হিল ভয়েস, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১, বান্দরবান: বান্দরবান পার্বত্য জেলার চিম্বুক পাহাড়ে সেনাবাহিনী ও সিকদার গ্রুপ কর্তৃক আদিবাসী ম্রোদের ঐতিহ্যগত ভূমি বেদখল এবং এলাকার বন, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে পাঁচতারা হোটেল ও বিনোদন পার্ক নির্মাণ প্রকল্প বাতিলের দাবিতে ম্রো জনগোষ্ঠী এক লং মার্চ করেছে।
আজ ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ চিম্বুক পাহাড় এলাকার ভূমিপুত্র আদিবাসী ম্রোরা চিম্বুক থেকে বান্দরবান সদর পর্যন্ত এই লং মার্চের আয়োজন করে। তারা চিম্বুকের রামরি পাড়া থেকে সকাল ৯:৩০ টায় লং মার্চ শুরু করে পায়ে হেঁটে প্রায় ২১ মাইল দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে বিকাল ২:৩০ টা নাগাদ বান্দরবান সদরের রাজার মাঠে এসে লং মার্চ সমাপ্ত করে। এসময় তারা রাজার মাঠে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশের আয়োজন করে। লং মার্চে চিম্বুকের প্রায় ৪৫ টি গ্রামের দেড় হাজারেরও অধিক ম্রো অংশ নেন।
বান্দরবানের রাজার মাঠে আয়োজিত সমাবেশে চিম্বুক পাহাড়বাসীর পক্ষে বিবৃতি পাঠ করেন সিংপাত ম্রো। এতে সংহতি বক্তব্য রাখেন বন ও পরিবেশ অধিকারকর্মী জুমলিয়ান আমলাই বম এবং চিম্বুক পাহাড়বাসীর পক্ষে সমাপনী বক্তব্য রাখেন রেং ইয়ং ম্রো।
সমাবেশে লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, ম্রোদের ভূমি বেদখল করে চিম্বুকের নাইতং পাহাড়ে সিকদার গ্রুপ (আরএন্ডআর হোল্ডিংস) ও সেনাবাহিনী ‘ম্যারিয়ট হোটেল এন্ড রিসোর্টস’ নামে পাঁচতারকা হোটেল ও বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। এর ফলে আমাদের আনুমানিক ১০০০ একর ভোগদখলীয় ও চাষের ভূমি বেদখল হওয়ার আশংকা রয়েছে। যার ফলে আমাদের ৬টি পাড়া সরাসরি উচ্ছেদের মুখে পড়বে এবং ১১৬টি পাড়ার আনুমানিক ১০ হাজার বাসিন্দার ঐতিহ্যবাহী জীবিকা, চাষের ভূমি, ফলজ বাগান, পবিত্র জায়গা, শশ্মান ঘাট ও পানির উৎসগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া আমাদের সংরক্ষিত পাড়াবন ও জীববৈচিত্র্য অচিরেই ধ্বংস হবে।
সমাবেশে বক্তারা চিম্বুকের ম্রোদের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতির বৈচিত্র্যতা, প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করে, জুমভূমি দখল করে অবৈধ ও জবরদস্তিমূলকভাবে পাঁচতারা হোটেল ও বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণ ম্রো আদিবাসীদের স্বার্থে বন্ধ করার দাবি জানান।
বক্তারা আরও বলেন, ‘জেলা পরিষদ প্লান্টেশন প্রজেক্টের নামে ভূমি নিয়ে কীভাবে পাঁচতারকা হোটেল ও পর্যটন স্থাপনা নির্মাণের জন্য লিজ দিয়েছে তা আমাদের বোধগম্য নয়।’ কোন উপায়ে ম্রোদের জমি অন্যের কাছে লিজ দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে জেলা প্রশাসন ও জেলা পরিষদের সুস্পষ্ট বক্তব্য দাবি করেন বক্তারা।
রেং ইয়ং ম্রো বলেন, আজকে যে মানুষগুলোর পায়ে সেন্ডেল নাই, যে মানুষগুলো জানে না শিক্ষা কী জিনিস, যে মানুষগুলো ঠিকমত বেঁচে থাকার মৌলিক উপাদান থেকে শত শত বছর ধরে বঞ্চিত, সে মানুষগুলোর ভূমি কেড়ে নিয়ে, তাদেরকে উচ্ছেদ করে পর্যটন স্থাপন করলে কী লাভ হবে আপনাদের? আপনারা কেন এই মানুষগুলোর আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছেন না?
