হিল ভয়েস, ৫ জানুয়ারী ২০২১, বিশেষ প্রতিবেদক: কক্সবাজারের টেকনাফের লাকিংমে চাকমা হত্যার ঘটনাপ্রবাহ সরেজমিন পরিদর্শনোত্তর পর্যবেক্ষণ নিয়ে নাগরিক প্রতিনিধি দলের উদ্যোগে আজ ৫ জানুয়ারি ২০২০ সকাল ১১:০০ টায় প্রতিবেদন উপস্থাপন উপলক্ষে এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের প্রতিনিধি শাহনাজ সুমীর সঞ্চালনায় নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছেন কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহা তানজীম তিতিল। প্রতিবেদন উপস্থাপনে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য ও প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা, এএলআরডির রফিক আহম্মেদ সিরাজী ও পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ঢাকা মহানগরের সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যাবিলন চাকমা।
লিখিত প্রতিবেদনে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহা তানজীম তিতিল বলেন, গত বছরের ৫ জানুয়ারি অপহৃত হয় লাকিংমে চাকমা। জন্মসনদ অনুযায়ী, অপহৃত হওয়ার দিনটিতে ওর বয়স ছিল ১৪ বছর ১০ মাস। আমাদের অনুসন্ধানে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, অপহরণের পর ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত লাকিংমেকে আশপাশের গ্রামে রাখা হয়। ৯ জানুয়ারি ওকে নিয়ে যাওয়া টেকনাফেরই শাহপরীর দ্বীপে। সেখানে জনৈক কালামনুর বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছিল অন্তত দুদিন। টেকনাফ থানা ন্যূনতম উদ্যোগ নিলে আত্মজাকে উদ্ধার করতে পারতেন লালাঅং। ১১ জানুয়ারি আতাউল্লাহ ওকে নিয়ে যায় কুমিল্লায়। এরপর কুমিল্লার আদালতে লাকিংমেকে ধর্মান্তর এবং একটি কাজী অফিসে বিয়েতে বাধ্য করা হয়। টেকনাফেরই বাহারছড়া মাথাভাঙ্গা এলাকার ইয়াসিন, ইসা, আবুইয়াসহ আরও পাঁচজন লাকিংমেকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। লালাঅং তাঁর মেয়ে অপহরণের পর মামলা করতে গিয়েছিলেন টেকনাফ থানায়। তখন কক্সবাজারের টেকনাফ থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা মামলায় বরখাস্ত এবং বর্তমানে জেলবন্দি প্রদীপ কুমার দাশ। থানায় মামলা করতে না পেরে ২৭ জানুয়ারি লালা অং কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। আদালত থেকে মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছিল পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্তের নামে যে অবহেলা তারা করেছেন তা পিবিআই কক্সবাজার ইউনিটের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) ক্যশৈনু মারমার দেওয়া দু পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনটি পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবেন। অপহরণের পর কেটে যায় ১১ মাস। এ সময় মেয়েকে হন্যে হয়ে খুঁজেছেন বাবা। অবশেষে গত ৯ ডিসেম্বর লালাঅং তাঁর মেয়ে লাকিংমের খোঁজ পান। তবে জীবিত নয়, কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে তাঁর প্রিয় কন্যার মরদেহ।
তিনি আরও বলেন, ঘটনাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আমরা শিক্ষক, সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও আদিবাসী নেতাদের একটি প্রতিনিধি দল গত ২৮ ডিসেম্বর গিয়েছিলাম শিলখালি গ্রামে। আমরা সেদিন লাকিংমের বাড়ি, বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদ অফিস এবং আতাউল্লাহর বাড়িতে যাই। ওই দিনই বিকেলে আমরা দেখা করি কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবং পাবলিক প্রসিকিউটরের সঙ্গে। এরপরের দিন ২৯ ডিসেম্বর কক্সবাজারে র্যাব কমান্ডারসহ এই মামলার ভূমিকা রাখতে পারেন-এমন আরো ব্যক্তিবর্গের সঙ্গেও কথা বলেছি।
অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, এদেশে বহু জাতিসত্তা আছে। তারা অনেক সময় নিরাপত্তাহীনতায় থাকে। তাদের নিরাপত্তা রক্ষা করা দরকার। লাকিংমে চাকমার মৃতদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তরের জন্য প্রশাসন ও র্যাবের সহযোগিতার ধন্যবাদ জানাচ্ছি। পাশাপাশি একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে জোর করে ধর্মান্তরকরণ, অপহরণ, হত্যা ঘটনার সাথে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, যখনই অন্য ধর্মের মানুষকে বিয়েতে বসানো হয় তখনই ধর্মান্তকরণ ও ভুয়া সার্টিফিকেট প্রদান করে বয়স লুকিয়ে ফেলার প্রবণতা আমার দেখি যা আইনের চোখে বড় অপরাধ। লক্ষণীয় বিষয় সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। কারণ চারদিক থেকে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ তাদেরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলছে। তাদেরকে সুরক্ষা দিতে রাষ্ট্রের তরফ থেকে কোন ব্যবস্থা নেই এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এ জায়গায় কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে। লাকিংমে চাকমার ঘটনায় অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করতে হবে।
শাহনাজ সুমি বলেন, সরেজমিন পরিদর্শন দলের পক্ষ থেকে ৫টি অপরাধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং এই অপরাধসমূহের ভিত্তিতে অপরাধীকে শাস্তিপ্রদানের দাবি জানানো হয়েছে।
ব্যাবিলন চাকমা বলেন, লাকিংমে চাকমার অপহরণ, ধর্মন্তকরণসহ জোরপূর্বক বিবাহ এবং হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত আতাউল্লাহসহ তার সহযোগীদের সবাইকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। আদিবাসী নারীদের উপর এধরনের ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অপরাধীরা এ ধরনের কাজ করার সুযোগ পায়।
লিখিত প্রতিবেদনে নিম্নলিখিত সুপারিশসমূহ তুলে ধরা হয়-
১. বয়স প্রমাণের পর এটা নিশ্চিত হয়েছে যে, লাকিংমেকে অপহরণ করা হয়েছিল। এরপর কিশোরী মেয়েটিকে জোরপূর্বক ধর্মান্তর, বিয়ে, যা ধর্ষণের নামান্তর। তাই নিয়মিত মামলা দায়ের করে এক্ষুণি অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার এবং জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার। অবশ্যই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
২. লাকিংমে আত্মহত্যা করেছে, নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে, তা নিশ্চিত হতে হবে। আত্মহত্যায় প্ররোচনার অসংখ্য প্রমাণ আমরা পেয়েছি এবং সেগুলো জানিয়ে এসেছি তদন্তকারীদের।
৩. লাকিংমে চাকমার পরিবার চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছে, সেটি লাশ সমাধিস্থ করার জন্য শিলখালির পরিবর্তে রামুতে নিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা আরো ভালো করে বুঝতে পেরেছি। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৪. লাকিংমের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
৫. ঘটনার প্রথম তদন্তে পিবিআই যে অবহেলা করেছে তার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে।
৬. সনদ জালিয়াতি এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক একটি মেয়ের জোরপূর্বক ধর্মান্তর ও বিয়েতে জড়িতদেও শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
৭. লাকিংমের সন্তান কোথায়, কার তত্ত্বাবধানে থাকবে তা মীমাংসা করতে হবে।
উল্লেখ্য যে গত ২৭-২৯ ডিসেম্বর ২০২০ ঢাকা থেকে একটি নাগরিক সমাজের দল টেকনাফ ও কক্সবাজার এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শন করেন। নাগরিক প্রতিনিধি দলে ছিলেন কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহা তানজীম তিতিল, সমকালের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রাজিব নূর, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য প্রচার সম্পাদক দীপায়ন খীসা, নিউএজের সাংবাদিক ইমরান নূর, ব্লাস্ট এর প্রতিনিধি তৌফিক-ই-ইসলাম, এএলআরডির প্রতিনিধি রফিক আহমেদ সিরাজী এবং পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের ঢাকা মহানগর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যাবিলন চাকমা প্রমুখ।