হিল ভয়েস, ১৭ জানুয়ারি ২০২১, ঢাকা: কক্সবাজারের ১৪ বছরের আদিবাসী কিশোরী লাকিংমে চাকমা’র অপহরণ, ধর্মান্তর ও জোরপূর্বক বিয়ে এবং অস্বাভাবিক মৃত্যুর প্রতিবাদে ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের দাবিতে ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউ এর সংসদ ভবনের বিপরীতে এক প্রদীপ প্রজ্বালন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। গতকাল ১৬ জানুয়ারি ২০২১ বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ, ব্লাস্ট, এএলআরডি, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের উপ-পরিচালক শাহনাজ সুমী’র সঞ্চালনায় এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং এর সভাপতিত্বে প্রদীপ প্রজ্বালন অনুষ্ঠানের শুরুতেই লাকিংমে চাকমাকে নিয়ে সংঘটিত ঘটনার সবিস্তার বর্ণনা দেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহা তানজিম তিতিল।
লিখিত বক্তব্যে ফারহা তানজিম তিতিল বলেন, ‘গত বছরের ৫ জানুয়ারি ২০২০ অপহৃত হয় লাকিংমে চাকমা। জন্মসনদ অনুযায়ী, অপহৃত হওয়ার দিনটিতে তার বয়স ছিল ১৪ বছর ১০ মাস। আমাদের অনুসন্ধানে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, অপহরণের পর ৮ জানুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত লাকিংমেকে আশপাশের গ্রামে রাখা হয়। ৯ জানুয়ারি তাকে নিয়ে যাওয়া হয় টেকনাফেরই শাহপরীর দ্বীপে। সেখানে জনৈক কালা মনুর বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছিল অন্তত দু’দিন। টেকনাফ থানা ন্যূনতম উদ্যোগ নিলে কিশোরী মেয়েটিকে উদ্ধার করতে পারতেন বাবা লালাঅং চাকমা। এরপর গত ১১ জানুয়ারি ২০২০ তাকে নিয়ে যাওয়া হয় কুমিল্লায়। এরপর ২১ জানুয়ারি ২০২০ কুমিল্লার আদালতে লাকিংমেকে ধর্মান্তর এবং একটি কাজি অফিসে নিয়ে বিয়েতে বাধ্য করা হয়। টেকনাফের বাহারছড়া মাথাভাঙ্গা এলাকার ইয়াসিন, ইসা, আবুইয়াসহ আরও পাঁচজন লাকিংমেকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। লালাঅং তাঁর মেয়ে অপহরণের পর টেকনাফ থানায় মামলা করতে গিয়েছিলেন। তখন কক্সবাজারের টেকনাফ থানার ওসি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যা মামলায় বরখাস্ত এবং বর্তমানে জেলবন্দি প্রদীপ কুমার দাশ।’ পুলিশ এ বিষয়ে মামলা না নেওয়ায় ক্ষোভও প্রকাশ করেন এই শিক্ষক।
তাই নিয়মিত মামলা দায়ের করে অনতিবিলম্বে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার এবং জিজ্ঞাসাবাদ করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, লাকিংমে আত্মহত্যা করেছে, নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে, তা তদন্তের মাধ্যমে নিশ্চিত করে জনসমক্ষে প্রকাশ করা, চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা লাকিংমে চাকমার পরিবারকে যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, লাকিংমের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ এবং লাকিংমের সন্তানকে আইনানুযায়ী রাষ্ট্রীয় হেফাজতে নিয়ে শিশুটির যথাযথ ভরণ-পোষণের ব্যবস্থাসহ ৭ দফা দাবিও তুলে ধরেন তিনি।
প্রদীপ প্রজ্বালন আয়োজনে সংহতি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, এই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কত শত লাকিংমে’কে এধরনের নির্মমতার শিকার হতে হচ্ছে তার কোনো শেষ নেই। আমরা কেবল আজ লাকিংমে’র কথা জানি। কিন্তু আরো অনেক লাকিংমে ঘটনার অন্তরালে রয়ে গেছে।
তিনি আরো বলেন, লাকিংমে চাকমা আইডেনটিটি পলিটিক্সের শিকার। তার মত একটি কিশোরী অপহরণ, ধর্মান্তর ও জোরপূর্বক বিয়ের মত নির্মমতার শিকার হয়েছেন। এটার সাথে ধর্ষণও জড়িত। এসবের মাধ্যমে মূলত লাকিংমে চাকমা’র পরিচয়কে ধ্বংস করে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক রিনা রায় বলেন, গত এক বছরে ১৬২৭ জন মেয়ে শিশু ও নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এতকিছুর পরেও আমরা বিচার ব্যবস্থায় এর কোনো প্রতিফলন দেখিনি। সমাজে আমাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই আমাদের চোখের সামনে এতগুলো বিষয় ঘটতে দেখছি।
তিনি আরো বলেন, ১৪ বছরের এক মেয়েকে বিয়ে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এটা ধর্ষণ ও জরবদস্তির সামিল। কাজেই আমরা খুব ক্ষুব্ধ হয়েই লাকিংমের জন্য ন্যায়বিচার দাবি করছি।
আদিবাসী ফোরামের সদস্য মেইনথেইন প্রমিলা বলেন, আর কোনো লাকিংমে যেন এসব জঘন্যতম ঘটনার শিকার না হয় তার জন্যই আমাদের আজকে দাঁড়ানো। আমরা বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে থাকতে চাই না।
সভাপতির বক্তব্যে সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘লাকিংমে চাকমা নির্মম মৃত্যুর শিকার। এই প্রিয় রাষ্ট্রে কোনো নাগরিকের যেন এরকম পরিণতি না হয়। আমরা এই রাষ্ট্রকে আরো সংবেদনশীল ও আরো গণতান্ত্রিক হিসেবে দেখতে চাই। কেবল লাকিংমে নয়, সকল মানুষের জন্য সুন্দর বাংলাদেশ আমাদেরকে বিনির্মাণ করতে হবে।’ সকল নাগরিকের জন্য সর্বাঙ্গীণ সুন্দর একটি রাষ্ট্র তৈরিতে সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
এছাড়া উক্ত আয়োজনে আরো বক্তব্য রাখেন এডভোকেট রফিক সিরাজী, লাকিংমে’র আইনজীবী মহিউদ্দীন।