সুহৃদ চাকমা
২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৩তম বর্ষপূর্তি পূর্ণ হতে চলেছে। চুক্তি স্বাক্ষরের দীর্ঘ ২৩ বছর পরেও পার্বত্য চট্টগ্রামের আপামর জুম্ম জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা সরকার এখনও পূরণ করতে পারেনি। ১৯৯৭ সালে ২ ডিসেম্বর সেদিন পাহাড়ের মানুষ অঢেল আশায় বুক বেঁধেছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে পাহাড়ের বুকে শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জিত হবে, জুম্ম জনগণ তাদের বেঁচে থাকার মৌলিক মানবাধিকার অর্জন করবে, নিপীড়িত জুম্ম জনগণের তিলে তিলে সঞ্চিত স্বপ্ন ও আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো বাস্তবে পূরণ হবে! কিন্তু পার্বত্যবাসীদের সেইসব লালিত স্বপ্ন ও আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো আজ নিরাশার চোরাবালিতে ডুবিয়ে রেখে জুম্ম জনগণকে বিলুপ্তিকরণের জন্য শাসকগোষ্ঠীর চূড়ান্ত আয়োজন চলছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মাধ্যমে দেশের শাসকগোষ্ঠী জুম্ম জনগণসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী অধিবাসীদের স্বশাসন প্রদানের যে অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আজ সেই চুক্তির অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি শাসকগোষ্ঠী নিজেই প্রতি পদে পদে ভূলুণ্ঠিত করে চলেছে।
ইতিমধ্যে চুক্তি পক্ষে জুম্ম জনগণের মনের ভেতর শাসকগোষ্ঠীর প্রতি তীব্র ক্ষোভ, হতাশা ও ঘৃণা দানা বেঁধেছে এবং জুম্ম জনগণের এই ক্ষোভ, হতাশা ও তীব্র ঘৃণা তুষের আগুনের মতোই পুষে উঠছে। পাহাড়ের বুকে চুক্তি পক্ষ আর বিপক্ষের মধ্যে নানান অনুযোগ-অভিযোগের কাটা ছুড়াছুড়ি শুরু হয়েছে। চুক্তির পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও পাহাড়ের স্থায়ী অধিবাসীদের অভিযোগ ২৩ বছরেও সরকার চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করেনি! আর সরকারের পক্ষে বলা হচ্ছে, চুক্তির অধিকাংশ ধারা বাস্তবায়ন করা হয়েছে! শাসকগোষ্ঠীর এধরনের একতরফা ও গোয়েবলসীয় প্রোপাগাণ্ডার কারণে শাসকগোষ্ঠী ও জুম্ম জনগণের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে। এহেন পরিস্থিতি ও বাস্তবতায় সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে সমগ্র জুম্ম জনগণ এবং দেশের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিকে এক কাতারে সামিল হওয়া ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। তা না হলে শাসকগোষ্ঠী ও তার তাবেদার বাহিনীর চুক্তির বিষয়ে মিথ্যাচার কখনো থামবে না, এধরণের গোয়েবলসীয় মিথ্যাচার চলতে থাকবে!
