হিল ভয়েস, ১১ ডিসেম্বর ২০২০, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: এ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির মানবাধিকারের বিধানাবলী পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে।
ডিসেম্বর ২০২০ পার্বত্য চুক্তি সম্পাদনের ২৩ বছর হওয়ায়, আজ ১১ ডিসেম্বর ২০২০ এ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশিত এক গণবিবৃতিতে এই আহ্বান জানানো হয়।
এ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালের গণবিবৃতির পুরো অংশটি নিম্নে দেয়া হল:
বাংলাদেশ: পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির অধিকারের বিধানাবলী পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত করুন
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর থেকে ডিসেম্বর ২০২০-এ ২৩ বছর হলো। এ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল ইহার মানবাধিকারের বিধানাবলী পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের নিকট আহ্বান জানাই।
প্রায় দুই দশকের সশস্ত্র সংঘাত, যাতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয় এবং আরো অনেকেই বাস্তুচ্যুত হয়, এর প্রেক্ষাপটের বিপরীতে আলাপ-আলোচনা করে, ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)-র শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি ভারত ও মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। ইহা তিন পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি নিয়ে গঠিত, যার মোট আয়তন ১৩,২৯৪ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা আনুমানিক ১.৬ মিলিয়ন (১৬ লক্ষ)। জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর, অপরদিকে বাকী অংশ হচ্ছে প্রধানত বাঙালি জাতিগাষ্ঠীর লোক। অঞ্চলটি ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকে বিশেষ প্রশাসনিক এলাকার মর্যাদা ভোগ করেছিল। ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি, ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন, এবং ১৯৫৬ ও ১৯৬২ সালের পাকিস্তানের সংবিধান এই অঞ্চলকে একটি বিশেষভাবে শাসিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেছিল। ১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ১৯০০ সালের শাসনবিধির ৩৪নং ধারা সংশোধন করে প্রথমবারের মত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগত ভূমির অধিকার কাটছাঁট করে। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সরকার এই অঞ্চলের মর্যাদাকে ‘ট্রাইবাল এলাকায়’ পরিবর্তিত করে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, নতুন সংবিধান ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ঐতিহাসিকভাবে যে বিশেষ মর্যাদা ভোগ করত তা সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়। এরপর ১৯৭৫ পরবর্তী সরকার বাঙালি জনগণকে বসতি প্রদান করে অঞ্চলটির জনমিতিগত বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করার চেষ্টা করে। ১৯৭৯ ও ১৯৮৫ সালের মধ্যে প্রায় চার লক্ষ বাঙালি জনগণকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি প্রদান করা হয়, যা জাতিগত সংঘাতকে উস্কে দেয়, যাতে হাজার হাজার আদিবাসী নিহত ও বাস্তুচ্যুত হয়, যাদের মধ্যে অনেকেই প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে।
১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে, এ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল ইহার বাস্তবায়নের অগ্রগতি পরিবীক্ষণ করে আসছে। ২০০০ সালে চুক্তি বাস্তবায়নের ধীর গতির বিষয়ে আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলাম। ২০১৩ সালে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সংক্রান্ত অবাস্তবায়িত সংস্কারসমূহ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত অবাস্তবায়িত অঙ্গীকারসমূহ ব্যাপারে আমরা বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরি।
পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়নের অবস্থা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানবাধিকার পরিস্থিতি হতাশাজনকভাবে ২০১৩ সালের মতই রয়ে গেছে। জনসংহতি সমিতির মতে, শান্তি চুক্তিতে বর্ণিত বিধানাবলীর মাত্র ১৫ শতাংশই সরকার কর্তৃক পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে, অপরদিকে ৫০ শতাংশের অধিক বিধানাবলীই অবাস্তবায়িত রয়েছে, এবং এক চতুর্থাংশ হয় আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে অথবা কিছু অগ্রগতি হয়েছে। এই পরিস্থিতির উপর সরকারের রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিমত, সরকার দাবি করছে যে, কোন মূলধারাই অবাস্তবায়িত রাখা হয়নি, তারা ৫৬ শতাংশ ধারাই পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করেছে, এবং অবশিষ্ট ৪৪ শতাংশ ধারা হয় আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে, অথবা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল এই বর্ষপূর্তি উপলক্ষে প্রাসঙ্গিক ধারাগুলোর পর্যালোচনা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে কাজ করছেন এমন চার বিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীর সাথে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে মূলধারাগুলোর অবস্থা তুলে ধরছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি ১৯৯৭-এ সাধারণভাবে তিনটি দিক রয়েছে: (ক) আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণকরণ; (খ) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকার সংস্থাসমূহ ক্ষমতায়ণ; এবং (খ) পুনর্বাসন। নিম্নের অনুচ্ছেদসমূহে চুক্তির মানবাধিকারের কিছু দিক পর্যালোচনা, এবং সেগুলোর বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিরূপণ করা হল।
(ক) উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণকরণ
শান্তি চুক্তির খন্ড ১ চুক্তির ভিত্তিকে গড়ে তুলেছে। এতে রয়েছে চারটি ধারা। ১নং ধারায় উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। ২নং ধারায় নতুন আইন, বিধি ও প্রবিধান প্রণয়ন এবং বিদ্যমান আইনসমূহ সংশোধন করে এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য পক্ষগুলোর দায়িত্বসমূহের রূপরেখা প্রদান করা হয়। ৩নং ধারায় পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটি গঠনের মাধ্যমে একটি বাস্তবায়ন সংক্রান্তকর্মব্যবস্থা প্রদান করা হয়, অপরদিকে ৪র্থ ধারায় বাস্তবায়নের জন্য সময়সীমা প্রদান করা হয়।
খন্ড ১-এ মানবাধিকারের প্রধান বিষয় হচ্ছে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অধিকার, যাতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে, অঞ্চলটির আদিবাসী বৈশিষ্ট্যের সংরক্ষণ। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি, যাতে বাংলাদেশ একটি পক্ষ – উভয়ের ধারা ১-এ শর্ত উল্লেখ রয়েছে যে, সকল জাতিগোষ্ঠীর ‘তাদের রাজনৈতিক মর্যাদা স্বাধীনভাবে নির্ধারণ করা এবং স্বাধীনভাবে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ সাধন করার’ অধিকার রয়েছে।
সরকার যখন আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করে এবং পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটি গঠন করে, তখন অঞ্চলটির বিশেষ মর্যাদা স্বীকার করে একটি সাংবিধানিক কাঠামো, সংশোধিত আইনসমূহের জন্য কার্যবিধিমালা প্রণয়ন, এবং পুলিশ আইন ১৮৬১ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধিমালা ১৯০০ এর সংশোধন এর অনুপস্থিতির কারণে বাস্তব ক্ষেত্রে এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়ে সামান্য।
শান্তি চুক্তি আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৈশিষ্ট্যাবলী সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৭০ দশকের শেষ থেকে একের পর এক বাংলাদেশ সরকারসমূহ কর্তৃক ধারাবাহিক পুনবসতিপ্রদানের কার্যক্রম অঞ্চলটির জনমিতিগত বৈশিষ্ট্য মৌলিকভাবে বদলে দেয় এবং আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে পরিণত করে সংখ্যালঘুতে। চুক্তিটি প্রয়োজনীয় আইনগত পরিবর্তন আনয়নের জন্য স্বাক্ষরকারী পক্ষগুলোর দৃঢ়সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করে, যেমন ১৯৮৯ সালের তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ও ১৯৯৮ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন সংশোধন; ভূমি বিরোধের জন্য এবং পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটি গঠনের জন্য নতুন আইনী কাঠামো সৃষ্টি।
