নিপন ত্রিপুরা
টাঙ্গাইলের মধুপুর। মধুপুরের বনকে মান্দি ভাষায় বলে ‘আবিমা’, অর্থাৎ মাটির মা। পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাগাছাসের সৌজন্যে নানান সময়ে সাংগঠনিক সফরে মধুপুরে বেশ কয়েকবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। তাতে মধুপুরের মান্দিদের জীবন, লড়াই সংগ্রামের কথা, সুখ-দুঃখগুলো কিছুটা হলেও জানার সুযোগটা হয়েছে।
মান্দিদের দৃষ্টিতে বনভূমি পবিত্র বস্তু। বন তাদের জীবনের অংশ বা তার চেয়েও বেশি কিছু। তারা বিশ্বাস করে, বন ধ্বংস হলে তারাও ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাবে। মান্দিদের কাছে বন ও মানুষ একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। বন শুধু অর্থনৈতিক অবলম্বন নয়, তাদের বেঁচে থাকার শ্বাস-প্রশ্বাসও বটে। কিন্তু মান্দিদের মধুপুরের এ বনাঞ্চলকে ধবংস করে দিতে, দখলে নিতে, মান্দিদের উচ্ছেদ করতে রাষ্ট্র কখনো ইকোপার্কের নামে জমি দখল, কখনো ন্যাশনাল পার্ক, রাবার প্রকল্প, সামাজিক বনায়নসহ আরও কত প্রকল্প বাস্তবায়ন করেই যাচ্ছে। ২০১৬ সালে ঘোষিত রিজার্ভ ফরেস্টের নামে ৯ হাজার ১৪৫ একরের মধ্যে আদিবাসীদের গ্রাম রয়েছে ১৪টির বেশি। সরকার এ বিষয়ে আদিবাসীদের সাথে আলোচনা করেনি। গত বছর বনবিভাগ কর্তৃক বাসন্তী রেমার ১০০ একরের উপর লাগানো কলাগাছ কেটে ফেলার ঘটনাও দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছিল। পরে বনবিভাগ চাপে পরে বাসন্তী রেমাকে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়েছিল। তারপরও বনবিভাগ আদিবাসীদের বন দখলের অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চূড়ান্ত রিজার্ভ ঘোষণার পর কী পরিস্থিতি হবে বনের মান্দিদের, কোচ বর্মণ এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। সবার মধ্যে একটা আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ রিজার্ভ ফরেস্ট হলে আমরা কোথায় যাব? কী করব? ইত্যাদি ইত্যাদি মনের অপ্রকাশিত নানান ধরনের শঙ্কা। বিপরীতে দেখেছি, এ মধুপুরের তারুণ্যের শক্তির একটি উত্থান। তারা দলে দলে ভাগ হয়ে এ রিজার্ভ ফরেস্টের বিরুদ্ধে একটা শক্তিশালী জনমত গড়ে তোলে এবং জনগণকে সংগঠিত করে গণআন্দোলনের দিকে যাওয়ার জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছে। তারা আর আদুরি দামাং এর তালে চুয়ের গ¬াস হাতে নেচে গেয়ে জীবনটাকে কোনভাবে আটকে রাখতে বিশ্বাসী নয়, তারা এখন আদুরি দামাং এর তালে চুয়ের গ¬াস হাতে নিয়েও নাচতে নাচতে, গাইতে গাইতে অধিকার ছিনিয়ে নিতে রক্ত বলিদান মন্ত্রের মিছিলের উৎসুক জনতা হতে চায়। সদা জাগ্রত হয়ে বীরের মতন অধিকার, সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে চায়। তারা আর সাধারণ জীবন যাপনে বিশ্বাসী নয়, তারা এখন পীরেন স্লান, চলেশ রিছিলের মিছিলের সৈনিক হতে চায়। মধুপুরের মান্দি তারুণ্য এখন যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অগ্নিস্লোগান হতে চায়।
বন দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের ইতিহাস
টাঙ্গাইলের মধুপুর অঞ্চলে ৪৭৮ বর্গ কিলোমিটারব্যাপী শালবনে কয়েকশ বছর ধরে প্রায় আড়াই হাজার গারো ও কোচ আদিবাসীর বসবাস। ২০০০ সালে বন বিভাগ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সেখানে ইকো পার্ক প্রকল্প করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী বনের মাঝখানে হবে ১০টি পিকনিক স্পট এবং ছয়টি ব্যারাক। বিশাল জায়গা জুড়ে দেয়াল তুলে ঘিরে ফেলা হবে পুরো পার্ক এলাকা। তবে সে সময় এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বন কর্তৃপক্ষ বনের স্থানীয় অধিবাসী আদিবাসীদের সঙ্গে কোনো আলোচনাই করেনি। বন থেকে উচ্ছেদ হওয়ার আশঙ্কায় আদিবাসীরা ইকো পার্ক প্রকল্প প্রতিরোধের জন্য দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন।