উল্লেখ্য যে, গত ২৬-২৭ নভেম্বর ২০২০ পর পর দুইটি দৈনিক পত্রিকায় পার্বত্য চট্টগ্রামসহ চুক্তি বিষয়ে শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে পুরোপুরি গালভরা মিথ্যার বেসাতি করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। দৈনিক ইত্তেফাক সংবাদের শিরোনাম “পার্বত্য চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ, বছরে ৪শ’ কোটি টাকার চাঁদাবাজি” এবং দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার শিরোনাম “সম্প্রীতির বান্দরবানে এখন অশান্তির কালো মেঘ”-এই দুটি দৈনিক পত্রিকার শিরোনামের উল্লেখিত প্রতিবেদনে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে এবং পুরোপুরি মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে কল্পিত, অবাস্তব, সাজানো, মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে। উক্ত সংবাদে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, “পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হয়েছে। তার মধ্যে চুক্তির মোট ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টির পূর্ণ বাস্তবায়ন, ১৫টির আংশিক বাস্তবায়ন এবং ৯টি ধারার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে”। এই ধারাগুলোর মধ্যে পূর্ণ বাস্তবায়ন হোক কিংবা আংশিক বাস্তবায়ন হোক সত্য হলো এটাই যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো কোনটাই বাস্তবায়ন হয়নি। চুক্তির যে কোন মৌলিক ধারা পূর্ণ বাস্তবায়ন করা না হলে, যতই আংশিক বাস্তবায়ন হোক না কেন, সেটাকে বাস্তবায়ন হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায় না।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে, আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের যে বিধান রয়েছে তা কার্যকর করা হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও তা কার্যকর করা হয়নি। এছাড়াও ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ (স্থানীয়), বন ও পরিবেশ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদি মৌলিক বিষয়গুলো তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হয়নি। আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডসহ সকল উন্নয়ন কার্যক্রম, এনজিও কার্যক্রম, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কার্যক্রম ইত্যাদি সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানের এখতিয়ার কার্যকর করা হয়নি। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি এবং এলক্ষ্যে নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়ন এবং স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা হয়নি। স্ব স্ব জায়গা-জমি প্রত্যর্পণ পূর্বক ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের যে বিধান রয়েছে তা কার্যকর করা হয়নি। ভূমি কমিশনের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি পূর্বক জুম্মদের বেহাত হওয়া জায়গা-জমি ফেরত দেয়া হয়নি। অস্থানীয় নিকট প্রদত্ত ইজারা বাতিল করা হয়নি। শ’ খানেক অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হলেও এখনো পার্বত্য চট্টগ্রাম চার শতাধিক ক্যাম্প বলবত্ রয়েছে এবং ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক একপ্রকার সেনাশাসন কার্যকর রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সেটেলারদের যথাযথ পুনর্বাসনের কথা থাকলেও তা কার্যকর করা হয়নি।
এ থেকে সহজেই বুঝা যায় যে, চুক্তির মধ্যে ৪৮টি বিষয় হোক কিংবা ৬০টি বিষয় পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হোক, কিন্তু চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো পূর্ণ বাস্তবায়ন করা না হলে এই চুক্তির কোন অগ্রগতি, উন্নতি এবং কার্যকারিতা অর্জিত হবে না। শাসকগোষ্ঠীর এমন আচরণেই প্রমাণ হচ্ছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে সরকার মোটেই আন্তরিক নয়! অথচ বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার যথাযথ সমাধানের কোন বিকল্প নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ভূমি অধিকারের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছে, তার যথাযথ বাস্তবায়ন না করে বরং সরকার নিজেই দেশের সামরিক-বেসামরিক আমলা, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠী, অগণতান্ত্রিক পেশি শক্তি ও সংগঠনকে লেলিয়ে দিয়ে প্রতিনিয়ত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে চলেছে। যা দেশের জাতীয় স্বার্থে কখনোই কাম্য নয়!
বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী এখনও পর্যন্ত অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে আন্তরিক নয়। মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৭২-এর সংবিধান বিলের উপর সংসদে দেওয়া তাঁর কয়েকটি কথা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে স্মর্তব্য। তিনি বলেছিলেন, “আমরা অতীতকে ভুলতে পারি না। অতীত যত তিক্তই হোক তাকে টেনে আনতেই হবে। অতীতকে যদি আমরা টেনে না আনি, তার থেকে যদি আমরা শিক্ষা গ্রহণ না করি সেই অতীতের গ্লানিকে যদি আমরা মুছে ফেলার চেষ্টা না করি, তাহলে কেমন করে আমরা সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব, কেমন করে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাব, ভুলের মাশুল আমরা অনেক দিয়েছি আর দিতে চাই না। আবার কেন ভুল হবে? ভুলের মাশুল আবার কেন দিতে হবে? অতীতের নেতৃবৃন্দ যেমন ভুল করেছেন, সেই ভুল আমরা যেন পুনর্বার না করি। অতীতকে আমি ধরে থাকতে চাই, বরং ভবিষ্যতকে কলুষমুক্ত করার জন্যই আমি অতীতের কথা স্মরণ করছি”।
সেই সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণসহ স্থায়ী অধিবাসীদের স্বশাসনের অধিকারকে উপেক্ষিত করা, বাংলাদেশের সকল জনগোষ্ঠীকে সংবিধানে বাঙালি বলিয়া পরিচয় করানোর বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদের ভেতরে-বাইরে এন এন লারমা লড়াই সংগ্রাম করেছিলেন এবং শাসকগোষ্ঠীর কাছে বার বার ধর্ণা দিয়েছিলেন। শাসকগোষ্ঠী এম এন লারমার বক্তব্যকে গুরুত্ব না দেওয়াতে এক সময় তাঁর প্রিয়জন পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের কাছে ফিরে এসে বলেছিলেন, “এভাবে আর হবে না, অন্য রাস্তা ধরতে হবে”। তারই সূত্র ধরে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠীকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ২৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো আজও সরকার বাস্তবায়ন করতে আন্তরিক নয়। জুম্ম জনগণের আজ পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে, পেছনে যাওয়ার কোন রাস্তা নেই, ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ আবারও অন্য পথে হাঁটবার চেষ্টা করবে এবং তার জন্য যদি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তাহলে এর দায়ভার পার্বত্যবাসী নেবে না, বাংলাদেশ সরকারকে সমস্ত দায়ভার কাঁধে নিতে হবে।
দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সময় ধরে পেশিশক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। অদূর ভবিষ্যতেও পেশিশক্তি দিয়ে জুম্ম জনগণকে দাবিয়ে রাখা যাবে যদি মনে করেন তাহলে আমি বলবো শাসকগোষ্ঠী এখনও বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ মৃত্যুর ভয়ে ভিত নয়, মৃত্যুকে পাহাড়ের মানুষ ভয় করে না, মৃত্যুকে তারা জয় করেছে। দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামই তার প্রমাণ! আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, জুম্ম জনগণ তাদের অধিকারের জন্য প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে আপোষহীন লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে আসছে এবং তারমধ্যে দীর্ঘ দুই যুগের অধিক সশস্ত্র লড়াই সংগ্রামের বাস্তব ইতিহাস রয়েছে।
পাহাড়ের এক প্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে দূর্গম অঞ্চলের গভীর অরণ্যে নিজেরাই স্কুল তৈরি করে সেখানকার পাহাড়ের ছেলে-মেয়েদের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি” জাতীয় সংগীত প্রতিদিন গাওয়ার নিয়ম মেনে চলেছিল। তারপরও পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষকে সন্ত্রাসী, দেশদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীর তকমা লাগিয়ে দিয়ে অপমানের যন্ত্রণা আজও আমাদেরকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণসহ স্থায়ী অধিবাসীরা যদি সন্ত্রাসী, দেশদ্রোহী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী হয় তাহলে আমাদের সাথে চুক্তি করলেন কেন? পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ বাংলাদেশ সৃষ্টি হতে আজও পর্যন্ত বাংলাদেশের সংবিধান, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতসহ বাংলাদেশের সবকিছুকে নিজের মনে করে শ্রদ্ধা, সম্মান ও পূর্ণ আনুগত্যতা প্রকাশ করে এসেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি জুম্ম জনগণের মুক্তির সনদ। এই চুক্তির সনদ জুম্ম জনগণের দীর্ঘ দুই যুগের অধিক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রাম ও আপামর জুম্ম জনগণসহ অগ্রভাগে এগিয়ে যাওয়ার শহীদ বীরযোদ্ধাদের কঠোর আত্মত্যাগের ফসল। এই চুক্তি পার্বত্য চট্টগ্রামের যুগ যুগ ধরে পিছিয়ে পড়া বিলুপ্তপ্রায় জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও জন্মভূমির অস্তিত্ব সংরক্ষণ ও বিকাশের একমাত্র ভিত্তি। এই চুক্তি শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বার্থে নয়, সমগ্র বাংলাদেশের অগ্রগতি ও উন্নতির স্বার্থেই সম্পাদিত হয়েছিল। সেজন্য এই চুক্তিকে নিয়ে ঢং বা ন্যাকামি করা যায় না। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী ও তার তাবেদার বাহিনী আজ এই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে ছেলেখেলার পুতুল মনে করে যা ইচ্ছে তাই করে চলেছে। যার ফলে প্রতি পদে পদে সরকারের সামরিক ও বেসামরিক আমলা, পার্বত্য চট্টগ্রামের সরকার দলীয় এমপি, মন্ত্রী ও পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনী এবং ভূঁইফোড় সাম্প্রদায়িক সংগঠন ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর চালিত অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে জুম্মস্বার্থ বিরোধী ও চুক্তি পরিপন্থী কার্যক্রম অবাধে চালিয়ে যাচ্ছে। শাসকগোষ্ঠী ও পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর আশ্রয় প্রশ্রয়ে এই চুক্তি বিরোধী অপশক্তি পাহাড়ের বুকে দিন দিন মাতা ছাড়া দিয়ে উঠেছে। এই অপশক্তি শুধুমাত্র পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য নয়, সমগ্র বাংলাদেশের জন্য একদিন বিষ পোড়া হয়ে থাকবে! অথচ এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এক সময় দেশে-বিদেশে অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছেন, ভারত থেকে ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পুরুষ্কার ভূষিত হয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক ইউনেস্কো থেকে শান্তি পুরুষ্কার লাভ করেছেন। দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে এবং চুক্তির ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। চুক্তি স্বাক্ষরের ফলশ্রুতিতে সরকার ও দেশের জাতীয় স্বার্থে অনেক কিছু অর্জনের পরও এই চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো যথাযথ বাস্তবায়নে সরকার সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসছে না। যার কারণে ২৩ বছর পরেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন হতে পারেনি!
অত্যন্ত আশ্চর্য্যের বিষয় হলো, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল চেতনা লালনকারী রাজনৈতিক দলগুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিকে সমর্থন করলেও চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাদের সুনির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি আজ চোখে পড়েনি। সভা-সমাবেশ বক্তব্যে ও কাগজপত্রের লিখনিতে চুক্তি বাস্তবায়নের বিষয়ে বলিষ্ঠ সমর্থন জানালেও প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করে চুক্তি বাস্তবায়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারেনি। তবে আশার দিক হলো যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেশের নাগরিক সমাজের একটি অংশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তারপরও চুক্তি বিরোধী ও জুম্মস্বার্থ পরিপন্থী সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তি বরং অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক শক্তির চাইতে অধিক তৎপর রয়েছে বলে ধারণা করা যায়। শাসকগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বুকে উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি আজ চুক্তিকে লংঘন করে সেনাক্যাম্প সম্প্রসারণের নামে, নিরাপত্তা বাহিনীর প্রশিক্ষণের নামে, বিজিবি ক্যাম্প সম্প্রসারণের নামে, মসজিদ নির্মাণ করার নামে, পর্যটন ও বড় বড় হোটেল নির্মাণের নামে জুম্মদের জায়গা-জমি বেদখলের মহোৎসবে মেঠে উঠেছে। সাজেকের রুইলুই পর্যটনের নামে পিছিয়ে পড়া পাংখোয়া ও লুসাই জুম্ম জনগোষ্ঠীদের ভূমিহারা করে সর্বশান্ত করা হয়েছে, বান্দরবানে ঐতিহাসিক চিম্বুক পাহাড়ের বসবাসরত পিছিয়ে পড়া ম্রো জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে সেখানেও সেনাবাহিনী ও সিকদার গ্রুপ একযোগে ভূমি জবরদখলের মহোৎসবে মেঠে উঠছে। এছাড়াও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও সংগঠনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বড় বড় কোম্পানি, প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও ব্যক্তিরা বান্দরবানে অবৈধভাবে লিজ নিয়ে হাজার হাজার একর জুম্মদের জায়গা বেদখল করে আসছে।
আসল কথা হলো যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের ২৩ বছর পরেও চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়ন না হওয়ায় জুম্ম জনগণের মনে গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে। প্রতিটি জুম্ম জনগণের মনে আজ শাসকগোষ্ঠীর প্রতি তীব্র ক্ষোভ, হতাশা ও এক বুক ঘৃণার আগুন জন্ম হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের ভুক্তভোগী হিসেবে গভীর যন্ত্রণা ও অব্যক্ত যাতনায় বিদ্ধ করেছে পুরো জুম্ম জাতিকে। তাই আজ আবারও রব উঠেছে “হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন, না হয় জুম্ম জনগণ অন্য পথ ধরতে বাধ্য হবে”!