নিপন ত্রিপুরা
রাশিমণি হাজং টঙ্ক আন্দোলনের এক বীর নারী। তাই নারী হয়েও হাজংদের উপর জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সাহসের সাথে দাঁড়িয়েছেন যেমন করে এক মা তার সন্তানকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করে থাকেন।
রাশিমণি হাজংয়ের জন্ম ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার মাইজপাড়া গ্রামে, এক দরিদ্র টংকচাষির ঘরে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তেমন একটা গ্রহণ করতে পারেন নি। মাত্র বারো বছর বয়সেই তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। দুর্গাপুর থানার কুলাপাড়া ইউনিয়নের আরাপাড়া গ্রামের পাঞ্জি হাজংকে বিয়ে করেন। পাঞ্জি হাজং কবিরাজ ছিলেন। রাশিমনিকে তিনি কিছু কিছু কবিরাজি বিদ্যা শেখান। রাশিমনি নিজে আবার ধাত্রী জ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন। সেসময় আশেপাশের নারীদের রোগের চিকিৎসা কিংবা প্রসবে সহায়তা করতেন।
বিয়ের অল্পদিনের মধ্যেই তিনি বিধবা হন। এ কারণে গ্রামের লোকরা তাকে ‘ডাইনি’ বলে ডাকত। কিন্তু তিনি কারও কথায় কান না দিয়ে জীবনসংগ্রামে লিপ্ত থাকেন। পরের জমিতে রোয়া ধান লাগিয়ে আর ধান কেটে মজুরি বাবদ যে সামান্য ধান পেতেন, তাই ঢেঁকিতে ভেনে চাল তৈরি করে হাটে-বাজারে বিক্রি করতেন রাশিমণি। অবসর সময়ে গরিব হাজং মেয়েদের জন্য তাতে কাপড় ও ওড়না বুনতেন। সুসং অঞ্চলের মায়েদের আঁতুড়ঘরের শ্রেষ্ঠ ‘দাই’ বা ধাত্রীও ছিলেন তিনি। একসময় ‘মহিলা-আত্মরক্ষা সমিতি’র মাধ্যমে তার চাল-সংগ্রহকারী দল পরগনা ঘুরে সংগ্রহ করত ধান, চাল, অর্থ ও বস্ত্র। তেরোশ পঞ্চাশের মহা-মন্বন্তরে যখন সব দরিদ্র মানুষ খাওয়ার অভাবে মৃত্যুর সম্মুখীন, তখন রাশিমণি তিনটি গ্রামের জন্য লঙ্গরখানা খোলেন। হাজং অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য রাশিমণি হাজং ‘বেশি খাদ্য ফলাও’, খাল কাটা, বাঁধ বাঁধার আন্দোলন শুরু করেন। এসব কারণে তিনি হাজংদের কাছে মা হিসেবে পরিচিতি পান।
টঙ্ক আন্দোলনে সম্পৃক্ততা
একসময় জমিদারেরা জোর করে বন্যহাতি ধরার কাজে হাজংদের নিয়োজিত করতো। এতে অনেক হাজংকে বন্য হাতির আক্রমণে জীবন দিতে হয়েছে। এ অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে হাজংরা বিদ্রোহ শুরু করে। সেই বিদ্রোহের নাম ‘হাতিখেদা বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। হাজংদের জোরালো প্রতিবাদে হাতি খেদা প্রথার বিলুপ্তি ঘটলে জমিদারদের আরেকটি নিকৃষ্ট প্রথা ‘টঙ্ক প্রথা’ হাজংদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে।
‘টংক’ মানে ধান কড়ারি খাজনা। জমিতে ফসল হোক বা না হোক, নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান খাজনা হিসেবে দিতেই হবে।‘টংক’ স্থানীয়দের দেয়া নাম। টংকব্যবস্থায় সোয়া একর জমির জন্য বছরে ধান দিতে হতো সাত থেকে পনেরো মণ। ধানের দর হিসেবে প্রতি সোয়া একরে বাড়তি খাজনা দিতে হতো এগারো থেকে প্রায় সতেরো টাকা, যা ছিল এক জঘন্যতম শোষণ। এ ছাড়া টংক জমির ওপরও কৃষকদের কোনো মালিকানা ছিল না ময়মনসিংহ জেলার কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ী, শ্রীবর্দী থানায়। বিশেষ করে সুসং জমিদারি এলাকায় এর প্রচলন ছিল ব্যাপক। জমির উপর নিজেদের অধিকার ও টঙ্ক মওকুফের দাবিতে, ‘টঙ্ক প্রথার উচ্ছেদ চাই, জান দিব তবু ধান দিব না, জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ চাই, জমি যার, লাঙ্গল তার’ এই স্লোগানে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৩৬ সাল থেকে টঙ্ক বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। হাজং আদিবাসীরা এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
রাশিমণি হাজং ধীরে ধীরে এ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে হাজং নারীদের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেন। এক পর্যায়ে ১৯৪৫ সালে টঙ্ক আন্দোলনের জন্য আলাদা করে সশস্ত্র নারী বাহিনী গড়ে তোলেন।