তিনি আরও বলেন, যে অবলম্বনকে ঘিরে আমাদের বেঁচে থাকা সে অবলম্বনকে আমরা কিছুতেই ছাড়তে পারবো না। আজীবন এই মাটি আমরা আগলে রাখবো। চিম্বুক পাহাড়বাসী তাদের ভূমির জন্য যে আন্দোলন করে যাচ্ছেন সেই আন্দোলন ন্যায়ের, সেই আন্দোলন ন্যায্যতার। এ আন্দোলন যাতে ব্যাহত করা না হয়।
বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আপনি যদি মনে করেন এই মানুষদের ভূমি নিয়ে আপনার যা ইচ্ছা তাই করবেন তাহলে আপনি ভুল করবেন। এই মানুষগুলো নিজেদের মাটি রক্ষা করার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত রয়েছে।
সমাবেশে বক্তারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, আগামী ১০ দিনের মধ্যে পর্যটন প্রকল্প বাতিল সংক্রান্ত কোন উদ্যোগ যদি নেওয়া না হয় তাহলে এই মানুষগুলো আগামীতে কঠোর কর্মসূচি হাতে নিবে।
লংমার্চে অংশগ্রহণকারী ম্রোরা হোটেল ও বিনোদন কেন্দ্র নির্মাণ বন্ধের দাবিতে ৫টি দাবি সচেতন নাগরিক সমাজ, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরেন-
১) চিম্বুকের নাইতং পাহাড়ে পাঁচতারকা হোটেল ও বিনোদন কেন্দ্র স্থাপনের প্রকল্প বাতিল করতে হবে।
২) অবৈধভাবে ভূমি দখলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী স্থানীয় পাড়াবাসী, জনপ্রতিনিধি, ছাত্র-জনতাকে হয়রানি ও হুমকি-ধামকি প্রদান বন্ধ করতে হবে।
৩) চিম্বুকের ম্রোদের বংশপরম্পরায় ভোগদখলীয় ভূমিতে কোনো ধরনের পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৪) স্থানীয় মানুষের ভূমি দখল করে নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র সম্প্রসারণের উদ্যোগ কোনোভাবেই গ্রহণ করা যাবে না।
৫) যে উদ্দেশ্যেই চিম্বুক পাহাড়ের ভূমি ব্যবহার করা হোক না কেন তা স্থানীয় কার্বারী, হেডম্যান, জনপ্রতিনিধি ছাড়াও চিম্বুক পাহাড়ের সকল পাড়াবাসীকে অন্তর্ভুক্ত করে আলোচনা করতে হবে।
জানা গেছে, লংমার্চ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পর পুলিশ ছয়মাইল এলাকার বৈথানী পাড়ায় বাধা দেয়। এসময় পুলিশ সদস্যরা লংমার্চে অংশগ্রহণকারীদের লংমার্চ বন্ধ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে। তবে অংশগ্রহণকারীরা ‘আমার ভূমি, আমার মা, কেড়ে নিতে দিব না’, ‘আমাদের আন্দোলন চলছে, চলবে’, ইত্যাদি শ্লোগান দেয় এবং পাঁচতারকা হোটেল ও পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ কাজ বন্ধের ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। পরে লং মার্চটি বান্দরবানের সড়কের ১০ মাইল এলাকায় পৌঁছালে সেখানে পুলিশ ফোর্স নিয়ে এক ম্যাজিস্ট্রেট বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু বাধা অতিক্রম করে লং মার্চ এগিয়ে যায়। এরপর লং মার্চটি ফারুক পাড়ায় পৌঁছানোর আগে আরেকবার বাধা প্রদানের চেষ্টা করা হয়। তবে ফারুক পাড়ার বম সম্প্রদায় লং মার্চে অংশগ্রহণকারীদের পানি ও নাস্তা দিয়ে সংহতি জানান।