হিল ভয়েস, ৬ এপ্রিল ২০২১, খাগড়াছড়ি: খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলাধীন মাটিরাঙ্গা উপজেলার তবলছড়ি ইউনিয়ন এলাকায় সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক উস্কানি সৃষ্টি করে আশেপাশের জুম্মদের গ্রামে হামলার চেষ্টা চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গতকাল ৫ এপ্রিল ২০২১ রাত আনুমানিক ৯:০০ টার দিকে সেটেলাররা প্রথমে মাইকে সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক শ্লোগান দিতে শুরু করে এবং এরপর রাত আনুমানিক ১০:০০ টার দিকে জুম্মদের গ্রামে হামলার প্রচেষ্টা গ্রহণ করে বলে জানা গেছে।
এদিকে সেটেলারদের এই সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক শ্লোগান এবং সাম্প্রদায়িক হামলার উদ্দেশ্যে মিছিল-সমাবেশের খবর শুনে আশেপাশের বেশ কয়েকটি জুম্ম গ্রামের নারী, শিশু ও বয়স্করা নিরাপত্তার জন্য যে যেদিকে পারে পালিয়ে যায় বলে খবর পাওয়া গেছে।
স্থানীয় একটি সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ এপ্রিল ২০২১ তবলছড়ি এলাকার সেটেলার বাঙালিদের নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও ঝগড়াঝাঁটির কারণে ২ ব্যক্তি আহত হন। তার জের ধরে একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ফায়দা লুঠার উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক উস্কানি সৃষ্টি করে জুম্মদের উপর হামলার চেষ্টা করে। অপর এক সূত্রে জানা যায়, গতকাল ৫ এপ্রিল ২০২১ কয়েকজন সেটেলার বাঙালি নারী-পুরুষ জুম্ম অধ্যুষিত লাইফু কার্বারি পাড়ার এক মাঠে গরু চরাতে যায়। গরু চরানোর পর বিকেলে ঐ সেটেলার বাঙালিরা বাড়িতে ফিরে যায়। বাড়িতে ফেরার পর তাদের মধ্যে কে বা কারা প্রচার করে যে, গরু নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে তারা ‘শান্তিবাহিনী’ দেখেছে। এ কথাটি দ্রুত সেটেলারদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে এবং একটি গোষ্ঠী জুম্মদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও উত্তেজনা ছড়াতে থাকে।
এরপর রাত আনুমানিক ৯:০০ টার দিকে সেটেলার বাঙালিদের একটি গোষ্ঠী মসজিদ থেকে মাইকে ‘শান্তিবাহিনী’ ও ‘জুম্ম’দের বিরুদ্ধে নানা উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রচার করতে থাকে এবং আক্রমণাত্মক শ্লোগান দিয়ে আশেপাশের সেটেলার বাঙালিদের উত্তেজিত করতে থাকে। মাইকে সেটেলার বাঙালিদের রাস্তায় নেমে মিছিল ও সমাবেশে সামিল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। রাত প্রায় ১০:০০ টার দিকে ৪০০-৫০০ সেটেলার বাঙালি জড়ো হয়ে পরিকল্পিতভাবে তবলছড়ির ‘৩ নম্বর’ নামক স্থান থেকে জুম্ম বিদ্বেষী শ্লোগান দিয়ে মিছিল বের করে। মিছিলটি লাইফু পাড়া হয়ে আমতলা কাঠের ব্রিজ নামক স্থানে এসে সমাবেশে রূপ নেয়।
সমাবেশে ‘নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর’, ‘এক বাঙালির কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’, ‘পাহাড়িদের চামড়া, তুলে নেবো আমরা’ ইত্যাদি স্লোগান তুলে এবং জুম্ম বিদ্বেষী ব্যাপক সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দিয়ে সমাবেশস্থল উত্তপ্ত করে তোলা হয়।
জানা গেছে, এই মিছিল ও সমাবেশে নেতৃত্ব দেন তবলছড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কাশেম ভূঁইয়া ও সাম্প্রদায়িক সংগঠন বাঙালি ছাত্র পরিষদের নেতা লোকমান হোসেন। সমাবেশে তবলছড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কাশেম ভূঁইয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) ও খাগড়াছড়ির এমপি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরাসহ জুম্মদের বিরোধী নানা সাম্প্রদায়িক বক্তব্য প্রদান করেন।
সমাবেশে আবুল কাশেম ভূঁইয়া বলেন, সন্তু লারমা জাতীয় পতাকা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বন্দুক কিনে বাঙালিদের উপর অত্যাচার করছে। অহিংসা পরম ধর্ম এর নাম নিয়ে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরারা জীব তো দূরের কথা মানুষকে খুন করছে। তিনি বাঙালিদের উস্কানি দিয়ে জুম্মদের উদ্দেশ্যে আরও বলেন, চৌষট্টি জেলার বাঙালি আমরা এখানে আছি, এই বাঙালি কারা জানেন? হারাম জাত! প্রশাসন কিছু না করলে আমরা বসে থাকবো না।
তবে শেষ পর্যন্ত হামলার কোনো ঘটনা ঘটেনি বলে জানা গেছে। পরে রাত ২:০০ টা-৩:০০ টার দিকে ঘটনাস্থলে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং সেটেলারদের স্ব স্ব বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
এদিকে সেটেলার বাঙালিদের সাম্প্রদায়িক হামলার আশঙ্কায় তবলছড়ির লাইফু কার্বারি পাড়া, তালুকদার পাড়া, দেওয়ান পাড়া ও তাইন্দং এলাকার শত শত জুম্ম নারী, শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানা যায়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সেসব জুম্মরা নিজেদের বাড়িতে ফিরেছেন বলে জানা যায়নি।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ৩ আগস্ট মাটিরাঙ্গার তাইন্দং এলাকার সেটেলার বাঙালিরা মো: কামাল হোসেন নামে জনৈক মোটর সাইকেল চালককে অপহরণের গুজব ছড়িয়ে সেনা-বিজিবির উপস্থিতিতে স্থানীয় জুম্মদের ১১টি গ্রামে সংঘবদ্ধভাবে সাম্প্রদায়িক হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালায়।
উক্ত হামলায় সেটেলার বাঙালি কর্তৃক সর্বেশ্বর পাড়ায় বৌদ্ধ বিহারের ১টি ঘরসহ ১৯টি বাড়ি, বগা পাড়ায় ১২টি, তালুকদার পাড়ায় ২টি ও বান্দরসিং পাড়ায় (ভগবান টিলা) ৩টি বাড়ি মোট ৩৬টি ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং সর্বেশ্বর পাড়া জনশক্তি বৌদ্ধ বিহার ও মনুদাস পাড়া বৌদ্ধ বিহার নামে ২টি বৌদ্ধ মন্দিরসহ প্রায় ৪০০ ঘরবাড়িতে লুটপাট ও ভাঙচুর করা হয় বলে জানা যায়।
প্রাণের তাগিদে ৪৫৪ পরিবারের প্রায় ২০০০ জুম্ম গ্রামবাসী ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডের ‘নো ম্যান’স ল্যাণ্ডে’ আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। এছাড়া ৩৮০ পরিবারের প্রায় ১,৫০০ ত্রিপুরা গ্রামবাসী পার্শ্ববর্তী পানছড়ি উপজেলায় এবং ৩৫ পরিবার জঙ্গলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।