হিল ভয়েস, ২৬ জানুয়ারি ২০২১, বান্দরবান: বান্দরবান পার্বত্য জেলাধীন আলীকদম উপজেলার কুরুকপাতা ইউনিয়নের চারটি ম্রো গ্রামের ১৩ আদিবাসী ম্রো শিশুকে ইসলামে ধর্মান্তরকারী চক্রের হাত থেকে উদ্ধার করার খবর পাওয়া গেছে।
গত ২২ জানুয়ারি ২০২১ একদল সচেতন ম্রো ছাত্র স্থানীয় এনজিওকর্মী ও সমাজকর্মীদের সহযোগিতায় কক্সবাজারের ‘ঈদগাহ উপজাতীয় মুসলিম কল্যাণ সংঘ’ নামক এক প্রতিষ্ঠান থেকে এই শিশুদের উদ্ধার করে।
উদ্ধারকৃত এইসব শিশুরা হল- (১) মেন অং ম্রো, ১০ বছর, পিতা-অং ওয়াই ম্রো, গ্রাম-অং ওয়াই পাড়া; (২) ইংয়ং ম্রো, ৯ বছর, পিতা-মাংয়া ম্রো, গ্রাম-ঐ; (৩) ডিমওয়াই ম্রো, ৭ বছর, পিতা-মেনক ম্রো, গ্রাম-সিংরাও পাড়া; (৪) কেনওয়াই ম্রো, ১০ বছর, পিতা-পাদুই ম্রো, গ্রাম-ঐ; (৫) কাইনপা ম্রো, ১০ বছর, পিতা-লেবয় ম্রো, গ্রাম-ঐ; (৬) মেনওয়াই ম্রো, ৮ বছর, পিতা-মাংপুং ম্রো, গ্রাম-ঐ; (৭) লেংতুই ম্রো, ৮ বছর, পিতা-সাংরেং ম্রো, গ্রাম-মেনপাত পাড়া; (৮) মিস পাওরিং ম্রো, ৭ বছর, পিতা-কারা ম্রো, গ্রাম-ঐ; (৯) মিস তাংপাও ম্রো, পিতা-খামলাই ম্রো, গ্রাম-ঐ; (১০) সুইপিন ম্রো, ৮ বছর, পিতা-লাউলুং ম্রো, গ্রাম-ঐ; (১১) খিনপ্রে ম্রো, ৯ বছর, পিতা-কাইনওয়াই ম্রো, গ্রাম-ঐ; (১২) ওয়েইরিং ম্রো, ৮ বছর, পিতা-সিংরেং ম্রো, গ্রাম-ঐ; (১৩) য়ংনৈং ম্রো, পিতা-কাংলাফা ম্রো, গ্রাম-পাকমা পাড়া।
স্থানীয়দের অভিযোগ, বিনা খরচে থাকা, খাওয়া, লেখাপড়ার খরচ এর ব্যবস্থা ও আর্থিক সহযোগিতার প্রলোভন দেখিয়ে ইসলামে ধর্মান্তরকারী এই চক্রটি দরিদ্র ও সহজ-সরল ম্রো পরিবারের কাছ থেকে এই শিশুদের নিয়ে যায়। পরে তারা বিভিন্ন মাদ্রাসায় রেখে এই অবুঝ শিশুদের আযানসহ ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন শিক্ষা দিয়ে থাকে। শিশুদের পড়ানো হয় ইসলামী পোশাক। এক পর্যায়ে এই শিশুদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়। পরিবার বা তাদের অশিক্ষিত পিতা-মাতার মনে করেন, তাদের ছেলেমেয়েরা দেশের সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, জেএমবি শামীম নামে পরিচিত ডা: মো: ইউসুফ আলী নামে এক ব্যক্তি এই ধর্মান্তরিতকরণ চক্রের অন্যতম হোতা।
মেনপাত পাড়ার বাসিন্দা ভুক্তভোগী এক অভিভাবক খামলাই ম্রো বলেন, আমাদের সরলতাকে কাজে লাগিয়ে জেএমবি শামীম (মোঃ ইউসুফ আলী) আমাদের গ্রামে এসে আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে বিনাবেতনে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করা, থাকা-খাওয়া, যাতায়াত সুবিধাসহ বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতার কথা বলে ছেলেমেয়েদের নিয়ে যাওয়ার কথা বলে।
অংওয়াই ম্রো কার্বারী বলেন, আমাদের গ্রামে এসে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ-সুবিধা দিবে বলে ছেলেমেয়ে খুঁজলে আমরা তাতে রাজি হই। কিন্তু এরপর তারা আমাদের ছেলেময়েদের নিয়ে যাই কক্সবাজার জেলার ‘ঈদগাহ উপজাতীয় মুসলিম সংঘ মাদ্রাসা’ প্রতিষ্ঠানে। সেখানে পৌছানোর পরে বলা হয়, এখানে আপনাদের ছেলেমেয়েদের রাখা হবে, তারা এখানে থাকবেন বিনাবেতনে লেখাপড়া করবেন।