শান্তি চুক্তি অনুযায়ী অন্তত পাঁচটি সংশ্লিষ্ট আইনগত ও সাংবিধানিক সংশোধনী বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ২০১১ সালে গৃহীত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে (ধার ২৩ক), সরকার আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য বিধানাবলী অন্তর্ভুক্ত করেছে। তবে পিসিজেএসএস ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সুনির্দিষ্ট উল্লেখ করে ধারা ২৮(৪) এর সংশোধন দাবি করেছে। এই ধারা বৈষম্যহীনতার সাংবিধানিক মূলনীতিকে লংঘন ব্যতিরেকে ‘নাগরিকদের অনগ্রসর অংশ’কে লক্ষ্যভুক্ত করে বিশেষ আইন প্রণয়নের জন্য আইনগত জানালা খুলে দেয়। বাংলাদেশ সংবিধানের ধারা ২৮ ‘কেবল ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ অথবা জন্মস্থানের ভিত্তিতে কোন নাগরিকের বিরুদ্ধে বৈষম্য না করতে’ রাষ্ট্রকে আইনগতভাবে বাধ্য করে, কিন্তু ধারা ২৮(৪) উল্লেখ করে যে, ‘এই ধারার কোনোকিছুই নারী বা শিশুর অনুকূলে অথবা নাগরিকদের যেকোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন থেকে রাষ্ট্রকে বিরত করবে না।’ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী দীর্ঘ সময় একটি সুনির্দিষ্ট রেফারেন্স ‘অথবা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণ’ যুক্ত করার জন্য দাবি করে আসছে। এ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনালের বিবেচনায় এই প্রস্তাবিত সংশোধনীটি হবে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য বিশেষ মর্যাদা বাস্তবায়নের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। শান্তি চুক্তির ধারাসমূহের বাস্তবায়ন যেমন পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০, পুলিশ আইন ১৮৬১ এর সংশোধন, সংশোধিত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮, এবং পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৯৮ হল সংবিধানে এরূপ ধারার সাপেক্ষে।নয়তো, অঞ্চলটির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ যেকোনো বিশেষ মর্যাদা আইনগত চ্যালেঞ্জের কাছে অরক্ষিত।
সরকার কয়েকটি আইনগত উদ্যোগও গ্রহণ করেছে, যেমন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮, পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ (সংশোধন) আইন ১৯৯৮, পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ (২০১৬ সালে সংশোধিত), এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধিমালা (সংশোধন) আইন ২০০৩ প্রণয়ন। তবে এইসব আইনসমূহ প্রবিধান প্রণীত না হওয়ার কারণে কার্যকর হতে পারে না। কার্যবিধিমালা ব্যতিরেকে, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ কমিটি অকার্যকর হয়ে পড়ে রয়েছে।
(খ) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় সরকার সংস্থাসমূহের ক্ষমতায়ন
তিন পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদ আইন ১৯৮৯ (১৯৮৯ সালের ১৯, ২০ ও ২১ নং আইন) এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮ এই চারটি আইন সংশোধন/প্রণয়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদসমূহ ক্ষমতায়িতকরণ হচ্ছে শান্তি চুক্তির সর্ববৃহৎ অংশ। ইহা স্বাক্ষরিত হওয়ার পূর্বে, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি ১৯৮৯ এর আইনের মাধ্যমে শাসিত হয়েছিল, এবং সমঝোতা চলাকালে আদিবাসী নেতারা এইসব আইনসমূহের পুঙ্খানুপুঙ্খ পুনর্বিবেচনার দাবি করেছিল। শান্তি চুক্তির খন্ড ৩ এর লক্ষ্য হচ্ছে তিন পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদসমূহের একটি স্বাধীন সমন্বয়কারী সংস্থা হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে ক্ষমতায়িত করা, অপরদিকে খন্ড ২ তিন পার্বত্য জেলায় স্বতন্ত্র স্থানীয় সরকার সংস্থার ব্যবস্থা করে।