২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি বনরক্ষী ও পুলিশ বাহিনী গুলি চালালে আদিবাসী নেতা পিরেন স্নাল মৃত্যুবরণ করেন। গুলিতে আহত হন ৩৪ জন নারী-পুরুষ। এরপর সরকার মধুপুর ইকো পার্ক প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করে। তবে সেই সময় আন্দোলনে জড়িত আদিবাসী নারী-পুরুষের বিরুদ্ধে বন আইনে শত শত মামলা দায়ের করা হয়। সেই মামলাগুলো এখনো চলছে।
মধুপুরের এমন ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা’র সংখ্যা আনুমানিক প্রায় পাঁচ হাজার। বছরের পর বছর ধরে এসব মামলার দুর্ভোগে এখন তাদের নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম। শুধু তাই-ই নয়, ১০ থেকে ১৫ বছরের পুরনো আরো অনেক বন মামলা রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা, স্কুলশিক্ষক, ছাত্র, কৃষিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার আদিবাসীর বিরুদ্ধে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে জেলা সদরে এসে এসব মামলার খরচ চালাতে গিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হতে বসেছেন। বন মামলায় কারাভোগ করে জামিনে মুক্তি পেয়ে নতুন করে মামলায় পড়েছেন- এমন নজিরও রয়েছে। এভাবে মামলার মরণ ফাঁদে ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে মধুপুরের আদিবাসী জীবন।
চলেশ রিছিলের অধ্যায়
২০০৭ সাল!!! বাংলাদেশের দুই বড় রাজনৈতিক দলের গদি নিয়ে টানাটানিতে ক্ষমতা কেড়ে নেয় সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকার। সরকার মুখে ইকোপার্ক বন্ধ ঘোষণা করলেও প্রকল্পের কার্যক্রম তখনও চলছিল। এর প্রতিবাদে মধুপুরের আদিবাসীরা চলেশ রিছিলের নেতৃত্বে আবার আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলনকে দমিয়ে রাখার জন্য সরকারি পেটোয়াবাহিনীও আদাজল খেয়ে নেমে পরে। হামলা-মামলা থেকে শুরু করে ধরপাকড় সব কিছু করতেও তারা কার্পণ্য বোধ করলো না।
ঘটনার দিন, ২০০৭ সালের ১৮ মার্চ চলেশ রিছিল ময়মনসিংহের একটি বিয়ের অনুষ্ঠান হতে ভাড়া করা প্রাইভেট কার যোগে বাড়ি ফিরছিলেন। পথে মুক্তাগাছা থানার কালীবাড়ি বাজার বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছালে প্রাইভেটকারটিকে থামিয়ে যৌথবাহিনীর সদস্যরা রিছিলসহ সহযাত্রী প্রতাপ জাম্বিল, পীরেন সিমসাং ও তুহিন হাদিমাকে আটক করে। এদের মধ্যে পীরেন সিমসাং ও তুহিন হাদিমা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও প্রতাপ জাম্বিল ও চলেশ রিছিলকে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে চালানো হয় নিষ্ঠুর নির্যাতন। তার ভগ্নিপতি প্রতাপ জাম্বিলের মতে চলেশ রিছিলকে জানালার গ্রীলে ঝুলিয়ে ৯ জন প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য অমানবিকভাবে অত্যাচার করে। তার ডান হাতের তিন আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা হয়। তার সারা শরীরে প্রচন্ড আঘাত করা হয়। এক পর্যায়ে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে বাধ্য হন। রাতে তার রক্তাক্ত জখমে জর্জরিত মৃতদেহ থানা স্বাস্থ্য কমপ্লে¬ক্সে ফেলে রাখা হয়। ঘটনার পর পুলিশ একটি গল্প বানিয়ে বলে, দৌড়ানোর সময় পড়ে গিয়ে চলেশ জ্ঞান হারায়। এ বানানো গল্প কেউ বিশ্বাস করেনি (প্রথম আলো,২২শে মার্চ ২০০৭)। অন্যদিকে চলেশের মৃত্যুর কারণ ‘হার্ট অ্যাটাক’ বলে দাবি করেছিল যৌথবাহিনী। এমন অসংলগ্ন বক্তব্য ছিল পুলিশ যৌথবাহিনীর।
