মিঠুল চাকমা বিশাল
২ রা ডিসেম্বর, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের কাছে একটি ঐতিহাসিক দিন। অবশ্য কেবল জুম্ম জনগণের কাছেই নয়, সমগ্র বাংলাদেশের কাছেও একটি ঐতিহাসিক দিন। দীর্ঘ দুই দশকের স্বশস্ত্র সংগ্রাম ছেড়ে আজকের এই দিনে একঝাঁক লড়াকু সৈনিক তাদের স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তন করে। নিজেদের স্বপ্ন আর প্রত্যাশাকে যেন সেদিন জুম্মরা অতি নিকট থেকে দেখতে পেয়েছিল। একটি সুন্দর জীবন, নিরাপদ ভবিষ্যত আর দেশের অপরাপর জনগোষ্ঠীর মতন অধিকার ভোগ করার স্বপ্ন যেন সেদিন আকাশ ছুঁয়েছিল। পারিবারিক মায়া আর সংসার জীবনের প্রেমকে ছেড়ে যারা এতদিন নিজেদের জীবন থেকে একেকটি সুবর্ণ দিনকে বিদায় দিয়ে আসছিল, তাদের জীবনে নবপ্রাণের সঞ্চার হয়েছিল সেদিন, যেদিন প্রধানমন্ত্রীর কন্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছিল ‘যুদ্ধ নয়,শান্তি চায়; ধ্বংস নয়, সৃষ্টি চায়; পশ্চাৎপদতা নয়, অগ্রগতি চায়।’
কিন্তু ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, আজকের এই সময়ে এসে হতাশা আর নিরাশার সুরে আমাদের বলতে হচ্ছে, রাষ্ট্র আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। সেদিনের সেই শান্তির কপোত যেন আকাশে উড়বার আগেই মাটিতে লুঠিয়ে পড়েছিল। প্রকৃতপক্ষে আমাদের রাজনৈতিক অধিকারের দাবিটিকে রাষ্ট্র সম্মান জানাতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অশান্ত পার্বত্য চট্টগ্রামকে শান্ত করার বদলে নয়া-কায়দায় অশান্ত আর উত্তপ্ত করার হীন ষড়যন্ত্র করেছে। যার জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার ২৩টি বছর পরেও এখন আনন্দ-উল্লাসের বদলে হতাশায় ও ক্ষোভে বলতে হচ্ছে, ‘পার্বত্য চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চায়।’
চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার ২৩টি বছরে এসেও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ক্ষমতাসীন সরকারের জবাব, তারা চুক্তির ৪৮টি ধারা বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু বিষয়টাতো কয়টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হলো, কয়টি আংশিকভাবে বাস্তবায়ন হলো সেটা নয়। বিষয়টা হচ্ছে চুক্তি কেন পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না! চুক্তির ২৩টি বছর পরেও কেন চুক্তি বাস্তবায়নের দাবি নিয়ে রাজপথ, সভা-সমিতি উত্তপ্ত করতে হচ্ছে? রাষ্ট্রের এটি ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, চুক্তির কোন দাড়ি, কমা কিংবা ফুলস্টপও যদি বাস্তবায়নের পথ থেকে বাদ পড়ে যায়, তারপরেও চুক্তিকে বাস্তবায়িত হয়নি বলেই গণ্য করা হবে। সুতরাং এসব গালভরা বুলি আর মিথ্যার প্রলোভন দেখিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের পথ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার অর্থ হচ্ছে, নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার সমমান। উল্লেখ্য যে, চুক্তি স্বাক্ষরকারী সরকার দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলেও চুক্তি বাস্তবায়নে তারা সেরকম উল্লেখযোগ্য কোন পদক্ষেপ নিতে পারে নি। বরং তাদের সময়েই বেশি করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভূমি বেদখল ও পাহাড়ি নারী ধর্ষণের মত জঘন্য সব ঘটনা ঘটেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে সাংবিধানিক আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কথা বলা হলে, তখনকার সময়ে আওয়ামীলীগ সরকারের বক্তব্য ছিল, তারা যখনই সংসদে সংখ্যাগরিষ্ট আসন লাভ করবে, তখন সেটি (চুক্তি) সাংবিধানিক আইনে পরিণত করতে সংসদে উত্থাপন করবে। কিন্তু ২০০৮ সাল থেকে বর্তমান অবধি আওয়ামীলীগ সরকারের সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও, চুক্তিকে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং একটি সাংবিধানিক আইন হিসেবে গ্রহণ করার বিষয়টিকে তারা বরাবরই উপেক্ষা করেই চলেছে। অন্যদিকে বহিরাগত অনুপ্রবেশকারীদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসনের বিষয়টিকেও তারা এখন আর আমলে নিতে চায় না। বরং প্রতিনিয়ত নিরাপত্তা বাহিনীর প্রহরায় বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ করানো হচ্ছে এবং পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকায় বাঙালি সেটেলারদের বসতি প্রদান করা হচ্ছে।
যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রাম ঐতিহাসিকভাবে একটি বিশেষ অঞ্চল এবং এর শাসনব্যবস্থাও বৈচিত্র্যমন্ডিত। ব্রিটিশ সরকার তাই এতদঞ্চলের বৈচিত্র্যতা সংরক্ষণে ১৯০০ সালের শাসনবিধি প্রণয়ন করেছিল, যেটির বৈধতা এখনো আছে বলে ২০১৬ সালে হাইকোর্টও রায় প্রদান করে। ঐ বিশেষ শাসনব্যবস্থাকেই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে আরো জোড়ালোভাবে, আঞ্চলিক পরিষদ এবং জেলা পরিষদের সমন্বয়ে এক বিশেষ শাসন কাঠামো প্রণয়নের মধ্যদিয়ে। তাছাড়াও চুক্তির ১ম ধারাতেই এই অঞ্চলকে উপজাতি (জুম্ম) অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে এর বৈশিষ্ট্যকে সংরক্ষণ করার কথা বলা হয়েছে।
কিন্তু দু:খজনক, সরকার জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের বিপরীতে ব্যাপক ট্রান্সমাইগ্রেশন ঘটিয়ে এই অঞ্চলের জনমিতিতে পরিবর্তন এনে, এর বৈশিষ্ট্যকে ক্ষুণ্ন করে চলেছে। সরকার আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮ এবং জেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮(সংশোধিত) প্রণয়ন করলেও জেলা পরিষদের নির্বাচনের জন্য কোন উদ্যেগ গ্রহণ করে নি। অন্যদিকে এই পরিষদসমূহের নির্বাচনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভেটার তালিকা প্রণয়নের বিষয়েও সরকারের পক্ষ হতে কোন উদ্যোগ দেখা যায় নি। জেলা পরিষদের নির্বাচন না হওয়ার ফলে, আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা যাচ্ছে না। অন্যদিকে ০৫ সদস্যবিশিষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন জেলা পরিষদকে ১৪ সদস্যে উন্নীত করে পরিষদে দুর্নীতির পথকে আরো প্রশস্ত করে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে এই পরিষদে প্রতিনিয়ত দলীয় মনোনীত সদস্যদের নিয়োগের ফলে সেটি এখন দলীয় পরিষদে পরিণত হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল সমস্যা ভূমি সমস্যা। ২০০১ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকার আঞ্চলিক পরিষদের সাথে কোনারূপ আলোচনা ছাড়াই মনগড়াভাবে ভূমি কমিশন আইন-২০০১ প্রণয়ন করে। উক্ত আইনটিতে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী অনেকগুলো ধারা সংযোজন করা হয়। ফলশ্রুতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও জনসংহতি সমতির আপত্তিতে দীর্ঘ ১৫ বছর পরে আওয়ামীলীগ সরকার রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে অধ্যাদেশ জারি করে সেটি সংশোধন করে ভূমি কমিশন আইন-২০১৬(সংশোধিত) প্রণয়ন করে। কিন্তু ভূমি কমিশন আইন সংশোধন করা হলেও ভূমি কমিশনের জন্য প্রয়োজনীয় বিধি, প্রতিষ্ঠান কিংবা জনবল নিয়োগের বিষয়টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। ফলে ভূমি কমিশন তার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। অপরদিকে সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পসমূহ সরিয়ে নেয়ার কথা চুক্তিতে উল্লেখ থাকলেও বর্তমান সময়ে আরো বেশি করে সেনাক্যাম্প সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। প্রতিনিয়তই পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমিকে দখল করে গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন নতুন ক্যাম্প। যা পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে এক ভিন্ন দিকে ধাবিত করছে।
