হিল ভয়েস, ২ ডিসেম্বর ২০২০, বিশেষ প্রতিবেদন: বর্তমানে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের পরিবর্তে পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের মতো সামরিক উপায়ে পার্বত্য সমস্যা সমাধানের পথ কার্যত বেছে নেয়া হয়েছে এবং তদুদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন জোরদার করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৩তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ২ ডিসেম্বর ২০২০ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির এক প্রতিবেদনে সমিতি এই অভিমত তুলে ধরেন।
জনসংহতি সমিতির প্রতিবেদনে বলা হয় যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আজ ২৩তম বর্ষপূর্তি। বিগত ২৩ বছরে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির কিছু ধারা-উপধারা বাস্তবায়িত হলেও এখনো দুই-তৃতীয়াংশ ধারা অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে। বিশেষ করে চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ হয় সম্পূর্ণ অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে নতুবা ত্রুটিপূর্ণভাবে আংশিক বাস্তবায়িত করা হয়েছে।
চুক্তির বাস্তবায়িত বিষয়সমূহ: চুক্তি মোতাবেক নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে জনসংহতি সমিতি তার করণীয় সবকিছু সম্পাদন করেছে। চারদফায় অস্ত্র ও গোলাবারূদ জমা দিয়ে জনসংহতি সমিতির সকল সদস্য স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন। অপরদিকে সরকারের তরফ থেকে বাস্তবায়িত বিষয়সমূহের মধ্যে প্রতিবেশী ত্রিপুরা রাজ্যে আশ্রিত জুম্ম শরণার্থীদের ফিরিয়ে আনা; পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন প্রণয়ন; পাঁচ শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্পের মধ্যে ১০০টি ক্যাম্প প্রত্যাহার; অন্তর্বর্তীকালীন আঞ্চলিক পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন; চুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটি, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন এবং ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্স গঠন; তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে কতিপয় বিষয় হস্তান্তর ইত্যাদি অন্যতম।
চুক্তির অবাস্তবায়িত বিষয়সমূহ: পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অবাস্তবায়িত মূল বিষয়সমূহের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে আইনী ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা; পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদিসহ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও কার্যাবলী হস্তান্তর করা; নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়ন পূর্বক তিন পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং তদনুসারে আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা; ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক একপ্রকার সেনাশাসনসহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা; ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে বেহাত হওয়া জুম্মদের জায়গা-জমি ফেরত দেয়া; ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের তাদের স্ব স্ব জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ পূর্বক পুনর্বাসন প্রদান করা; অস্থানীয়দের নিকট প্রদত্ত ভূমি ইজারা বাতিলকরণ; পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকরিতে জুম্মদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ করা; চুক্তির সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে ১৮৬১ সালের পুলিশ এ্যাক্ট, পুলিশ রেগুলেশন ও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য অন্যান্য আইন সংশোধন; পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সেটেলার বাঙালিদের সম্মানজনক পুনর্বাসন করা ইত্যাদি অন্যতম।
চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের টালবাহানা: বিগত ২৩ বছরের মধ্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের ৫ বছর ও ড. ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন ২ বছর বাদে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরকারী সরকার প্রায় ১৬ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে। এই দীর্ঘ ১৬ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার কোন কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে এগিয়ে আসেনি বলে বলা যেতে পারে।
চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে এখনো তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। বিগত ২৩ বছরেও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচনের জন্য নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণীত হয়নি। আঞ্চলিক পরিষদের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত দু’টি খসড়া বিধিমালা সরকারের নিকট জমা দেয়া হলেও সরকার সেগুলো বছরের পর বছর ধরে ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছে। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের ৩৩টি কার্যাবলীর মধ্যে ১৭টি বিষয়/কার্যাবলী হস্তান্তরিত হয়েছে। তবে তার মধ্যে ১২টি বিষয় অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। কিন্তু সরকার রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে ২৮টি করে এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে ২৬টি বিষয় হস্তাস্তর করা হয়েছে বলে অপপ্রচার করছে। অপরদিকে গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী যেমন – জেলার আইন-শৃঙ্খলা তত্ত্বাবধান, সংরক্ষণ ও উহার উন্নতি সাধন; ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা; পুলিশ (স্থানীয়); বন ও পরিবেশ; যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়সমূহ এখনো হস্তান্তর করা হয়নি।
ত্রুটিপূর্ণভাবে হস্তান্তরিত বিষয়সমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে স্থানীয় পর্যটন। এই বিষয়টি ২০১৪ সালে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের নিকট হস্তান্তরিত করা হয় নামমাত্র এখতিয়ার দিয়ে। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের বা অন্য কোন সংস্থার দ্বারা পরিচালিত কোন দপ্তর ও পর্যটন কেন্দ্র পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের নিকট হস্তান্তরিত হয়নি। কেবল পার্বত্য জেলা পরিষদের নিজস্ব অর্থায়নে গৃহীত পর্যটন প্রকল্প ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের এখতিয়ার রাখা হয়নি, যা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সাথে সম্পূর্ণভাবে বিরোধাত্মক। এর ফলে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও কর্তৃপক্ষ, সেনাবাহিনী ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান জুম্মদের জায়গা-জমি জবরদখল করে এবং পার্বত্য চুক্তি ও আইনকে তোয়াক্কা না করে তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা করে চলেছে। যার ফলে স্থানীয় জুম্মদের জীবনজীবিকা বিপন্ন হয়ে পড়ছে এবং নানাভাবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সমস্যা উদ্ভব হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮ যথাযথভাবে প্রণীত হলেও উক্ত আইন এখনো যথাযথভাবে কার্যকর করা হয়নি। ফলে আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের উন্নয়ন কর্মকান্ড, তিন পার্বত্য জেলার সাধারণ প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা, আ লিক পরিষদের সাথে আলোচনাক্রমে ও ইহার পরামর্শক্রমে আইন প্রণয়ন, এনজিও কার্যক্রম এবং দুর্যোগ ও ত্রাণ ইত্যাদি যাবতীয় বিষয়াদি তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধন করার কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। একদিকে তিন পার্বত্য জেলার ডেপুটি কমিশনারগণ ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধির দোহাই দিয়ে পূর্বেকার মতো জেলার সাধারণ প্রশাসন সম্পর্কিত সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করে চলেছেন, অন্যদিকে আঞ্চলিক পরিষদের তত্ত্বাবধান ও সমন্বয় সাধনের এখতিয়ারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও উন্নয়ন বোর্ড ইহার সামগ্রিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হওয়ার পর এখনো পর্যন্ত “পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ প্রধান কার্যালয়, বাসভবন ও এতদসংশ্লিষ্ট কমপ্লেক্স নির্মাণ শীর্ষক” প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়নি।
পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ সংস্থা হচ্ছে আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ। এই পরিষদসমূহের উপর সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা ও যাবতীয় উন্নয়ন কার্যক্রমের দায়িত্ব ও ক্ষমতা ন্যস্ত রয়েছে। তদুদ্দেশ্যে চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য সকল আইন, বিধি ও প্রবিধান পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক সংশোধনের বিধান রয়েছে। তাই আঞ্চলিক পরিষদের তরফ থেকে ১৯০০ সালের শাসনবিধি, ১৮৬১ সালের পুলিশ এ্যাক্ট, ১৯২৭ সালের বন আইনসহ পার্বত্য অঞ্চলে প্রযোজ্য আইনসমূহ সংশোধনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে কোন কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বরং সেনা কর্তৃত্বের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে তিন পার্বত্য জেলার ডেপুটি কমিশনার ও পুলিশ সুপারের মাধ্যমে সরকার জেলার সাধারণ প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে অপপ্রয়োগ করে চলেছে, যা পার্বত্য চুক্তির সাথে বিরোধাত্মক।
চুক্তিতে সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও স্থায়ী সেনানিবাস (তিন জেলা সদরে তিনটি এবং আলিকদম, রুমা ও দীঘিনালা) ব্যতীত সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহারের বিধান থাকলেও বিগত ২৩ বছরে শেখ হাসিনা সরকার মাত্র ১০০টি অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করেছে। এখনো ৪ শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্প পার্বত্য চট্টগ্রামে বলবৎ রয়েছে। অধিকন্তু চুক্তিকে লঙ্ঘন করে ২০০১ সালে শেখ হাসিনা সরকার ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক সেনাশাসন জারি করে। বর্তমানে পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে প্রধান বাধা হিসেবে রয়েছে এই ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক সেনাশাসন ও চার শতাধিক অস্থায়ী ক্যাম্পের সেনা কর্তৃত্ব।
