হিল ভয়েস, ২৮ এপ্রিল ২০২১, রাঙ্গামাটি: রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলাধীন বাঘাইছড়ি উপজেলার আমতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল সেটেলার বাঙালি কর্তৃক পার্শ্ববর্তী সার্বোয়াতলী ইউনিয়নের পেরাছড়া নামক জুম্ম গ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনার পর তিনদিন অতিক্রান্ত হয়েছে। সেখানকার পরিস্থিতি আপাতত শান্ত ও থমথমে রয়েছে।
তবে স্থানীয় সেনাবাহিনী ও বিজিবি’র কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় বিভিন্ন মুরুব্বিদের সাথে কয়েক দফায় বৈঠক ও আলোচনা হলেও হামলাকারীদের শাস্তি এবং হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত জুম্মদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। বিশেষত প্রশাসনের পক্ষ থেকে হামলাকারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরীসহ অন্যান্য সেটেলার বাঙালিদের শাস্তি বিধানের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
গতকাল ২৭ এপ্রিল ২০২১ সকাল আনুমানিক ৯:০০ টার দিকে সার্বোয়াতলী ইউনিয়নের বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে ভুক্তভোগী জুম্ম গ্রামবাসীদের এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে জুম্মদের পক্ষ থেকে তিনটি দাবি নির্ধারণ করা হয়েছে। দাবিগুলি হল- (১) সকাল ৭:০০ টা হতে বিকাল ৬:০০ টা পর্যন্ত এই নির্দিষ্ট সময়ে কেবলমাত্র আমতুলি থেকে পেরাছড়ার রাস্তা দিয়ে বাঘাইছড়ির বিভিন্ন জায়গায় বাঙালিদের মোটরসাইকেল চলাচল উন্মুক্ত থাকবে; (২) কালাচোখা এবং মো: রব মিয়ার ভূমি সংক্রান্ত সমস্যাটি আলাদাভাবে সুষ্ঠু বিচারের দাবি; ও (৩) ঘটনার দিন সেটেলারদের হামলায় আহত এবং ক্ষতিগ্রস্ত পেরাছড়া নিবাসী জুম্ম দোকানদার পূর্ণ চন্দ্র চাকমাকে (৫৫) চিকিৎসা খরচ এবং তার দোকানের অন্যান্য ক্ষতিপূরণ বাবদ ৩৪,০০০ টাকা দাবি। দাবিসমূহ আজ (২৮ এপ্রিল) বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) নিকট পেশ করার কথা রয়েছে।
উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন বাঘাইছড়ি উপজেলার সার্বোতুলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তুষারকান্তি চাকমা, প্যানেল চেয়ারম্যান অতুল বিহারী চাকমা, শিজকমুখ ৩ নং ওয়ার্ডের মেম্বার ত্রিদিব চাকমা, ৪ নং ওয়ার্ডের মেম্বার সুভাষ কুসুম চাকমা, ১/২/৩নং ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বার ছবি চাকমা, ৪/৫/৬নং উত্তর সার্বোতুলির ওয়ার্ডের মহিলা মেম্বার শেফালিকা চাকমা, সার্বোয়াতুলি ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের পেরাছড়া মেম্বার তুষারবিন্দু চাকমা প্রমুখ জনপ্রতিনিধিবৃন্দ।
উক্ত আলোচনা সভার পূর্বে গত ২৬ এপ্রিল ২০২১ বিকাল আনুমানিক ৫:০০ টায় বাঘাইছড়ির ইউএনও’এর কার্যালয়ে জুম্ম গ্রামে হামলার ঘটনা মীমাংসার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ ও জনগণকে নিয়ে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন হামলার মূল হোতা আমতুলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরী, বাঘাইছড়ির ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুনীল বিহারী চাকমা, পেরাছড়ার স্থানীয় কার্বারী অমূল্য চাকমা ও সার্বোতুলি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তুষারকান্তি চাকমাসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
জানা গেছে, উক্ত সভায় সবার বক্তব্য শেষে আমতুলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরী ‘পেরাছড়া থেকে আমতুলিতে জুম্মদের যাতায়াত করতে কোন ধরনের অসুবিধা হবে না, পেরাছড়া থেকে আমতুলিতে স্থানীয় কোনো জুম্ম অবস্থানকালে তাদের উপর যেকোনো অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তার জন্য কেবলমাত্র তিনিই দায়ী থাকবেন’ মর্মে সবাইকে আশ্বাস দেন। কিন্তু ভুক্তভোগী জুম্মরা ও স্থানীয় কয়েকজন মুরুব্বি চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরীর এই আশ্বাসে কোন আস্থা নেই বলে জানান এবং এটা তার শুধু মুখের বুলি বলে মন্তব্য করেন। তারা রাসেল চৌধুরীর উপযুক্ত শাস্তি দাবি করেন। এই আলোচনা সভা কোন সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকেই সমাপ্ত হয়।
এছাড়া হামলার ঘটনার পরের দিন, ২৫ এপ্রিল ২০২১ বিজিবি’র উদ্যোগে পেরাছড়া গ্রামে স্থানীয় জুম্ম মুরুব্বিদের নিয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিজিবি মারিশ্যা জোনের টুআইসি উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যায়। কিন্তু এই সভায়ও দোষীদের শাস্তির ব্যাপারে কোন নিশ্চয়তা না থাকায় কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানা যায়।
এরপর দুরছড়ি সেনাক্যাম্পের কমান্ডার আলতাফ সেনাবাহিনীর একটি দল নিয়ে ঘটনাস্থলে যান এবং আলোচনার জন্য স্থানীয় জুম্ম মুরব্বিদের দুরছড়ি ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য বলেন। কিন্তু আমতলী ইউপি চেয়ারম্যান মো: রাসেল চৌধুরী উক্ত আলোচনায় আসবেন না জানার পরে স্থানীয় পাহাড়ি মুরুব্বিরা ক্যাম্পে যায় নি।
উল্লেখ্য, গত ২৪ এপ্রিল ২০২১ শনিবার বিকাল আনুমানিক ৩:০০টা-৪:০০টার মধ্যে আমতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল সেটেলার বাঙালি পার্শ্ববর্তী সার্বোয়াতলী ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের পেরাছড়া নামক জুম্ম গ্রামে সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়। হামলায় ৩ জুম্ম আহত এবং ১টি দোকান ও ১টি বৌদ্ধ বিহার ভাঙচুর ও লুটপাটের শিকার হয়েছে বলে জানা যায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ঐদিন সকাল আনুমানিক ৯:০০ টার দিকে আমতলী এলাকার সেটেলার বাঙালি মো: রব মিয়া পার্শ্ববর্তী পেরাছড়া গ্রামে কালাচোখা চাকমার ধান্য জমিতে গরু চরাতে যায় এবং গরুগুলো কালাচোখার ধানক্ষেত নষ্ট করে দেয়। এনিয়ে কালাচোখা চাকমা ও মো: রব মিয়ার মধ্যে বাকবিতন্ডা ও হাতাহাতি হয়। পরে মো: রব মিয়া বিষয়টি চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরীকে জানায়। আর চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরী কোনো কিছু বিচার বিবেচনা না করে একদল সেটেলার বাঙালি নিয়ে ধারালো অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে জুম্ম গ্রামে হামলা চালায়।