১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৩১ জানুয়ারি। সেসময় বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে টংক বিরোধী আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করেছিল। হাজংমাতা রাশিমণি হাজংয়ের নেতৃত্বে নেত্রকোনার প্রতিটি অঞ্চলে আন্দোলন তখন তুঙ্গে। তার আগে নেত্রকোণার বিরিশিরিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল্স বাহিনীর সশস্ত্র ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ১৯৪৬ সালের জানুয়ারি মাসের দিনগুলোতে পরিকল্পিতভাবে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল্স সশস্ত্র বাহিনী বিভিন্ন গ্রামে প্রতিবাদী হাজং কৃষকদের ধর-পাকড় করতে শুরু করে। সে লক্ষ্যেই ৩১ জানুয়ারি সকাল ১০টার সময় বিরিশিরি থেকে চার মাইল উত্তরে বহেরাতলী নামক গ্রামে তারা তল্লাশি চালায়। লক্ষ্য ছিল কুমুদিনীর স্বামী লংকেশ্বর হাজং ও লংকেশ্বরের বড় তিন ভাইসহ যারা টংক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের ধরে নিয়ে আসা। কিন্তু এদিনে এ গ্রামের বিদ্রোহী হাজং কৃষক নর-নারীরা প্রতিবেশিদের টঙ্ক বিরোধী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতে পাশের গ্রামে অবস্থান করছিল। বহেরাতলী গ্রামে কুমুদিনীর স্বামী লংকেশ্বর হাজং বা কোন পুরুষ সদস্যকে না পেয়ে ক্ষিপ্ত পুলিশ বাহিনী কুমুদিনীকে ধরে নিয়ে বিরিশিরি ক্যাম্পের দিকে রওনা হয়। সদ্য বিবাহিতা কুমুদিনীর বয়স ছিল মাত্র ১২ কিংবা ১৩ বছর।
সেদিন কুমুদিনীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সংবাদটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে সাথে সাথে মহীয়সী নারী নেত্রী রাশিমণি হাজংয়ের নেতৃত্বে শতাধিক হাজং নারী-পুরুষ সশস্ত্র বাহিনীর পথরোধ করেন। তিনি সামনের সারিতে গিয়ে কুমুদিনী হাজংকে বাঁচাতে পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সে সময় তিনি বজ্রকণ্ঠে বলেন- ‘ময় তিমাদ, এগরা তিমাদ হুয়ে ময়, তিমাদলা মান রুক্ষা কুরিব, না-তে মুরিব, তুরা তুমলা নীতি নিয়া বুইয়া থাক।’ হাজং ভাষায় বলা এ কথার অর্থ হচ্ছে- ‘আমি নারী, নারী হয়ে আমি আরেক নারীর সম্ভ্রম রক্ষা করবো, মরতে হয় মরব। তোমরা তোমাদের নীতি নিয়ে বসে থাক।’ এটা বলার সাথে সাথে দলের অন্য সদস্যরাও যুদ্ধে ঝাপিয়ে পরে। পুলিশ বাহিনী এসময় নৃশংসভাবে তাদের ওপর গুলি চালায়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে পেছন থেকে আসা গুলির আঘাতে রাশিমণি হাজং মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পেছনে পুরুষ দলের নেতা সুরেন্দ্র হাজং রাশিমণিকে ধরতে গেলে তাকেও নির্দয়ভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এভাবে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলে। খবর পেয়ে কয়েক গ্রামের যুবকরা তাদের অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে দৌঁড়ে আসে। তারা পুলিশের দিকে বল্লম ছুড়তে থাকে। হাজংদের বল্লমের আঘাতে দুইজন মারা যায়। ওইদিন হাজং চাষিদের রক্তে সিমসাং নদীর বালুকাময় তীরভূমি রক্তে রঞ্জিত হয়। আদিবাসীদের প্রতিরোধের মুখে পুলিশ সদস্যরা কুমুদিনীকে রেখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
১৯৫০ সালে ক্ষমতায় আসে মুসলিম লীগ। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন সুসং এলাকায় জনসভা করেন। তিনি বক্তৃতায় সেখানে টংক উঠিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন। আন্দোলনকারী হাজং কৃষকরাও তখন আশায় বুক বাঁধেন। ১৯৫০ সালে টঙ্ক প্রথা তুলে দেয়া হলেও আদিবাসী হাজংদের উপর নেমে আসে শাসনের কালোছায়া। সরকার তাদের ওপর আরেক অত্যাচার শুরু করে। সীমান্ত এলাকায় বিদ্রোহী দমনের নাম করে হাজংদের উচ্ছেদের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। হাজং গ্রামগুলোতে চালানো হয় বিভীষিকাময় অত্যাচার। হাজংদের সংখ্যালঘু করতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মুসলমান কৃষকদের এনেও বসিয়ে দেওয়া হয় সুসং এলাকায়। ফলে হাজং কৃষকদের দুঃখের দিন আর শেষ হয় না। টঙ্ক আন্দোলনে যে হাজংরা রক্ত দিল, টঙ্ক প্রথা বাতিলের পর সেই হাজংদেরই দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হলো। লক্ষাধিক হাজং ছিল তখন। নির্মম অত্যাচারে টিকতে না পেরে অধিকাংশ হাজং বাধ্য হয়ে আশ্রয় নেয় ভারতের আসামে। আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী রাশিমণির স্মরণে ২০০৪ সালের ৩১ জানুয়ারি বহেরাতলী গ্রামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়।
তাই বিপ্লবী এই নারীকে তাঁর ৭৫তম শহীদ দিবসে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। এমনই প্রতিবাদী ও সচেতন আদিবাসী নারী জন্ম নিক আদিবাসীদের ঘরে ঘরে।