২০০১ সালের ১৭ জুলাই জনসংহতি সমিতি ও আঞ্চলিক পরিষদের সাথে কোনরূপ আলোচনা না করে শেখ হাসিনা সরকার ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১’ জাতীয় সংসদে পাশ করে। ফলে চুক্তিতে স্বীকৃত অধিকার ও এখতিয়ারকে খর্ব করে উক্ত আইনে কমপক্ষে ১৪টি ধারা চুক্তির সাথে বিরোধাত্মকভাবে প্রণীত হয়। ২০০৯ সালে পুনরায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ফিরে আসার পর শেখ হাসিনা সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১-এর বিরোধাত্মক ধারা সংশোধন করতে আবার নানা টালবাহানা করতে থাকে। অবশেষে ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে আইনটি সংশোধন করা হয়। কিন্তু এরপর শেখ হাসিনা সরকার আবার ভূমি কমিশনের বিধিমালা প্রণয়নে বিগত ৪ বছর ধরে টালবাহানা করে চলেছে। ভূমি কমিশনের এই বিধিমালা এখনো পর্যন্ত প্রণীত না হওয়ায় ভূমি কমিশন ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির বিচারিক কাজ শুরু করতে পারেনি। বিগত ২৩ বছরেও ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ায় ভূমি বিরোধকে কেন্দ্র করে সরকার ও জুম্ম জনগণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব-সংঘাত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
টাস্কফোর্স গঠিত হলেও টাস্কফোর্সকে পর্যাপ্ত তহবিল, প্রয়োজনীয় জনবল ও পরিসম্পদ বরাদ্দ করা হয়নি। অন্যদিকে জুম্ম আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু ও ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের তাদের স্ব স্ব জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ পূর্বক পুনর্বাসনের কাজ এখনো যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ভারত-প্রত্যাগত ১২,২২২ শরণার্থী পরিবারের মধ্যে এখনো ৯,৭৮০ পরিবার তাদের ধান্যজমি, বাগান-বাগিচা ও বাস্তুভিটা ফেরৎ পায়নি। এছাড়া প্রত্যাগত শরণার্থীদের ৪০টি গ্রাম সেটেলারদের বেদখলে রয়েছে এবং স্বউদ্যোগে ও ১৬-দফা প্যাকেজ চুক্তি মোতাবেক প্রত্যাগত প্রায় ৫৪ হাজার শরণার্থী রেশন প্রাপ্তি থেকে বিমত রয়েছে।
অপরদিকে এখনো জুম্ম (উপজাতীয়) আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন করা হয়নি। ফলে জুম্ম উদ্বাস্তুরা এখনো দুর্গম পাহাড়ে ও রিজার্ভ ফরেস্টে শিক্ষা, চিকিৎসা, উন্নয়ন সুবিধা থেকে বিরত হয়ে মানবেতর জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। ১৯৯৮ সালে শেখ হাসিনা সরকার পার্বত্য চুক্তিকে লঙ্ঘন করে সেটেলারদেরকেও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে গণ্য করে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে। শেখ হাসিনা সরকারের চুক্তি বিরোধী এই উদ্যোগের ফলে আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া মুখ থুবড়ে পড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়া সত্ত্বেও সরকার সেটেলারদের পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের উক্ত চুক্তি পরিপন্থী আদেশ এখনো বাতিল করেনি।
উল্লেখ্য যে, সেটেলার বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসনের জন্য দুই পক্ষের মধ্যে অলিখিত চুক্তি/সমঝোতা ছিল। শেখ হাসিনা সরকার এ বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলে জনসংহতি সমিতিকে বার বার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ ঢাকায় পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের পর জনসংহতি সমিতির প্রতিনিধিদলের সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাতের সময়ও শেখ হাসিনা এ বিষয়ে পূর্ণ প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। কিন্তু সরকার অলিখিত চুক্তি অনুযায়ী সেটেলারদের সমতলে পুনর্বাসনের ব্যাপারে এযাবৎ কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। বর বহিরাগত সেটেলারদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় ও সম্প্রসারণ করতে থাকে।
চুক্তিতে তিন পার্বত্য জেলায় স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদানের ক্ষমতা তিন সার্কেল চীফের উপর অর্পণ করা হলেও শেখ হাসিনা সরকার চুক্তির এই বিধানকে সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘন করে ২১ ডিসেম্বর ২০০০ এক কার্যাদেশের মাধ্যমে তিন সার্কেল চীফ ছাড়াও তিন পার্বত্য জেলার ডেপুটি কমিশনারদের স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করে। বার বার দাবি করা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা সরকার এই অবৈধ ও চুক্তি বিরোধী আদেশ বাতিল করেনি। এই আদেশের ফলে ডেপুটি কমিশনাররা রোহিঙ্গাসহ বহিরাগত লোকদেরকে পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দার সনদপত্র দিয়ে চলেছেন এবং এই সনদপত্রের বদৌলতে স্থানীয়দের অধিকার খর্ব করে বহিরাগতরা পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকরি, ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, ভূমি মালিকানাসহ নানাবিধ সুবিধা লাভ করে চলেছে, যা পার্বত্য চুক্তির সাথে সম্পূর্ণ বিরোধাত্মক।
