হিল ভয়েস, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: বান্দরবানে চিম্বুক পাহাড়ে আদিবাসী ম্রোদের ভূমিতে পাঁচতারা হোটেল নির্মাণ বন্ধের দাবি জানিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সেনাপ্রধান এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠি দিয়েছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
গতকাল ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের পক্ষে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বান্দরবান জেলার বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি সড়কের ডানপাশে চিম্বুক পাহাড়ের কোলে ৩০২ নংলুলাইং মৌজা ও ৩৫৫ নং সেপ্রু মৌজায় কাপ্রুপাড়া, দোলাপাড়া, এরাপাড়া ও শোংনামহুংপাড়ায় (যা চন্দ্র পাহাড় নামে পরিচিত) অন্তত ১০ হাজার ম্রো জনগোষ্ঠীর বসবাস। ওই জনপদে সিকদার গ্রুপের অঙ্গ সংগঠন আর এন্ড আর হোল্ডিং লিমিটেড যৌথ উদ্যোগে একটি সুবিস্তৃত পাঁচতারা হোটেল ও পর্যটন স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। উদ্যোক্তারা এটিকে “ম্যারিয়ট হোটেলস্ অ্যান্ড রিসোর্টস” (হোটেল ও বিনোদনপার্ক) বলে বিজ্ঞাপন বোর্ডে প্রচার করলেও ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনাল এর ভাইস প্রেসিডেন্ট তার স্বাক্ষরিত ১৯ জানুয়ারি ২০২০ এর চিঠিতে হোটেল ও রিসোর্ট প্রকল্পে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি চূড়ান্ত নয় এবং তাদের নাম ও ব্র্যান্ড এর ব্যবহার অনুমোদিত নয় বলে স্পষ্ট জানানো হয়েছে।
নাগরিকদের পাঠানো চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন-১৯০০, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০০১, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এবং বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক আইন অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রামে ম্রো জাতিসহ অন্যান্য প্রথাগত জনগোষ্ঠীর অধিকার চর্চায় বাধা সৃষ্টি করার কোন সুযোগ নেই। পার্বত্য এলাকার ভূমি ব্যবহার ও আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত পার্বত্য ভূমিতে কোন “উন্নয়ন প্রকল্প” বাস্তবায়নের পূর্বে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর স্বাধীন ও পূর্ব সম্মতি নিতে হবে। কিন্তু প্রস্তাবিত পর্যটন স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রে আইনী বিধান লঙ্ঘন করে মতামত গ্রহণের বিপরীতে প্রতিবাদকারী ম্রো জনগোষ্ঠীর সদস্যদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে এবং সাজানো কিছু অনুষ্ঠান/বক্তব্য/লেখনীর মাধ্যমে হোটেল ও বিনোদনপার্ক স্থাপনে ম্রো জনগোষ্ঠীর সম্মতি আছে বলে প্রচারের অপচেষ্টা করা হচ্ছে, যদিও ইতোমধ্যে বিক্ষুব্ধ ম্রোসহ অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আর্ন্তজাতিক সংস্থা এই স্থাপনা নির্মাণকাজ বন্ধ এবং হোটেল ও বিনোদন পার্কেও প্রকল্প বাতিলের দাবি জানিয়েছে।
চিঠিতে অভিযোগ করে বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী সেনাবাহিনীর স্থাপনা সংকুচিত করার কথা থাকলেও বিশাল নির্মাণ স্থাপনা কার্যত পার্বত্য চুক্তি লঙ্ঘনের সামিল। উপরন্তু সিকদার গ্রুপের মতন দখলদারের তালিকায় থাকা সংস্থার সাথে জাতির অহংকার ও আস্থার প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশীদারিত্ব আমাদের হতাশ করেছে। হোটেলের প্রয়োজনে ২০ একর জমি নেওয়ার কথা বলা হলেও কার্যত বিস্তৃত এলাকা জুড়ে চতুর্পাশে সীমানা খুঁটি স্থাপনের কাজ করা হচ্ছে। ১০ হাজার ম্রো জনগোষ্ঠীর জীবিকা ও চাষাবাদের অধিকার সংকুচিত করে ব্যবসায়িক স্বার্থে এমন উদ্যোগ জাতীয় স্বার্থ নয়।
স্বাক্ষরকারী ব্যক্তিরা চিঠিতে জোর দিয়ে প্রথাগত জনগোষ্ঠীর অধিকার, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি পূর্ণ সম্মান জানিয়ে এবং বান্দরবানের মতো সংবেদনশীল প্রতিবেশ ব্যবস্থার সুরক্ষার স্বার্থে “ম্যারিয়ট হোটেলস অ্যান্ড রিসোর্টস” নামক প্রকল্প অবিলম্বে বাতিলের ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। একই সাথে সিকদার গ্রুপের সাথে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অংশীদারিত্ব বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। এ বিষয়ে মতবিনিময়ের জন্য মন্ত্রী, সেনাবাহিনীর প্রধান ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে দেখা করার অনুরোধও জানিয়েছেন তারা।
একই সঙ্গে, এ প্রকল্পে সব ধরনের সম্পৃক্ততা প্রত্যাহার করতে আন্তর্জাতিক হোটেল চেইন ম্যারিয়ট ইন্টারন্যাশনাল বরাবরও চিঠি দেওয়া হয়েছে।
চিঠিতে স্বাক্ষরকারী ব্যক্তিরা হলেন প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, প্রফেসর এমেরিটাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সুলতানা কামাল, মানবাধিকার কর্মী; খুশি কবির, সমন্বয়কারী, নিজেরা করি; ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, অর্থনীতিবিদ ও নির্বাহী সভাপতি পিপিআরসি; ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র; ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, সাবেক গর্ভনর, বাংলাদেশ ব্যাংক; ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি; রাশেদা কে চৌধুরী, নির্বাহী পরিচালক; গণস্বাক্ষরতা অভিযান; ড. বদিউল আলম মজুমদার, সচিব, সুজন; ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সম্মানিত ফেলো, সিপিডি; ড. মুস্তাফিজুর রহমান, সম্মানিত ফেলো, সিপিডি; শিরিন হক, সদস্য, নারীপক্ষ; প্রফেসর আনু মুহাম্মদ, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; প্রফেসর এম এম আকাশ, অর্থনীতিবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; শাহীন আনাম, নির্বাহী পরিচালক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন; ড. পারভীন হাসান, উপাচার্য, সেন্ট্রাল ওইমেন্স বিশ্ববিদ্যালয়; প্রফেসর ফেরদৌস আজিম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়; ড. আসিফ নজরুল, প্রফেসর, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ড. হামিদা হোসেন, নারী অধিকার কর্মী; রেহনুমা আহমেদ, লেখক; মেঘনা গুহঠাকুরতা, গবেষক; প্রফেসর শাহনাজ হুদা, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ড. আমেনা মহসিন, প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রফেসর ড. সি আর আবরার, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ড. ইমরান মতিন, নির্বাহী পরিচালক, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গর্ভনেন্স ও ডেভেলপমেন্ট; ড. তাসনিম সিদ্দিকী, প্রফেসর, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, রামরু; ড. ইমরান রহমান, প্রাক্তন উপাচার্য, ইউল্যাব; মির্জা তাসলিমা সুলতানা, প্রফেসর, নৃবিজ্ঞান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; গীতিয়ারা নাসরিন, প্রফেসর, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; শহিদুল আলম, আলোকচিত্রী ও লেখক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, দৃক; মো. নিজামুল হক, চীফ লিগ্যাল এডভাইজর, ব্লাস্ট, প্রাক্তন বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রীম কোর্ট; শামসুল হুদা, নির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি; সারা হোসেন, এ্যাডভোকেট, সুপ্রীমকোটর্; জাকির হোসেন, প্রধান নির্বাহী, নাগরিক উদ্যোগ; রেজাউল করিম চৌধুরী, নির্বাহী, কোস্ট; নুর খাঁন, সাধারণ সম্পাদক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র; অরূপ রাহী, কবি, লেখক ও গায়ক; মাহরুখ মহিউদ্দিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউনিভাসির্টি প্রেস লি:; তাসাফি হোসেন, প্রতিষ্ঠাতা, বহ্নিশিখা; সামিনা লুৎফা, সহযোগী অধ্যাপক, সমাজ বিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; সঞ্জীব দ্রং, নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম; রিপন বানাই, কমর্সূচি সমন্বকারী, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম; জুমলিয়ান আমলাই, সভাপতি, বান্দরবান চ্যাপ্টার, পার্বত্য চট্টগ্রাম বন ও ভূমি অধিকার আন্দোলন; অজয় এ মৃ, সভাপতি, জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদ; মুক্তাশ্রী চাকমা, নির্বাহী পরিচালক, স্পার্ক; গৌতম দেওয়ান, সভাপতি, পাবর্ত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটি; লুবনা মরিয়ম, পরিচালক, সাধনা; নায়লা খান, পরিচালক, ক্লিনিক্যাল নিউরোসাইন্স সেন্টার, বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন; ওমর তারেক চৌধুরী, লেখক-অনুবাদক-প্রকাশক; নবনীতা চৌধুরী, উন্নয়ন কর্মী, গায়ক; আনুশেহ আনাদিল, সুরকার, সৃজনশীল পরিচালক, যাত্রা বাংলাদেশ; সাইদিয়া গুলরুখ, সাংবাদিক; মাহমুদ রহমান, আলোক চিত্রী, ম্যাপ-ফটো; মাহবুবা আখতার, উপ-পরিচালক, ব্লাস্ট; এ্যাডভোকেট মো: তাজুল ইসলাম, উপদেষ্টা, এডভোকেসী এবং ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, ব্লাস্ট; গোলাম মনোয়ার কামাল, নির্বাহী পরিচালক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র; নিনা গোস্বামী, জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র; মো: শাহিনুজ্জামান, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, এবং সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, এ্যাডভোকেট, সুপ্রীমকোর্ট ও প্রধান নির্বাহী, বেলা।