হিল ভয়েস, ৭ এপ্রিল ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: সুনামঞ্জের শাল্লায় নোয়াগাঁও হিন্দুদের উপর হামলার ঘটনার সরেজমিন পরিদর্শনোত্তর নাগরিক প্রতিনিধি দল আজ বুধবার ৭ এপ্রিল ২০২১ এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করেন।
ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এএলআরডি’র সহকারী প্রকল্প সমন্বয়ক এ্যাডভোকেট রফিক আহমেদ সিরাজীর সঞ্চালনায় নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী এ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, প্রবীণ সাংবাদিক সেলিম সামাদ, কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পারভেজ হাসেম, এএলআরডি’র উপ-নির্বাহী পরিচালক রওশন জাহান মনি, জাসদের কেন্দ্রীয় নেত্রী তনিমা সিদ্দিক ও আইইডির সহ-সমন্বয়কারী হরেন্দ্র নাথ সিং প্রমুখ।
ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য পাঠ করেন নাগরিক প্রতিনিধি দলের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ঘটনার আগে গ্রামের মসজিদে কিছুক্ষণ পর পর মাইকিং করে সেখানে আক্রমণের জন্য লোকজন জড়ো করা হয়। ফলে হাজারো মানুষের আক্রমণের মুখে গ্রাম ছেড়ে পলায়ন করেন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন। এই সুযোগে হেফাজত নেতার অনুসারীরা গ্রামে প্রবেশ করে বাড়িঘর তছনছ করে ও লুটপাট চালায় এবং এ ঘটনায় প্রায় ৮০ টি বাড়ি এবং ৮টি মন্দির ভাংচুর হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন ঢাবি’র এই অধ্যাপক। শাল্লায় সংঘটিত সংখ্যালঘু নির্যাতন, তাদের হয়রানি এবং মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাসহ পূর্বে সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে সকল ঘটনা ঘটেছে তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতারসহ কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবিও জানান।
এদিকে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে এক শ্রেণির মানুষ আপামর মানুষের অন্তরে সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে দাবি করে তিনি আরো বলেন, প্রশাসন চাইলেই এ ঘটনা রোধ করা যেত। কারণ ঘটনার আগের দিন স্থানীয়ভাবে তারা মিটিং মিছিল করেছে। পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসন তা জানত। তবে সেখানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য ক্ষোভও জানান এই শিক্ষক।
সংবাদ সম্মেলনে আলোচনায় অংশ নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, এ ধরনের একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার এতদিন পর গিয়ে আমি যা দেখলাম, যদি কোনো রাষ্ট্রে কোনো সরকার থাকে এবং নাগরিকদের ন্যুনতম স্বীকৃতি থাকে তবে এতদিনে অনেক কিছু ঘুচে যাওয়ার কথা, সেটা হয়নি। আমরা কিন্তু পরিস্থিতির ভয়াবহতা এটা দিয়েই উপলব্ধি করতে পারি।
তিনি আরও বলেন, এই ঘটনাসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর সাম্প্রদায়িক আক্রমণের ঘটনা দেখলে মনে হয়, আমাদের সমাজে একটা সাম্প্রদায়িকীকরণের ধারা গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে। এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটার পরে প্রশাসন যে ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারতো তা নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
রাজনৈতিক দলের মদদ ছাড়া এই সাম্প্রদায়িক শক্তির বেড়ে ওঠা সম্ভব নয় দাবি করে তিনি আরো বলেন, সকল রাজনৈতিক দল ও সরকারকে এই সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মদদ দেওয়া বন্ধ করতে হবে । মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক প্রশাসন গড়ে তোলার জন্য সরকারকে আহ্বান জানান তিনি।