সংবিধান সংশোধনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে শেখ হাসিনা সরকার কর্তৃক পার্বত্য চুক্তির সাংবিধানিক গ্যারান্টি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে মর্মে আনুষ্ঠানিক বৈঠক চলাকালে প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হলেও সরকার কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। বিশেষ করে ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইনগুলোর ‘আইনী হেফাজত’ প্রদানের জন্য সংবিধানের প্রথম তফসিলে ‘কার্যকর আইন’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করা হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার সেই দাবির প্রতি বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ‘২৩ক’ নামে “উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়” সংক্রান্ত একটি নতুন অনুচ্ছেদ সংযোজন করা হয়েছিল বটে, তবে তার দ্বারা পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক প্রণীত আইনগুলোর সাংবিধানিক রক্ষাকবচ নিশ্চিত হয়নি।
বর্তমান পরিস্থিতি: বর্তমানে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের পরিবর্তে পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের মতো সামরিক উপায়ে পার্বত্য সমস্যা সমাধানের পথ কার্যত বেছে নেয়া হয়েছে এবং তদুদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিকায়ন জোরদার করা হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় নতুন নতুন ক্যাম্প স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জনসংহতি সমিতিসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের দাবিতে সোচ্চার ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী’, ‘চাঁদাবাজ’, ‘অস্ত্রধারী দুর্বৃত্ত’ হিসেবে পরিচিহ্নিত করার জন্য ব্যাপক অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আনাচে-কানাচে সেনা অভিযান, ঘরবাড়ি তল্লাসী, গ্রেফতার, ক্রশফায়ারের নামে বিচার-বহির্ভুত হত্যা, ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দায়ের ইত্যাদি জোরদার করা হয়েছে। একদিকে ভাড়াটে হলুদ সাংবাদিকদের মাধ্যমে জনসংহতি সমিতি তথা জুম্ম জনগণ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম সম্পর্কে অপপ্রচার করা, অন্যদিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমিতির স্বাধীনতা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংবাদ প্রকাশের উপর বিধি-নিষেধ আরোপের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে কার্যত অবরুদ্ধ অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে। ফলে সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতনের খবর সম্পূর্ণভাবে দেশের সংবাদ মাধ্যম ও দেশবাসীর অন্তরালে থেকে যাচ্ছে। এভাবেই আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি চুক্তি-পূর্ব পরিস্থিতির মতো অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় হয়ে উঠছে।
জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও সংস্কৃতি বিধ্বংসী তথাকথিত উন্নয়ন কার্যক্রম (ডেভেলাপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং) গ্রহণের মাধ্যমে জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জুম্মদের দুই লক্ষাধিক একর ভোগদলীয় জুমভূমি ও মৌজাভূমিকে একতরফাভাবে রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা, বহিরাগতদের নিকট হাজার হাজার একর ভূমি ইজারা প্রদান, সেনা ছাউনি স্থাপন ও সম্প্রসারণের নামে হাজার হাজার একর ভূমি অধিগ্রহণ, সেনাবাহিনীর পর্যটন শিল্পের জন্য শত শত একর পাহাড় বেদখল, সেটেলারদের গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণ ও বহিরাগতদের অব্যাহত বসতিপ্রদান, জুম্ম জনগণের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা ও গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া, জুম্ম নারী ও শিশুদের উপর সহিংসতা ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে জুম্ম জনগণকে তাদের চিরায়ত ভূমি ও বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনী তাঁবেদার সংগঠন সংস্কারপন্থী খ্যাত জেএসএস (এমএন লারমা), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও মগপার্টি নামে খ্যাত এএলপি থেকে দলচ্যুত সশস্ত্র সদস্যদের রাঙ্গামাটি জেলার সুবলং বাজার, লংগদু উপজেলার তিনটিলা, দীঘিনালার বাবুছড়া, রাঙ্গামাটির কাপ্তাই ও রাজন্থলীসহ খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের সদর জেলার বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্রভাবে মোতায়েন রেখে চুক্তি স্বাক্ষরকারী জনসংহতি সমিতির সদস্য ও চুক্তি সমর্থকদের উপর সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর নাকের ডগায় এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠী লক্ষ লক্ষ টাকার চাঁদাবাজি করে চলেছে।
এভাবেই সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবর্তে পূর্ববর্তী স্বৈরশাসকদের মতোই সামরিকায়ন ও দমন-পীড়নের মাধ্যমে পার্বত্য সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে ভূলণ্ঠিত করে সত্তর দশকের মতো জুম্ম জনগণকে আবারো দূরে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতির পরিবর্তে বর্তমান সরকারের জুম্ম জনগণকে দূরে ঠেলে দেয়ার ভুল নীতি গ্রহণের ফলে চুক্তি-পূর্ব সময়ের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আবারো অশান্ত হয়ে উঠছে।