হিল ভয়েস, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক:
বস্তুনিষ্ঠ নিউজপোর্টাল ‘হিল ভয়েস’-এর প্রকাশনা ও প্রচারণা বন্ধের হীনউদ্দেশ্যে হিল ভয়েসের বিরুদ্ধে কপিরাইট আইন লঙ্ঘনের মিথ্যা, সাজানো ও ষড়যন্ত্রমূলক অভিযোগ দায়ের অব্যাহতভাবে চলছে। বিশেষ করে সেনাবাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংবাদ হিল ভয়েসে প্রকাশ করা হলে নানা নামে ও ঠিকানা ব্যবহার করে সেই সংবাদ তাদেরই নিজস্ব সংবাদ বলে দাবি করে তাদের অনুমতি ছাড়া উক্ত সংবাদ হিল ভয়েসে প্রকাশ করা হয়েছে মর্মে কপিরাইট লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়।
হিল ভয়েসের নির্বাহী সম্পাদক প্রীতিবিন্দু চাকমার মতে, এ ধরনের কপিরাইট লঙ্ঘনের অভিযোগ দায়ের করার পেছনে সেনাবাহিনী ও সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকতে পারে। কেননা প্রধানত সেনাবাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংবাদগুলিকে কেন্দ্র করেই বেছে বেছে এ ধরনের অভিযোগ দায়ের করা হয়ে থাকে।
উল্লেখ্য যে, ১৯৯৮ সালের ‘ডিজিটাল মিলেনিয়াম কপিরাইট অ্যাক্ট’ (ডিএমসিএ) নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কপিরাইট আইনের অধীনে হিল ভয়েসের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ দায়ের করা হয়ে থাকে।উক্ত আইন অনুসারে উক্ত অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে হলে সাধারণত অভিযুক্ত ব্যক্তি/নিউজপোর্টালকে সংশ্লিষ্ট সংবাদটি তার নিউজপোর্টাল থেকে সরিয়ে নিতে হয় নতুবা তথ্য-প্রমাণ দাখিল সাপেক্ষে সাথে সাথে অভিযোগকারীর বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ দায়ের করতে হয়। অন্যথায় ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার (আইএসপি)-এর পক্ষ থেকে অভিযুক্ত ওয়েবসাইটটি বন্ধ করে দেয়া হয়।
সম্প্রতি হিল ভয়েসের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত এ ধরনের দু’টি অভিযোগ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। একটি হচ্ছে ২৩ জানুয়ারি ২০২১ হিল ভয়েস কর্তৃক প্রকাশিত “নান্যাচরের বুড়িঘাটে এক জুম্মর জায়গা বেদখল করে সেনা ক্যাম্প স্থাপন” শীর্ষক সংবাদে যুক্তরাজ্যের পোর্টসমাউথের ৭৬ পার্ক এভিনিউ থেকে ইয়াশ খান নামে এক ব্যক্তি হিল ভয়েসের বিরুদ্ধে কপিরাইট লঙ্ঘনের অভিযোগ দাখিল করেন।
গত ২০ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে নান্যাচরের নামেঅং গ্রামের জ্যোতিলাল চাকমার ৭ একর জায়গা বাৎসরিক ৭,০০০ টাকায় জোরপূর্বক ভাড়ায় নিয়ে ক্যাম্পটি স্থাপনের ঘটনা ঘটলেও ইয়াশ খান দাবি করেন, এটা তার নিজস্ব সংবাদ এবং তিনি উক্ত সংবাদটি তার yashkhan.com-এ ২০ জানুয়ারি ২০২০ প্রকাশ করেন। ঘটনা না ঘটতেই এক বছর পূর্বে তার সংবাদ প্রকাশের দাবি ছিল হাস্যকর।
ইয়াশ খান হুমকি দিয়ে বলেছেন, তিনি প্রয়োজনে যুক্তরাজ্যের হাইকোর্টে যাবেন। এ বিষয়ে তার যুক্তরাজ্যের হাইকোর্টের অর্ডার রয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে হিল ভয়েসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, হিল ভয়েসও যুক্তরাজ্যের হাইকোর্টে যেতে রাজী আছে এবং কোর্টের শুনানীতে অংশগ্রহণের জন্য হিল ভয়েস অপেক্ষায় থাকবে।ইয়াশ খান থেকে যুক্তরাজ্যের হাইকোটের অর্ডারের কপিও চাওয়া হয়। তারপর ইয়াশ খান কোন উত্তর দেননি এবং একেবারে চুপচে যান। ফলে স্বাভাবিকভাবে ইয়াশ খান কর্তৃক হিল ভয়েসের বিরুদ্ধে কপিরাইট লঙ্ঘনের অভিযোগ খারিজ হয়ে যায়।
আরেকটি অভিযোগ ছিল বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের প্রকাশিত সাত মাসের সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি সংক্রান্ত হিল ভয়েসের সংবাদের উপর। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক ৬ অক্টোবর ২০২০ তারিখে হিল ভয়েস “17 minorities killed and 65 women abused in 7 months: Oikya Parishad” শীর্ষক এক সংবাদ প্রকাশ করে যেখানে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের লাল বৃত্তের মধ্যে শান্তির কবুতর সম্বলিত লোগোটি প্রতীক ছবি হিসেবে প্রকাশ করা হয়।
ঢাকার যাত্রাবাড়ির চিটাগাং রোডের ঠিকানা উল্লেখ করে মনির আহমেদ নামে এক ব্যক্তি উক্ত লোগোটি বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের জন্য অঙ্কিত তার নিজস্ব চিত্রকর্ম বলে দাবি করেন এবং তার অনুমতি ছাড়া হিল ভয়েস এই লোগোটি ব্যবহার করেছে বলে অভিযোগ করেন। তাই ডিএমসিএ-এর অধীনে হিল ভয়েসের বিরুদ্ধে কপিরাইট লঙ্ঘনের অভিযোগ দায়ের করেন তিনি।
বস্তুত মনির আহমেদের অভিযোগ ছিল একেবারে ভিত্তিহীন ও হাস্যকর। কেননা বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের ৬ অক্টোরব ২০২০ ‘করোনাভাইরাস সৃষ্ট মহামারীজনিত পরিস্থিতিতে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর ২০২০ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের চালচিত্র সম্পর্কে এবং সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়নের দাবি’তে ঐক্য পরিষদ সংগঠনের নিজস্ব প্যাডে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রদান করে। উক্ত লেটার হেডে ঐক্য পরিষদের লাল বৃত্তের মধ্যে শান্তির কবুতর সম্বলিত লোগোটি ছিল।
একটি সংগঠনের লোগো’কে নিজস্ব বলে দাবি করা ছিল একেবারে হাস্যকর। তিনি বা যে কেউ উক্ত লোগোটি অঙ্কন করুন না কেন, অঙ্কনের পর কোন সংগঠনকে দিয়ে দিলে সেই অঙ্কনের উপর নিজের বলে দাবি করা কিংবা উক্ত সংগঠনের প্রতীক হিসেবে কোন নিউজপোর্টালে প্রকাশ করা হলে তা কপিরাইট লঙ্ঘনের অভিযোগ দায়ের করা অবান্তর ও অযৌক্তিক বৈ কিছু নয়।
আরো উল্লেখ্য যে, এর পূর্বে নেত্র.নিউজের প্রধান সম্পাদক তসনীম খলিল (Tasneem Khalil) এর প্রায় একই নামে তসনিম খলিল (Tasnim Khalil) netranews.info নামে আরেকটি নিউজপোর্টাল খুলে ভারতের মহারাষ্ট্রের মুম্বাইয়ের মঙ্গিবাঈ রোডের ৫২ নিউ মার্কেটের ঠিকানা দিয়ে সেনাবাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিটি সংবাদে তার নিজস্ব সংবাদ দাবি করে হিল ভয়েসের বিরুদ্ধে কপিরাইট লঙ্ঘনের একের পর এক অভিযোগ করে আসছিলেন। তিনি বিভিন্ন ঠিকানা ব্যবহার করেন, যেমন পাকিস্তান থেকে আরেকটি হল: মুহাম্মদ শাহ রোড, চক্ষু হাসপাতালের পেছনে, খি, সিন্ধ, ১২০৭, পাকিস্তান। বলাবাহুল্য, হিল ভয়েস কর্তৃক যথাযথ তথ্য-প্রমাণাদি দাখিল সাপেক্ষে উক্ত অভিযোগ মিথ্যা, সাজানো ও ষড়যন্ত্রমূলক প্রমাণিত হওয়ায় তসনিম খলিলের প্রতিটি অভিযোগ খারিজ হয়ে যায়।
হিল ভয়েসের নির্বাহী সম্পাদক প্রীতিবিন্দু চাকমার অভিমত হচ্ছে যে, নেত্রনিউজের একই লোগো ও একই ব্যক্তির নাম (তসনীম খলিল) ব্যবহার করে সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই হয়তো এ ধরনের হয়রানি ও ষড়যন্ত্রমূলক অভিযোগ দিয়ে আসছে।
হিল ভয়েসের বিরুদ্ধে এ ধরনের হয়রানি ও ষড়যন্ত্রমূলক অভিযোগের বিষয়ে সুরাহার জন্য সহযোগিতা চেয়ে তসনীম খলিলকে (Tasneem Khalil) গত ২১ নভেম্বর ২০২০ তারিখে হিল ভয়েসের পক্ষ থেকেএক ই-মেইল প্রেরণ করা হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে, তসনীম খলিল (Tasneem Khalil) উক্ত মেইলের কোন উত্তর প্রদান করেননি।
এমনকি নেত্র.নিউজের সাংগঠনিক বোর্ডের সেক্রেটারী বীনা ডি কোস্টাকেও গত ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ একটি ইমেইল প্রেরণ করা হয়। পরিতাপের বিষয় যে, বীনা ডি কোস্টাও উক্ত মেইলের কোন উত্তর প্রদান করেননি। ফলে এ নিয়ে নানা সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে।
হিল ভয়েস হচ্ছে মানবাধিকার ভিত্তিক পার্বত্য চট্টগ্রাম, আদিবাসী, নারী, সংখ্যালঘু, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংক্রান্ত একটি বস্তুনিষ্ঠ নিউজপোর্টাল। হিল ভয়েস সারাদেশের আদিবাসী, সংখ্যালঘু, নারী, পরিবেশ সংক্রান্ত সংবাদসহ বিশেষভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক ধারাবাহিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার উপর বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে।
তারই প্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী ও সেনা গোয়েন্দা সংস্থা হিল ভয়েসের বিরুদ্ধে কপিরাইট লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে হিল ভয়েস বন্ধ করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে আসছে। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে গত বছরের এপ্রিলে বাংলাদেশে হিল ভয়েসকে ব্লক করে দেয়া হয়।
একদিকে ভাড়াটে হলুদ সাংবাদিকদের মাধ্যমে জুম্ম জনগণ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, অন্যদিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমিতির স্বাধীনতা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংবাদ প্রকাশের উপর বিধি-নিষেধ আরোপের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে কার্যত অবরুদ্ধ অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে। ফলে সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতনের খবর সম্পূর্ণভাবে দেশের সংবাদ মাধ্যম ও দেশবাসীর অন্তরালে থেকে যায়।
হিল ভয়েসের বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলী প্রকাশ হয়ে পড়ছে। ফলে হিল ভয়েসের বিরুদ্ধে এ ধরনের সাজানো, ভুয়া ও ষড়যন্ত্রমূলক অভিযোগ এনে হিল ভয়েস প্রকাশনা ও প্রচারণা বন্ধ করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।