বাসদের কেন্দ্রীয় নেত্রী তনিমা সিদ্দিক বলেন, এ ঘটনা দেখে মনে হয় আমরা সংবিধান ভুলে যাচ্ছি। আমরা যে ধর্মান্ধ ব্যক্তিদের কবলে পড়ে যাচ্ছি তার জন্য সরকার, প্রশাসনের নিশ্চয়ই দায় রয়েছে। আমাদের দেশের সংখ্যালঘুরাও এ দেশের নাগরিক। সংবিধানে রাষ্ট্র কাউকে বৈষম্য করবে না বলে যে অঙ্গিকার করেছে তা আমরা রক্ষা করতে পারছি না। ৩০ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষ নির্যাতিত মা-বোনদের মধ্যে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান-মুসলিম রয়েছে। সকল ধর্মের মানুষের সম্মিলিত রক্তের উপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা বলেও দাবি করেন তিনি।
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পারভেজ হাসেম বলেন, এই ধরনের ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে আমরা দেখি তদন্তের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা দেখানো হয়। কিন্তু আমরা জানি এই ঘটনায় জড়িত সবাই চিহ্নিত। বরং আমরা দেখেছি এ ঘটনায় ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’ করা হয়েছে। যেমন ঝুমন দাসকে গ্রেফতারের মাধ্যমে এই হামলাকে জাস্টিফাইড করা হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। এছাড়া লুট হওয়া মালামালেরও কোনো হদিস নেই বলে অভিযোগ করেন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের এই নেতা।
এএলআরডি’র উপ-নির্বাহী পরিচালক রওশন জাহান মনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছি। কিন্তু এমনি সময় যদি কেউ মনে করেন এই দেশ থেকে পালিয়ে যেতে হবে তাহলে এই স্বাধীনতার কোনো অর্থ হয় না। এই হামলার উস্কানিদাতা ও হামলাকারীরা চিহ্নিত বলেও মনে করেন তিনি। কেবল হিন্দু সম্প্রদায় আক্রান্ত হয়েছে মনে করলে হবে না, এখানে অসাম্প্রদায়িক চেতনাও আক্রান্ত হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী এ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, গত একযুগ ধরে এই ধরনের যতগুলো ঘটনা ঘটেছে তার কোনোটিরই বিচার হয়নি। বিশেষ করে ২০০১- ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। তাদের কোনোটির বিচার হয়নি। একটা বিচারহীনতার সংস্কৃতি এদেশে চেপে বসেছে। এই সরকারের কাছ থেকে সুবিচার পাওয়া দুরূহ বলে মনে করেন এই রাজনীতিবিদ। তাছাড়া সরকারের জিরো টলারেন্স এখন শতভাগ টলারেন্স হয়ে দাঁড়িয়েছে বলেও মনে করেন।
প্রবীণ সাংবাদিক সেলিম সামাদ বলেন, আমরা এধরনের অনেক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। সব ঘটনারই প্যাটার্নটা (ধরন) একই। আমি যখন ১৯৮০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে কাউখালীতে পাহাড়িদের উপর সেনাবাহিনী কর্তৃক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল। সেই ঘটনার ধরনও একই। অন্যদিকে রামুর ঘটনায়ও আওয়ামীলীগ, বিএনপি, জামাতসহ অনেকেই একই মঞ্চে ছিল কিন্তু কারোরই বিচার হয়নি। এইসব সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলোর তদন্ত রিপোর্ট উন্মুক্ত করার জন্য সরকারকে চাপ সৃষ্টির জন্য সব পক্ষকে আহ্বানও জানান তিনি।
সভাপতির বক্তব্যে নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন বলেন, এক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তার যখন বিচার হয় না তখন আরেকটি ঘটনা সংঘটনে এটি মদদ যোগায়। কাজেই প্রত্যেকটি ঘটনার বিচার করতে হবে। বর্তমান সরকার তার মেনিফেস্টোতে বলেছিলেন ’সংখ্যালঘু কমিশন’ করবে। কিন্তু সেটা করে নাই। সরকারের সংখ্যালঘু ‘প্রটেকশন মেকানিজম’ নেই দাবি করে তিনি আরো বলেন, আমরা মনস্তাত্ত্বিকভাবেই একধরনের ভাগ করার প্রবণতা গজিয়ে রেখেছি। আমরা কেবল বলি মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদ হয়েছে। কিন্তু সেই ৩০ লক্ষের মধ্যে কে কে আছে সেটা আমরা বলি না যার জন্য এটা খুব হালকা হয়ে যায় বলেও মনে করেন তিনি। এ ঘটনাগুলোর একটি ‘গণশুনানি’ আয়োজনের জন্য সবাইকে উদ্যোগী হওয়ারও আহ্বান জানান নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক। এছাড়া মসজিদের মাইক কেবল আযান দেয়া এবং অন্যান্য ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত হবে এবং কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটানোর জন্য লোক জড়ো করা হবে না বলে নির্দেশনা প্রদানের জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়কে আহ্বানও জানান তিনি।