খন্ড ২-এ ৩৫টি অনুচ্ছেদ রয়েছে যেগুলো ১৯৮৯ সালের আইনে করা পরিবর্তনসমূহের বিস্তারিত রূপরেখা প্রদান করে। সরকার যেখানে দাবি করে যে, ২৪টি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে, এবং ১১টি হয় আংশিকভাবে বাস্তবায়িত, অথবা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় রয়েছে, সেখানে পিসিজেএসএস’এর যুক্তি হচ্ছে যে, ৩৫টির মধ্যে মাত্র ১৬টি বাস্তবায়িত হয়েছে।
খন্ড ২ ও ৩ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, তাদেরকে প্রভাবিত করে এমন শাসনব্যবস্থায় ও সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণের অধিকার, এবং নিজেদের ঐতিহ্যগত ভূমির উপর আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারকে সম্মান, সুরক্ষা ও পরিপূর্ণ করার সরকারের অঙ্গীকারের সাথে সম্পর্কযুক্ত। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি উভয়ের ধারা ১(১), যাতে বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্রপক্ষ, সকল জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের শর্ত উল্লেখ করে, এবং উল্লেখ করে যে, ‘এই অধিকার বলে তারা তাদের রাজনৈতিক মর্যাদা স্বাধীনভাবে নির্ধারণ করে এবং স্বাধীনভাবে তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ সাধন করে।’ নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির ধারা ২৫(ক) অনুসারে, প্রত্যেক নাগরিকের ‘প্রত্যক্ষভাবে অথবা স্বাধীনভাবে বাছাইকৃত প্রতিনিধির মাধ্যমে লোক/সরকারি বিষয় পরিচালনায় অংশগ্রহণ করা’র অধিকার রয়েছে। আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে তাদের ঐতিহ্যগত ভূমির উপর আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার স্বীকার করা হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে যে, সরকারসমূহ ‘তাদের ভূমি বা ভূখন্ড এবং অন্যান্য সম্পদকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন যেকোনো প্রকল্প অনুমোদনের পূর্বে তাদের স্বাধীন ও অবহিত সম্মতি অর্জনের উদ্দেশ্যে’ তাদের সাথে পরামর্শ করবে।
শান্তি চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এইসব অধিকারের জন্য সুত্র এবং ক্ষমতা প্রদানকারী বিধানাবলী। খন্ড ২ এর অনুচ্ছেদ ৩ ‘অউপজাতীয় স্থায়ী বাসিন্দা’কে এমন একজনকে সংজ্ঞায়িত করে, যিনি আদিবাসী সম্প্রদায়ের নয়, যিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে বৈধভাবে ভূমির মালিক, এবং সাধারণত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি সুনির্দিষ্ট ঠিকানায় বসবাস করেন। বিধানটি অ-আদিবাসী স্থায়ী আবাসস্থলের সুযোগকে সংজ্ঞায়িত করেছে এবং এই নির্ধারণের ক্ষমতা নির্বাচিত আদিবাসী নেতাদের কাছে অর্পণ করেছে। একজন অধিকারকর্মীর মতে, বিধানটি পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যে স্থানীয় ব্যাপারে এবং আরও পুনবসতিদানের কার্যক্রম সীমিত করতে আদিবাসী নেতাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকরণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
তবে ডেপুটি কমিশনারকে ‘স্থায়ী বাসিন্দা সনদ’ প্রদানের অনুমতি প্রদান করে ২০০০ সালের একটি সরকারি আদেশ এই বিধানকে দূর্বল করেছিল। ইহা খন্ড ২ এর অনুচ্ছেদ ৪(ঘ) অনুযায়ী – এক আদিবাসী প্রশাসক – সার্কেল চীফের উপর প্রদত্ত কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে। তদুপরি, ডিসি কর্তৃক প্রদত্ত সনদসমূহ (খন্ড ২ এর অনুচ্ছেদ ৯ অনুযায়ী) ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অথবা আদিবাসী ও স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য প্রযোজ্য অন্যান্য সুফল ভোগ করার অধিকার প্রদান করবে, তদনুযায়ী স্থানীয় পরিষদসমূহের কর্তৃত্ব দূর্বল করে দেবে। এই কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘ দিন ধরে সার্কেল চীফের নিকট স্থায়ী বাসিন্দার সনদ প্রদানের ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার দাবি করে আসছে। সরকার আইনটি সংশোধনের অঙ্গীকার করেছিল, কিন্তু কোন পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
খন্ড ২ এর ৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে, সরকার প্রত্যেক পার্বত্য জেলা পরিষদে নারীদের জন্য তিনটি আসন এবং অ-আদিবাসীদের জন্য অন্তত একটি আসনসংরক্ষণ করবে। সেই অনুসারে আইনটি সংশোধন করা হলেও, সরকার শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন নির্বাচন আয়োজন করেনি, তাই কার্যক্ষেত্রে বিধানটি অপরিপূর্ণ রয়ে গেছে।
