হিল ভয়েস, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: আদিবাসী হাজংমাতা রাশিমণির ৭৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আইপিনিউজের ফেসবুক পেইজে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, ‘হাজং জাতি বীরের জাতি। হাজংরা হাজং হিসেবে গর্ব করবেন। বুক ফুলিয়ে হাজং পরিচয় দিবেন। আগামী প্রজন্মের জন্য হাজং ভাষা, গান, সংস্কৃতি এগুলো দেখিয়ে দিতে হবে, চর্চা চালিয়ে যেতে হবে যেন এগুলো হারিয়ে না যায়। রাশিমণি হাজং ও টংক আন্দোলনে হাজংদের অবদান এ জাতির জন্য একটি অনেক বড় পাওয়া। তিনি পৃথিবীতে এ বীরের জাতিকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গেছেন।’
গত ১ জানুয়ারি ২০২১ বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সোহেল হাজং স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ৩১ জানুয়ারি হাজাংমাতা রাশিমণির ৭৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আইপিনিউজের ফেসবুক পেইজে গত রবিবার, রাত ৮ টায় “রাশিমণি হাজংয়ের জীবন সংগ্রাম ও আদিবাসীদের অধিকার” শীর্ষক একটি অনলাইন আলোচনার আয়োজন করে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রংয়ের সভাপতিত্বে ও ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য সোহেল হাজংয়ের সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশ নেন- হাজংমাতা রাশিমণি মেমোরিয়াল ট্রাস্ট-এর চেয়ারপার্সন ও নিজেরা করির সমন্বয়কারী খুশী কবির, হাজংদের নিয়ে লেখক ও গবেষক আলী আহাম্মদ খান আইয়োব, বিরিশিরি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একেডেমির পরিচালক শরদিন্দু হাজং স্বপন, বাংলাদেশ জাতীয় হাজং সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পল্টন হাজং, বাংলাদেশ হাজং ছাত্র সংগঠনের সভাপতি জিতেন্দ্র হাজং ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজং শিক্ষার্থী রিতা হাজং ও রূপশ্রী হাজং।
আলোচনায় খুশী কবির বলেন, রাশিমণিকে স্মরণ করার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। তিনি একদিকে ছিলেন টংক আন্দোলনের নেত্রী এবং অন্যদিকে একবোনকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এজন্য তাঁর নামটি আগে চলে এসেছে। তবে সেদিন আরেকজন শহিদ সুরেন্দ্র হাজংয়ের নামও স্মরণ করা উচিত। আর এ স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পেছনে কবি ও স্থপতি রবিউল হুসাইনসহ আমরা যারা রাশিমণি মেমোরিয়াল ট্রাষ্ট্রের সদস্য ছিলাম যেমন প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, কামাল লোহানী, কমরেড অজয় রায়, ভূমিদাতা সাহাবুদ্দিন তোতাসহ সকলের অবদান ছিল। কিন্তু আজ তাদের অনেকেই নেই। এর বাইরেও হাজংদের বড় অবদান ছিল যাদের সহযোগিতা ছাড়া এই স্মৃতিসৌধ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হত না।
তিনি আরও বলেন, ইতিহাসে হাজং আদিবাসীদের গৌরবময় দিকটি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তোলে ধরাই এ হাজংমাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। তিনি দেশের প্রত্যেকের অধিকার, পরিচয় ও সংস্কৃতি নিয়ে বেঁচে থাকার আন্দোলনের সাথে সবসময় থাকবেন বলে জানান।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধেও সারাদেশের অসংখ্য আদিবাসীরা অংশ নিয়েছিলেন এ ইতিহাস আমাদের জানা দরকার। কিন্তু সরকার আজ তাদের জন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শব্দটি ব্যবহার করছে যা দিয়ে আসলে কী বোঝাতে চাচ্ছে তা বুঝতে পারছি না, তারা যদি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী হয় তার মানে কি আমি(বাঙালি) বৃহত্তর নৃগোষ্ঠী? তিনি বলেন, আমি যদি দেশের প্রেক্ষাপটে বৃহত্তর নৃগোষ্ঠী হয়ে থাকি আমি কিন্তু উপমহাদেশের ও বিশ্বের প্রেক্ষাপটে বৃহত্তর নৃগোষ্ঠী না, আমিও তাহলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী! সরকার বার বার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠেী শব্দটি বলে যাচ্ছে যেটা মেনে নিতে পারি না, আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবেই মেনে নিতে হবে।