জাতিসংঘ, এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ হত্যাকান্ড নিয়ে রিপোর্ট করেছিল। তিনটি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্ল¬াস্ট), অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম এন্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) যৌথভাবে অনুসন্ধান করে। অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতে সংবাদ সম্মেলন করে তারা জানিয়েছিলেন, “চলেশ রিছিলের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ও রক্তের দাগ ছিলো। দুই হাতের হাঁড় ও সব আঙ্গুল ভাঙা ছিলো। হাত-পায়ের বেশ কয়েকটি নখ উপরানো ছিলো।” দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত ঘটনার তালিকার টপ টেনে জায়গা নিয়েছিল ‘চলেশ হত্যাকান্ড’। মানবাধিকার লঙ্ঘনের শেষ সীমা অতিক্রম করার জলজ্যান্ত উদাহরণ এটি। এ হত্যাকান্ড নিয়ে কোন ধরনের বিচার বিভাগীয় তদন্তও হয়নি আর হবেও না। পরিবার ও তার আত্মীয়-স্বজনও মনে করেন এ নষ্ট রাষ্ট্রটার কাছেও বিচার চাওয়া না চাওয়ারই সমান। আমার মনে আছে, বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী ধানমন্ডীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে ২০০৪ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে মধুপুরের ইকোপার্ক বিরোধী সমাবেশে পুলিশ ও বনরক্ষীদের গুলিতে নিহত হওয়া পীরেন স্লানের স্ত্রী রিতা নকরেকের সাথে দেখা করে ক্ষমতায় এলে তিনি সমতলের আদিবাসীদের ভূমি মালিকানা ফিরিয়ে দেয়ার অঙ্গীকার এবং সে সময়ের বিএনপি সরকারকেও তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন। টানা ১২ বছর শাসন করেছেন, সমতলের আদিবাসীরা ভূমির মালিকানা ফিরে পেয়েছি কি? মধুপুর থেকে উল্টো এখন আরো বেশী পরিমাণে ভূমি বেদখল হচ্ছে। পীরেন স্লান ও চলেশ রিছিলেকে সেসময়ের রাষ্ট্রীয় হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচার নামক বস্তুকে তারাও ক্ষমতা হারানোর ভয়ে সিকায় তুলে রেখেছে। কথা কেবল কথায় থেকে গেলো। কিন্তু মধুপুরতো এখন ১৩ বছরে অনেক বদলে গিয়েছে, মান্দিরা মধুপুরে দিনকে দিন ক্রমাগত সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছে আর রাষ্ট্র তার আইন, আদালত নিয়ে নাকের তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। ২০১৯ সালে আমি ৫০ বছরের উর্ধ্ব এক বয়স্ককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ইকোপার্ক তো হবে, সাথে রিজার্ভ ফরেস্টও হবে বলে শোনা যাচ্ছে। বাতিল হাওয়ার কোন সুযোগ আছে কিনা? তিনি বললেন, যেভাবে ২০০৪ সাল থেকে এ রাষ্ট্র আগ্রাসন শুরু করেছিল তা থামার কোন লক্ষণ দেখছি না। তিনি মনে করেন, সরকার যেহেতু এ উদ্যোগটা নিয়েছে সেহেতু হবেই। আমাদের ভাগ্যে কোন পরিবর্তন নাই, এভাবেই বোধয় আমাদের মারা যেতে হবে। আমাদের পক্ষে কেউ নাই। তাই আর আক্ষেপও নাই। আক্ষেপ তো এ রাষ্ট্রের থাকার কথা, লজ্জা তো এ রাষ্ট্রের থাকার কথা, সরকারের থাকার কথা। সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে জনসেবার বদলে জনগণকে উচ্ছেদ করছে, তাদের বসতভিটা দখল করছে। সে আক্ষেপ কি এ রাষ্ট্রের শাসক, শোষক, সরকারের হবে?
১৪তম শহীদ দিবসে তোমাকে লাল সালাম কমরেড। যুগ যুগ জিও দেশের আদিবাসীদের মুক্তি সংগ্রামে লড়াইয়ের প্রেরণা হয়ে।
লেখক: নিপন ত্রিপুরা, সাংগঠনিক সম্পাদক, পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ।