হিল ভয়েস, ১১ মার্চ ২০২১, ঢাকা: আদিবাসী নারীরা দেশের ‘ভালনারেবল’ গ্রুপের মধ্যেও আরো ‘ভালনারেবল’। যার কারণে লাকিংমে চাকমা’র ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা খুব সহজ বলে ধরে নেয়ার চিন্তা করাটা স্বাভাবিক বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জোবাইদা নাসরীণ কণা। আদিবাসীদের স্বতন্ত্র নিউজ পোর্টাল আইপিনিউজ এর আয়োজনে গত ৯ মার্চ ২০২১ চলমান আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে কেন্দ্র করে আলোচিত লাকিংমে চাকমা’র ঘটনার বিচারের দাবিতে ও আদিবাসী নারীদের সামগ্রিক বিষয়ে একটি অনলাইন আলোচনার আয়োজন করা হয়। উক্ত অনলাইন আলোচনায় জোবাইদা নাসরীণ এই কথা গুলো বলেন।
আইপিনিউজ এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আন্তোনি রেমা’র পরিচালনায় উক্ত আলোচনায় অন্যান্যদের মধ্যে অংশ নেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারহা তানজিম তিতিল, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য মেইনথেইন প্রমিলা, সমকালের সাংবাদিক জাহিদুর রহমান এবং বাংলাদেশ আদিবাসী যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য চন্দ্রা ত্রিপুরা প্রমুখ।
আলোচনায় অংশ নিয়ে জোবাইদা নাসরীণ আরো বলেন, লাকিংমে এবং তাঁর বাবা-মা সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয়গতভাবে ক্ষমতাশালী নয়। আমি গুনে দেখলাম লাকিংমে’র প্রান্তিকতা সাতটি বা আটটি মাত্রায়। কাজেই যে কোনো কারণেই লাকিংমে’কে ধর্ষণ করা সহজ, নিপীড়ন করা সহজ, ধমান্তরিত করা সহজ। তিনি লাকিংমে চাকমা’র ঘটনার ন্যায়বিচারও দাবি করেন।
তিনি আরো বলেন, দেশের প্রচলিত নারীবাদও অনেক সময় জাতীয়তাবাদের সীমা অতিক্রম করতে পারে না। কল্পনা চাকমা’র অপহরণের ঘটনায়ই প্রথম বাংলাদেশের নারী আন্দোলন আদিবাসী নারীর দিকে চোখ ফেরায় বলেও মনে করেন তিনি। অন্যদিকে আদিবাসী নারীদের আন্দোলন ‘দাতাগোষ্ঠী’ নির্ভর না থেকে জনমানুষের আন্দোলনের ‘তরিকা’ হিসাবে দেখারও আহ্বান জানান এই শিক্ষক। নারী আন্দোলন জাতিগত সীমার মধ্যে বন্দি না থেকে সব স্তর থেকে নারী নিপীড়নের প্রতিবাদ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে চন্দ্রা ত্রিপুরা বলেন, আদিবাসী নারীরা নানা ধরণের সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার হন। তখন মনে হয় কেবল নারী হিসাবে নই, একজন আদিবাসী হিসাবেও আমাদেরকে এসবের শিকার হতে হয়। কিন্তু এই ঘটনাগুলোর কোনোটির ন্যায়বিচার আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রের কাছ থেকে পেয়েছে বলে আমরা এখনো বলতে পারি না। এ কারণে রাষ্ট্রের সদিচ্ছার জায়গাটা যথেষ্ট প্রশ্নের উদ্রেক করে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে আমাদের সমাজে নারী নিপীড়ন ও সহিংসতা ‘ছোঁয়াছে’ রোগের মত ছড়িয়ে পড়ছে বলেও মন্তব্য করেন এই আদিবাসী নারী নেত্রী।
লাকিংমে চাকমা’র ঘটনার আদ্যোপান্ত নিয়ে রিপোর্টিং এর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সমকালের সাংবাদিক জাহিদুর রহমান বলেন, লাকিংমে’র সাথে যেটা করা হয়েছে সেটা বর্বরতার সামিল। আইন-শৃংখলা বাহিনীর চরম অবহেলা, তদন্তে পক্ষপাতিত্ব ও হত্যা কিংবা আত্মহত্যার প্ররোচনা করা এসব দেখে মনে হয়েছে লাকিংমে চাকমা’র ঘটনা আমাদের কাছে একটি নারী নিপীড়নের জলন্ত উদাহরণ। লাকিংমে চাকমাদের পারিবারিক করুণ অবস্থা। সেই প্রান্তিক অবস্থা থেকে তাঁর বাবা টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি (এখন কারাগারে) প্রদীপ এর কাছে যখন মামলা দিতে গেলেন তখন তাকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি ধামকি দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এ ঘটনার ধারাবাহিক রিপোর্টিং এর অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমি জানতে পারলাম এদেশে আদিবাসীদেরকে কীভাবে দেখা হয়।
আলোচনায় অংশ নিয়ে আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য মেইনথেইন প্রমিলা বলেন, লাকিংমে চাকমা’র ঘটনার চেয়ে বর্বর, বিভৎস আর কিছু হতে পারে কিনা আমি জানি না। লাকিংমে চাকমা’র সাথে এত রকমের ঘটনা ঘটার পরও এই ঘটনার হোতা নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচারও দাবি করেন।
বিউটি পার্লারে কর্মরত আদিবাসী নারীরা বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হন দাবি করে তিনি আরো বলেন, তাদেরকে নির্দিষ্ট কর্মঘন্টার পরও কাজ করতে বাধ্য করা হয়। তাছাড়া ছুটি না দেয়া এবং পারিশ্রমিক না দেয়ার ব্যাপারটিও যুক্ত। ছুটি থেকে বঞ্চিত করার কারণে এই নারীদেরকে বাধ্য হয়ে গর্ভপাত করতে হয় বলে দাবি করেন তিনি। ছুটি নিলে যেহেতু বেতন কর্তন করা হয় তার জন্য তারা এটি করতে বাধ্য হন। আদিবাসী নারীদের সাথে এধরনের নির্মম ঘটনাগুলো সামনে আসে না বলেও মনে করেন এই নারী নেত্রী।
আলোচনায় অংশ নিয়ে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহা তানজিম তিতিল লাকিংমে চাকমা’র ঘটনায় সরাসরি যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, খুব স্পর্শকাতর ও মর্মান্তিক একটা ঘটনা লাকিংমে’র সাথে ঘটে গেছে। তাঁর ঘটনার আদ্যোপান্ত আলোচনা করাটা মর্মান্তিক এবং সংগ্রামের বলেও মনে করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, সভা সমাজ ও রাষ্ট্রের মানুষ হিসাবে একজন মানুষের সাথে অন্যায় করলে সেটার শাস্তি হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের প্রয়োজনে যে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো আমরা নির্মাণ করেছি সেগুলো তা করেনি। সেই সংস্থাগুলোকেই এই লাকিংমে’র ন্যায়বিচারে ভূমিকা নিতে হবে। এই সংস্থাগুলো যাতে আরো ‘সচল’ থাকে তার জন্য আমাদেরকে কথা বলতে হবে। নানা ‘শংকা’র মধ্যেও আইন প্রয়োগের মাধ্যমে আইনরক্ষাকারী বাহিনী এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আশাবাদও ব্যক্ত করেন এই শিক্ষক।