বস্তুতপক্ষে, সরকার বর্তমান সময়ে চুক্তি বাস্তবায়নের পথ থেকে বহুদূর সরে গিয়েছে। ২০১৪ সালে স্থানীয় পর্যটন এবং ২০১৬ সালে ভূমি কমিশন আইন সংশোধনের পর হতে সরকারের পক্ষ হতে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য তেমন কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায় নি। অপরপক্ষে চুক্তির বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা চুক্তি বিরোধী বিভিন্ন অপশক্তি সৃষ্টি করে দিয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের পথকে রোধ করে রাখা হয়েছে। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরেও পাহাড়ে ২০টির অধিক সাম্প্রদায়িক হামলা, নিরাপত্তা বাহিনীর ক্যাম্প সম্প্রসারণের নামে ৭১,৮৭৭ একরের অধিক ভূমি দখল, সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও রিজার্ভ ফরেস্টের নামে ১,১৮,০০০ একর ভূমি বেদখল এবং পর্যটনের নামে হাজার হাজার একর ভূমি দখল করা হয়েছে। জুম্ম জনগণের পক্ষ হতে চুক্তি স্বাক্ষরকারী অন্যতম সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বকে ধ্বংস করতে একের পর এক মিথ্যা ও সাজানো মামলা দায়ের করা হয়েছে। অস্ত্রবাজি আর চাঁদাবাজির নামে বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশি অভিযান করে জনমনে আতঙ্ক ও হয়রানি সৃষ্টি করা হচ্ছে।
অন্যদিকে ২০১১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হতে ১১টি বৈষম্যমূলক ও সাম্প্রদায়িক নির্দেশনা জারি করা হয়, যা সম্পূর্ণ পার্বত্য চুক্তি বিরোধী এবং জুম্ম বিধ্বংসী কার্যকলাপ। তাছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসিত বহিরাগতদেরকে নিয়ে কথিত সম-অধিকার আন্দোলন, বাঙালী ছাত্র পরিষদ, পার্বত্য নাগরিক পরিষদ ইত্যাদি ভূঁইফোড় সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে জনসংহতি সমিতি এবং জুম্ম জনগণের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ারররূপে দাঁড় করানো হয়েছে। একইসাথে উক্ত সংগঠনগুলোর মাধ্যমে পাহাড়ে সাম্প্রদায়িকতা আর মৌলবাদের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে এখন এক ভিন্ন মাত্রায় পরিবর্তিত করা হচ্ছে। দেশের ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্ট মিডিয়া এবং সোশ্যাল মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে উদ্দেশ্যমূলক ও উস্কানিমূলক সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে। চুক্তি বাস্তবায়নের কোন উদ্যোগ না নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে, চাঁদাবাজি আর অস্ত্রবাজির মতন ভিন্ন ইস্যুগুলিকে প্রধান করে সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। অন্যদিকে, রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মদদে গড়ে তোলা লেজুর বাহিনী দিয়ে প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজি আর অস্ত্রবাজির দ্বারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে আবারো সত্তর-আঁশির দশকের ন্যায় অস্থিতিশীল করে তোলা হচ্ছে। অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করে তুলে এখানে সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতিকে বৈধতা দেওয়ার হীন পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় পাহাড়ে যে স্বপ্ন, আশা এবং আকাঙ্খা নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল, সেটি এখন সুদূর পরাহত। রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং তাদের লেজুর বাহিনীর অত্যাচারে জনজীবন আজ বিপর্যস্ত। স্বভাবতই পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও বর্তমান সময়ে এসে শান্তির বিন্দুমাত্র চিহ্নটিও এখন আর নেই। বরং দিন দিন পাহাড়কে আবারো অশান্ত করা হয়েছে, জুম্ম জনগণের উপরে আবারো একটি অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। আর এই অন্যায় যুদ্ধের ফল কি হতে পারে, কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটি সময়ই বলে দেবে।