তিনি আরও বলেন, তখন আমি সেখানে আরো পাহাড়ি ছেলেমেয়ে দেখতে পাই। তাদের সাথে কথা হলে জানতে পারি, তাদেরকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৌদ্ধ, হিন্দু ও খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী আদিবাসী জুম্মদেরকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিতকরণের কার্যক্রম জোরদার হয়েছে। বিশেষ করে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, গৃহ নির্মাণ, গরু-ছাগল পালন, সুদ-মুক্ত ঋণ ইত্যাদি প্রলোভন দেখিয়ে বান্দরবান জেলায় ধর্মান্তরকরণ চলছে। বান্দরবান জেলায় ‘উপজাতীয় মুসলিম আর্দশ সংঘ’,‘উপজাতীয়মুসলিম কল্যাণ সংস্থা’ ও ‘উপজাতীয় আর্দশ সংঘ বাংলাদেশ’ ইত্যাদি সংগঠনের নাম দিয়ে জনবসতিও গড়ে তোলা হয়েছে এবং এসব সংগঠনের মাধ্যমে জুম্মদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিতকরণের কাজ চালানো হচ্ছে।
এছাড়া লেখাপড়া শেখানোর লোভ দেখিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরকে তাদের মাতা-পিতা থেকে নিয়ে ঢাকা, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পিতা-মাতার অজান্তে মাদ্রাসায় ভর্তি করানো এবং ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার সংবাদ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে।
একটি সূত্রের মতে, বান্দরবান পৌরসভা, আলিকদম, রোয়াংছড়ি, লামাসহ বিভিন্ন এলাকায় ১০টির অধিক জুম্ম মুসলিম পাড়া বা বসতি রয়েছে। এইসব ধর্মান্তরিত জুম্ম মুসলিমদের বলা হচ্ছে ‘নও মুসলিম’ বা ‘উপজাতি মুসলিম’। এই ধর্মান্তরিত মুসলিম বসতিগুলোকে ঘাটি হিসেবে ব্যবহার করে এবং কিছু বাছাইকৃত নও মুসলিমকে সুবিধা দিয়ে তাদের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ধর্মান্তরের কার্যক্রম সম্প্রসারণের চেষ্টা চলছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আলিকদমসহ বান্দরবানে আদিবাসী জুম্মদের ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণের সাথে সাম্প্রতিককালে সবচেয়ে সক্রিয় ও তৎপর হিসেবে দেখা গেছে ডা: ইউসুফ আলী নামের ঐ বহিরাগত চিকিৎসক ও আলিকদম উপজেলা জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা একে এম আইয়ুব খানকে। তারা আদিবাসীদের অভাব-অনটনের সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিনিয়ত আদিবাসীদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন এবং গরীব-অশিক্ষিত আদিবাসীদের ধর্মান্তরের জন্য এফিড্যাভিটসহ আইনি ও আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করছেন।
উল্লেখ্য, গত ১ জানুয়ারি ২০১৭, ঢাকায় এক মাদ্রাসায় পাচার হওয়ার সময়, পুলিশ বান্দরবান শহরের ‘অতিথি আবাসিক হোটেল’ থেকে চার আদিবাসী শিশুকে উদ্ধার করে। এর পূর্বে ২ জানুয়ারি ২০১৩, পুলিশ ঢাকার সবুজবাগ থানাধীন আবুযোর জিফারি মসজিদ কমপ্লেক্স নামের এক মাদ্রাসা থেকে ১৬ আদিবাসী শিশুকে উদ্ধার করে। শিশুদের জোর করে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হয়। এর আগে ২০১২ সালের জুলাই মাসেও গাজীপুর ও ঢাকার বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে ১১ জন আদিবাসী ত্রিপুরা শিশুকে উদ্ধার করা হয়। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে পুলিশ কর্তৃক কেবল বান্দরবান শহরের এক মোটেল ‘অতিথি বোর্ডিং’ থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ৩৩ শিশুকে উদ্ধার করে। বান্দরবানের থানচি উপজেলা থেকে এই শিশুদের সংগ্রহ করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ধানমন্ডী আদর্শ মদিনা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হবে এই প্রতিশ্রুতি ও প্রলোভন দেখিয়ে।