সুদীপ্ত চাকমা
এক
সামনের দাঁত দুটি ভাঙা, চোখে মুখে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। তবুও প্রবল আত্মসম্মানবোধ ফুটে ওঠে তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে। আশির দশকে কল্পরঞ্জন চাকমা শৈশবে বাবার হাত ধরে এসেছিলেন সাজেকে। ছোটবেলার বিভৎস অভিজ্ঞতা এখনো জীবন্ত। পূর্বের সচ্ছল অবস্থার কথা মনে পড়লে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন মাঝে মাঝে।
কল্পরঞ্জন চাকমার বাপ-দাদাদের ভিটেমাটি ছিলো দিঘীনালা উপজেলার মেরুং ইউনিয়নে। আশির দশকে যখন সেনাবাহিনী কর্তৃক সেটেলার বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামে জোরপূর্বক বসতিদান করা হচ্ছিলো তখন তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে কল্পরঞ্জন চাকমার মত অনেকের ওপর। সেনানির্যাতন এবং সেটেলার বাঙালিদের সাম্প্রদায়িক হামলার কারণে পাকা ধানক্ষেত, ঘড়বাড়ি, গবাদি পশু, নিজ ভিটেমাটি সবকিছু ছেড়ে শুধুমাত্র প্রাণ রক্ষার তাগিদে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা। বাধ্য হয়েই তাদেরকে আশ্রয় নিতে হয়েছিলো সাজেক ইউনিয়নের গহীন অরণ্যে। সারাটা জীবন দু’বেলা খাওয়ার জন্য গহীন জঙ্গল সাফ করে সংগ্রাম করতে হয়েছে তাদেরকে। চিকিৎসার অভাবে জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে পারেনি তার দুই ছেলে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং আর্থিক দৈন্যতার কারণে পড়াশোনা করাতে পারেননি বাকি ছেলেমেয়েদের।
দুই
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে কল্পরঞ্জন চাকমাদের মত মানুষদেরকে চিহ্নিত করা হয়েছে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে। নিজ ভিটেমাটি ছেড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গা থেকে আশ্রয় নিয়েছিলেন সাজেকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হাজার হাজার মানুষের আশার সঞ্চার করলেও আজ পর্যন্ত সাজেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তাদের মত অনেকেই।
তিন
নিরাপত্তা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে সাজেক রুইলুই পর্যটন উদ্বোধন করা হয়েছিলো ২০১৪ সালে। পর্যটনের সুবাদে পাকা রাস্তা হয়েছে দিঘীনালা থেকে রুইলুই পর্যন্ত। ২০২১ সাল নাগাদ পর্যটনের প্রসার বেড়ে যাওয়ায় পর্যটকের সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনই বৃদ্ধি পেয়েছে অপরিকল্পিত রিসোর্ট এবং কটেজের সংখ্যা। প্রশাসনের তদারকির অভাব এবং অব্যবস্থাপনার কারণে দূষিত হয়ে পড়েছে একসময়কার পরিচ্ছন্ন রুইলুই এবং কংলাক পাড়া।
রাস্তাঘাট ও পর্যটনের কারণে যাতায়াত ব্যবস্থার সুবিধা এবং ব্যবসা বাণিজ্যের দুয়ার খুলেছে ঠিকই। কিন্তু তাতেও কি উন্নতি হয়েছে সাজেকবাসীর জীবন ব্যবস্থার? একনজরে জেনে নেওয়া যাক বর্তমান সাজেকবাসীর অর্থনৈতিক এবং সামাজিক চিত্রটি।
চার
সাজেক পর্যটন স্থাপন করা হয়েছে দুটি গ্রামে, রুইলুই এবং কংলাক পাড়ায়। যেখানে ত্রিপুরা এবং লুসাই সম্প্রদায় পাশাপাশি অবস্থান করছে যুগ যুগ ধরে। পর্যটন আসার আগে তাদের প্রধান জীবিকা ছিলো জুম চাষ। কিন্তু বর্তমানে পর্যটনকে কেন্দ্র করে ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন অনেকেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমির মালিকানা হচ্ছে প্রথাগত মালিকানা যা ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতেও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। সাজেক পর্যটনের স্থায়ী বাসিন্দাদের সরকারি বন্দোবস্তি না থাকায় সেই সুযোগটা গ্রহণ করেছে মৌজা হেডম্যান, সেনাবাহিনী এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। স্থানীয় লুসাই এবং ত্রিপুরাদের ভূমিতে অবৈধভাবে স্থাপন করা হয়েছে সেনাবাহিনীর বিলাসবহুল রিসোর্ট। স্বার্থবাদী মৌজা হেডম্যানরা অবৈধভাবে জমি বিক্রি করেছে বড় বড় ব্যবসায়ী এবং সরকারি আমলাদের কাছে। যেসব জায়গায় গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত সব রিসোর্ট এবং দোকানপাট। অনেক ক্ষেত্রে ত্রিপুরা পরিবারগুলোকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে জমিগুলো বিক্রি করেছে মৌজা হেডম্যান।