আইইডির সহ-সমন্বয়কারী হরেন্দ্র নাথ সিং বলেন, পরিদর্শনের সময় দেখলাম তবলা, ঢোল সহ অনেক সাংস্কৃতিক বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর করা হয়েছে। বাংলাদেশের যে স্বতন্ত্র অসাম্প্রদায়িক রূপ সেটার উপর সাম্প্রদায়িক শক্তির যে তান্ডব এই হামলা না দেখলে বুঝা যাবে না। অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সমুন্নত রাখার জন্য সাম্প্রদায়িক এই শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকারও আহ্বানও জানান তিনি।
গত ২৬-২৭ মার্চ, ২০২১ নাগরিক প্রতিনিধিদল সুনামগঞ্জের শাল্লায় সরেজমিনে পরিদর্শনে যান। উক্ত নাগরিক প্রতিনিধি দলে ছিলেন সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস, নাগরিক উদ্যোগের নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন ও জাসদের কেন্দ্রীয় নেত্রী তনিমা সিদ্দিকী, প্রবীণ কৃষকনেতা অমর চাঁদ দাস, উন্নয়ন সংস্থা এএলআরডি’র সহকারী প্রকল্প সমন্বয়ক এ্যাডভোকেট রফিক আহমেদ সিরাজী, আইইডির সহ-সমন্বয়কারী হরেন্দ্র নাথ সিং, আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক পারভেজ হাসেমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা। ঘটনা সংঘটনের দশদিন পর উক্ত সরেজমিন পরিদর্শনে প্রত্যক্ষ ঘটনা তুলে ধরতেই প্রতিনিধিদল এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেন।
উক্ত সংবাদ সম্মেলন থেকে প্রতিনিধিদল আট দফা সুপারিশ তুলে ধরেন। সুপারিশগুলো হলো-
১. নোয়াগাঁও গ্রামের লোকজনের বিশ্বাস ও আস্থায় চিড় ধরেছে। তাদের সেই বিশ্বাস ও মনোবল ফিরিয়ে দিতে হবে। সেই লক্ষ্যে প্রশাসনের উচিত হিন্দু-মুসলিম উভয় স¤প্রদায়কে ডেকে একটি সংলাপের ব্যবস্থা করা। পারস্পরিক আস্থা-সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
২. কৃষিনির্ভর গ্রামের লোকজনের জীবন ও জীবিকা নিশ্চিত করা। কৃষকরা যাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বোরো ধান গোলায় তুলতে পারে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীকে সেই নিরাপত্তা দিতে হবে।
৩. ঝুমন দাশ আপনের মা নিভারানী দাশের মায়ের মামলাটি এজাহার আকারে গ্রহণ করে, সে মোতাবেক আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই সাথে ফেইসবুকসহ নানা মাধ্যম পরীক্ষা করে ঘটনার সাথে জড়িত ও উস্কানীদাতাদের গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
৪. যে সকল শিক্ষার্থীদের বই খাতা ধ্বংস হয়েছে তাদের শিক্ষার সামগ্রী সংগ্রহের জন্য নগদ আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। শিশুদের খাবার সংগ্রহের জন্যও আর্থিক সহায়তা দিতে হবে। এস.এস.সি পরীক্ষার্থীরা যাতে নির্বিঘ্নে পরীক্ষা দিতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. নারী ও শিশুদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যে সকল নারী ও শিশুরা এখনও ট্রমার মধ্যে আছে তাদের জন্য প্রয়োজনীয় কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করতে হবে।
৬. আক্রান্তদের যথাযথ ক্ষতি নিরূপণ করে সেই মোতাবেক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যে সকল বাড়িঘর আক্রান্ত হয়েছে তা পুন:নির্মাণ করে দিতে হবে।
৭. শাল্লা থানার দূরত্ব এ এলাকা হতে বেশ দূরে ও দূর্গম হওয়ায় এখানে একটি স্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করতে হবে। সেই সাথে মামলায় যাতে নিরীহ মানুষ হয়রানীর শিকার না হয়, ‘নানা ধরনের বানিজ্য’ না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
৮. হিন্দু পল্লী আক্রমণ ও লুটপাটের মূল হোতাদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। সেই সাথে মাঠ প্রশাসনের যে সকল কর্মকর্তা এ ঘটনা রুখতে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।