আলী আহাম্মদ খান আইয়োব বলেন, এবারের ৩১ জানুয়ারি রাশিমণির ৭৫তম শহীদ দিবস। এ দিবসে রাশিমণি ও সুরেন্দ্র হাজং শহীদ হয়েছেন তাদের আত্মার শান্তি কামনা করি। তিনি বলেন রাশিমণি একজন নারী হয়ে একটি জাতিকে গোটা পৃথিবীর মাঝে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গেছেন- একটি বীরের জাতি পৃথিবীতে আছে সেটা হচ্ছে হাজং জাতি। হাজংরা টংক আন্দোলন, হাতিখেদা আন্দোলনসহ নানা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
সঞ্জীব দ্রং বলেন, রাষ্ট্র দেশের আদিবাসীদের প্রতি যতটুকু মানবিক হওয়ার কথা ছিল সেভাবে হয়নি। আমরা এমন একটি দেশ দেখতে চাই যেদেশে হাজংদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে রাষ্ট্র খুশি হবে আর হাজংরা দেশান্তরিত হলে রাষ্ট্র অখুশী হবে, লজ্জিত হবে। রাষ্ট্রকে অনেক বেশি সংবেদনশীল হতে হবে বলে তিনি মতামত ব্যক্ত করেন।
স্বপন হাজং বলেন, হাজংমাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধ নিয়ে এখনও অনেক কাজ বাকি আছে। এটাকে মেরামতসহ, জায়গাটিকে আরো উন্নত ও সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। স্মৃতিসৌধে রাশিমণি হাজংয়ের নামে একটি লাইব্রেরি ও জাদুঘর করার প্রস্তাবনা রয়েছে। তিনি বলেন, হাজং সমাজে সর্বক্ষেত্রে নারীদের অবদান অনেক বেশি। এজন্য হাজং সমাজে এতো নারীনেত্রী জন্ম নিয়েছে। নারীদের এ অবদান এবং যথাযথ নারীদের মূল্যায়নের মাধ্যমে আমাদের সমাজে উন্নয়ন নিয়ে আসা সম্ভব।
পল্টন হাজং বলেন, অধিকার আদায়ের সংগ্রামে রাশিমণি হাজংয়ের যে আত্মত্যাগ, অবদান ও কৃতিত্ব রয়েছে তা একটি প্রান্তিক জাতি থেকে বলে এখনও সেভাবে মূল্যায়িত হচ্ছে না। তাঁর অবদানের কথা জাতীয় ও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে হবে।
জিতেন্দ্র হাজং বলেন, আমি গর্ববোধ করি এই জন্য যে আমরা রাশিমণির উত্তরসূরি এবং নেত্রকোনার যে বহেরাতলি গ্রামে তিনি শহীদ হয়েছেন আমি সে গ্রামেরই সন্তান। সরকার যেন কুমুদিনি হাজংসহ সকল আদিবাসীদের ভিটেমাটি ও ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। এদেশে কোন পর্যটন স্থান প্রতিষ্ঠার জন্য যেন আদিবাসীদের ভূমি কেড়ে নেওয়া না হয় সে দাবিও রাখেন।
রীতা হাজং বলেন, হাজংদের প্রতিটি গ্রামে যুব কমিটি গঠন করা অতি জুরুরি, যুব কমিটি গঠনে নিজ গ্রামের ছেলে মেয়েরা থাকবে। সেখান থেকে যুব প্রতিনিধিরা নিজ নিজ গ্রামের উন্নয়ন করবে এবং জাতিগঠনে ভুমিকা রাখবে। নিজের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানবে এবং জাতির প্রতি দায়িত্বশীল হবে।
রূপশ্রী হাজং বলেন, নারী সকল সময় বিভিন্ন বাধাবিপত্তির সম্মুখীন হন তবু রাশিমণি ঐ সময় এইসকল বাধাবিপত্তি উপেক্ষা করে সমাজের জন্য যে অবদান রেখেছেন তা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। তিনি প্রস্তাব রাখেন, রাশিমণির সাথে আরো যারা টংক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন যেমন সুরেন্দ্র হাজং, রেবতী হাজং, শঙ্খমণি হাজংসহ আরো অনেকে যারা আছেন তাদেরকেও আমরা কিভাবে স্বরণ করতে পারি সে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ভাল হবে।
উল্লেখ্য, ৩১ জানিুয়ারি ২০২১ মহীয়সী নারী, টংক আন্দোলনের নেত্রী ও প্রথম নারী শহীদ হাজংমাতা রাশিমণির ৭৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী দ্বারা দলবল নিয়ে সুরেন্দ্র হাজংসহ রাশিমণি হাজং সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। সেসময় হাজংদের মাঝে জমিদারদের চাপিয়ে দেয়া অন্যায় টংক নীতির বিরুদ্ধে হাজংদের আন্দোলন জেরালোভাবে গড়ে ওঠেছিল। ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী সেদিন আন্দোলনকারী হাজংদের ধরতে গ্রামে গ্রামে হানা দিলে কাউকে না পেয়ে বহেরাতলি গ্রামের সদ্য বিবাহিতা যুবতি কুমুদিনী হাজংকে ধরে নিতে থাকলে তাঁকে রক্ষার জন্য এ যুদ্ধটি সংঘটিত হয়। পরবর্তীতে রাশিমণি শহীদ হওয়ার স্থানে তাঁর স্মরণে ২০০৪ সালে একটি স্মৃতিসৌধ প্রতিষ্ঠা করে হাজংমাতা রাশিমণি মেমোরিয়াল ট্রাস্ট।