদের স্মরণ করা হয়।
ঢাকা থেকে উৎসবে যোগ দিতে যাওয়া রাজনৈতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, মানবাধিকার কর্মী, লেখক-সাংবাদিক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে যেতে চাইলে তাদের নিরাপত্তার অজুহাতে তাদের বাঁধা দেয় পানছড়ি উপজেলার সেনাবাহিনী। প্রবীণ রাজনীতিবিদ পঙ্কজ ভট্টাচার্য, আইনজীবী সারা হোসেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনু মুহাম্মদ সহ ২২ জন ঢাকায় ফিরে এক বিবৃতি দেন।
বিবৃতিতে জানানো হয়, লোগাং গ্রামে একটি গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে। একজন বাঙালি কিশোর নিহত হওয়ার সূত্র ধরে সেখানে চাকমা ও ত্রিপুরা গুচ্ছগ্রামে গ্রাম প্রতিরক্ষা দল (ভিডিপি) ও আনসার বাহিনীর কিছু বাঙালি দুষ্কৃতকারী হামলা চালায়। চারশরও বেশি ঘর সেখানে আগুন দিয়ে পোড়ানো হয় এবং শিশু-নারী-বৃদ্ধসহ ২ শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়।
তাঁরা আরও বলেন, এ বর্বর গণহত্যার বর্ণনা শুনে আমরা স্তম্ভিত হই, এর নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। এ বর্বর গণহত্যার কারণে পুরো অঞ্চলে পাহাড়ি জনগণের বার্ষিক উৎসবের সকল কর্মসূচি পরিত্যক্ত হয়। আনন্দমুখর জনপদ শোক ও অশ্রুর জনপদে পরিণত হয়। ঘরছাড়া, মা হারানো, বাবা হারানো, সন্তান হারানো নিরীহ দুর্বল দরিদ্র জনগণের সঙ্গে আমরাও ক্ষুব্ধ। একই সঙ্গে আমরা ক্ষুব্ধ প্রকৃত ঘটনা চেপে রাখার জন্য কর্তৃপক্ষের ন্যাক্কারজনক চেষ্টায়।
১০ই এপ্রিল বিডিআর, ভিডিপি, আনসারসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সহযোগিতায় সেটেলারদের দ্বারা সংঘটিত ভয়াবহতম গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে বিজু, বৈসু, সাংগ্রাইং, বিষু, বিহু ও সাংক্রান উদযাপন কমিটি কর্তৃক খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে যথাক্রমে ১২ ও ১৪ ই এপ্রিল শোক সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সারা পার্বত্য চট্টগ্রামে বিজু, বৈসু, সাংগ্রাইং, বিষু, বিহু ও সাংক্রান উৎসব বর্জন করা হয়। ঢাকায় ১৯ এপ্রিল এই হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ মৌন মিছিল বের করে এবং প্রধানমন্ত্রীর নিকট একটি স্মারকলিপি পেশ করে। ২৮ এপ্রিল ১৯৯২ পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ লোগাং অভিমুখে দীর্ঘ পদযাত্রা করে। প্রতিনিয়ত সেনাবাহিনীর বাঁধা পেরিয়ে হাজার হাজার মানুষ লোগাং পৌঁছায় এবং সেখানে ফুল দিয়ে নিহতদের সম্মান জানায়।
এছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান ও লোগাং হত্যাকান্ডের বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবিতে ৭ মে ১৯৯২ গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য দেশব্যাপী মিছিল ও সমাবেশ করে। আন্তর্জাতিকভাবে লোগাং গণহত্যা নিয়ে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ মানবাধিকার কমিশনে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতির সমিতির প্রতিনিধি রামেন্দু শেখর দেওয়ান প্রতিবাদ জানান।
সামরিক শাসনে থাকা পার্বত্য চট্টগামের জুম্ম জনগণ আজো এ গণহত্যার বিচার পায়নি। লোগাং গণহত্যাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে এ যাবত ডজনের অধিক গণহত্যা ও দুুই ডজনের অধিক সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু কোন ঘটনারই আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি। ফলে এ ধরনের বর্বর ঘটনা এখনো ঘটেই চলেছে। উপরন্তু বিচার চাইতে গিয়ে, প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে হত্যা-গুম আর নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে বলে আদিবাসীদের অভিযোগ। এ নির্যাতনের ধারায় এখনো নির্যাতিত হয়ে চলেছে পাহাড়ের আদিবাসীরা।
পার্বত্য সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান এবং এলাকায় শান্তি ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় কমিটি ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু দীর্ঘ ২৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও সেই চুক্তি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। এমনকি সেই একই সরকার দীর্ঘ ১২/১৩ বছর ধরে একনাগাড়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও বর্তমানে এই পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে বলে জনসংহতি সমিতি ও জুম্ম জনগণের অভিযোগ। তাদের অভিযোগ, চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে সেই সমস্যা এখনও সেই তিমিরে রয়ে গেছে, বরং আরও জটিলতর হয়েছে এবং চুক্তির পরেও জুম্মদের উপর দুই ডজনের অধিক বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছে। পূবের্র মতই অব্যাহতভাবে চলছে জুম্মদের উপর সামরিক অভিযান, দমন-পীড়ন, মিথ্যা মামলা, তল্লাশি, গ্রেফতার, নারী ধর্ষণ, ধর্মান্তর, ভূমি বেদখলসহ নানাবিধ মানবাধিকার লংঘন। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের অধিকার, জীবনের নিরাপত্তা ও শান্তি এখনও অনিশ্চিত।