উল্লেখ্য যে, স্থানীয় লুসাইদের মাঝে রাজনৈতিক সচেতনতা না থাকায় এবং ভারতের মিজোরাম রাজ্যের মিজোদের সাথে তাদের সাংস্কৃতিক মিল থাকায় অধিকাংশ লুসাই পরিবার ভূমিগুলো বিক্রি করে দেশান্তরিত হয়েছে মিজোরাম রাজ্যে। যেখানে পর্যটনের পূর্বে রুইলুই এবং কংলাক পাড়ায় লুসাই পরিবার ছিলো ৬৫ পরিবারের অধিক সেখানে বর্তমানে লুসাই পরিবারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০-১৫ পরিবার। মোট কথা, সাজেক পর্যটন গড়ে উঠেছে ত্রিপুরা এবং লুসাইদের গোটা গ্রাম জুড়ে। প্রতিদিন শত শত পর্যটক ভ্রমণের জন্য আসছে আনন্দ-ফূর্তি করে চলে যাচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের গ্রামে যে জীবন গড়ে উঠেছে সেটা উচ্চবিলাসী এবং ব্যয়বহুল এক জীবন। সে জীবনের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য এবং টিকে থাকার জন্য নিজের জমি বিক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দারা। কারণ বর্তমান পরিবেশে তাদের জন্য আর জুম চাষ করে টিকে থাকার উপাই নেই। ছোটখাটো ব্যবসা আর পরিবারের ভরণপোষণ করার জন্য বাধ্য হয়েই নিজের বাস্তুভিটা ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে তারা। তাছাড়াও নিজস্ব ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে জীবনধারণ করার জন্য যে সামাজিক পরিবেশ প্রয়োজন, সেই পরিবেশ এখন অনেকটা ধ্বংসের পথে। স্থানীয় লুসাই এবং ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের জীবনে প্রবেশ করেছে উচ্চাভিলাষী উচ্ছৃঙ্খল পরিবেশ এবং বিজাতীয় সংস্কৃতি। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে এবং যুবকদের চেতনা ও মানসিকতায় প্রবেশ করেছে উচ্চাভিলাষী ও উচ্ছৃঙ্খল মানসিকতা। যার কারণে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি লোপ পেতে শুরু করেছে। বর্তমানেও যেসব ত্রিপুরা এবং লুসাই সম্প্রদায় পর্যটন কেন্দ্রে টিকে রয়েছে তারাও নতুন করে ঘর নির্মাণ করতে পারছে না নিরাপত্তা বাহিনীর বাধার কারণে। ফলে দেশান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছেন লুসাইরা এবং জমি বিক্রি করে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন ত্রিপুরারা।
পাঁচ
সাজেক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন। দূর পাহাড় থেকে রাতের অন্ধকারে ঝলমলে পর্যটন কেন্দ্রটাকে হীরকখচিত পাহাড় মনে হলেও অন্ধকারে রয়েছে এখনো অধিকাংশ সাজেকবাসীর জীবন। সাজেক ইউনিয়ন শিক্ষা এবং চিকিৎসায় শতগুণ পিছিয়ে পড়া একটি ইউনিয়ন। এখনো পর্যন্ত শিক্ষিত ব্যক্তি এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা হাতেগোনা। প্রতিবছরই ম্যালেরিয়া, হাম এবং নানা অসুখে মৃত্যু হচ্ছে অসংখ্য মা-শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের। জুৃমচাষীরা পাচ্ছে না উৎপাদিত শস্য এবং কাঁচামালের ন্যায্যমূল্য।
ছয়
সেনাবাহিনীর ২০ ইসিবির তত্ত্বাবধানে শিজকছড়া থেকে উদয়পুর বর্ডার পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করছে বাংলাদেশ সরকার। যেখানে একটি ইসিবি ক্যাম্প এবং স্থলবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা মাফিক কাজ চালাচ্ছে সরকার। ১৩ কিলোমাটার সড়ক নির্মাণের জন্য ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে চাকমাসহ কয়েকশত জুম্ম পরিবার। তাদের ঘরবাড়ি এবং সেগুনবাগিচা ধ্বংস করে সড়ক নির্মাণের কাজ চালানো হচ্ছে। এছাড়া সেনাবাহিনী পর্যটনের সুবিধার্থে শিজকছড়ায় একটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। এই বাঁধ নির্মাণ করা হলে বাঁধের পানিতে আড়াই শতাধিক জুম্ম পরিবার নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা স্থানীয় সরকার পরিষদের কাছে একাধিকবার ভূমি দখলের অভিযোগ এবং ক্ষতিপূরণের দাবি জানালেও নীরব ভূমিকা পালন করছে সরকার। যার কারণে উচ্ছেদ আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে অনেকেই। তার মধ্যে ঘনীভূত হচ্ছে সাজেকে সেটেলার বাঙালি পুনর্বাসনের আশঙ্কাও।
সাত
আশির দশকে নিরাপত্তাবাহিনী এবং সেটেলার বাঙালিদের কর্তৃক বর্বর গণহত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হামলার কারণে সাজেকের গহীণ অরণ্যে আশ্রয় মিলেছিলো হাজারো মানুষের। নিজ ভূমি হারিয়ে সীমান্ত এলাকায় বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বনটুকুও এখন বেদখল করা হচ্ছে বা বেদখলের মুখে রয়েছ। সড়ক ও জনপদের কারণে বনভূমি উজাড় হবার সম্ভাবনা রয়েছে। বনভূমি উজাড় হলে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হবে বন্যপ্রাণী এবং বনজসম্পদ। পানযোগ্য জলের অভাবে বসবাস অযোগ্য হবে পশ্চাৎপদ পাহাড়ি জনপদগুলো। যেটা সরকারের ভাষ্যমতে উন্নয়ন সেটা আমাদের চোখে জবরদখল এবং ধ্বংসাত্মক খেলা। বরাবরই উন্নয়নের ফল ভোগ করে সমাজের উচ্চশ্রেণির মানুষ এবং সামরিক ও বেসামরিক আমলারা। উন্নয়নের সুবাতাস লাগে না সমাজের দরিদ্রশ্রেণির মানুষদের জানালায়।