খন্ড ২ এর অনুচ্ছেদ ২৬ পার্বত্য জেলা পরিষদের পূর্ব অনুমতি ব্যতিরেকে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর ঐতিহ্যগত ভূমির সাথে সংশ্লিষ্ট লেনদেন সীমিত করে দেয়। অনুচ্ছেদ ২৬(খ) শর্ত উল্লেখ করে যে, ‘আপাততঃ বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, পার্বত্য জেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ও আওতাধীন কোন প্রকারের জমি, পাহাড় ও বনাঞ্চল পরিষদের সাথে আলোচনা ও ইহার সম্মতি ব্যতিরেকে সরকার কর্তৃক অধিগ্রহণ ও হস্তান্তর করা যাইবে না।’ অধিকন্তু, খন্ড ২ এর অনুচ্ছেদ ৩৪(ক) পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহকে ‘ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা’ প্রদান করেছে, পক্ষান্তরে অনুচ্ছেদ ২৭ পরিষদসমূহে ভূমি উন্নয়ন কর সংগ্রহের ক্ষমতা প্রদান করে। এইসব বিধানাবলী নিজেদের ঐতিহ্যগত ভূমির উপর আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি। শান্তি চুক্তির প্রয়োজন অনুসারে, সরকার এইসব বিধানাবলী অন্তর্ভুক্ত করে পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯ সংশোধন করেছে। তবে, যেহেতু সরকার আইন কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় বিধিমালা ও প্রবিধান প্রণয়ন করেনি, তাই ডিসিগণ পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহের সাথে পরামর্শ ব্যতিরেকে ভূমি হস্তান্তর প্রক্রিয়াকরণ, অধিগ্রহণ, লীজ, ও বন্দোবস্তি এবং ভূমি উন্নয়ন কর সংগ্রহকরণ সহ ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা অব্যাহতভাবে প্রয়োগ করে চলেছে।
খন্ড ২ এর অনুচ্ছেদ ১৯ অনুযায়ী, সংশোধিত ১৯৮৯ সালের আইনসমূহ পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়ন প্রকল্প ‘প্রণয়ন, প্রবর্তন ও বাস্তবায়ন করতে’ পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহকে ক্ষমতায়িত করেছে। তবে, বাস্তবে যেকোনো উন্নয়ন কার্যক্রমের উপর চূড়ান্ত ক্ষমতা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হাতেই রয়ে গেছে, যা কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। সরকার একটি সমান্তরাল উন্নয়ন এজেন্সিও সৃষ্টি করেছে – পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড – যা পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহকে পাশ কাটাতে সক্ষম। এই পদক্ষেপসমূহ অনুচ্ছেদ ১৯ এর উদ্দেশ্যকে নিষ্ফল করে দিয়েছে।
খন্ড ২ এর অনুচ্ছেদ ৩৪ ও ১৯৮৯ সালের সংশোধিত আইনসমূহ অনুযায়ী পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহকে ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে, সরকারের অন্যান্যের মধ্যে ভূমি ব্যবস্থাপনা, পুলিশ, আদিবাসী আইন, যুব কল্যাণ, পরিবেশগত সংরক্ষণ ব্যবস্থা, ও স্থানীয় পর্যটনসহ ৩৩টি কর্ম/বিষয় এর উপর ক্ষমতা জেলা পরিষদসমূহে হস্তান্তর করার কথা। পুলিশ ও আইন শৃঙ্খলা, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ সংরক্ষণ এর মত গুরুত্বপূর্ণ কর্মগুলো বাদ দিয়ে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৭টি কর্ম হস্তান্তর করা হয়েছে।
খন্ড ৩-এ ১৪টি অনুচ্ছেদ রয়েছে যেগুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮ এর আওতায় প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সংশোধনের রূপরেখা প্রদান করে। ১৯৯৮ সালে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইনের বিভিন্ন বিধানাবলী সংশোধন করেছে। অন্যান্য অনুচ্ছেদের ন্যায়, সরকার ও পিসিজেএসএস এর খন্ড ৩ এর বিধানাবলীর বাস্তবায়নের উপর ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। সরকারের মতে, ৬টি অনুচ্ছেদ সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে, অপরদিকে বাকীগুলো হয় আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে অথবা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। অপরদিকে পিসিজেএসএস’এর যুক্তি হচ্ছে যে, শুধু ৪টি অনুচ্ছেদ বাস্তবায়িত হয়েছে, ৬টি আংশিকভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে এবং অবশিষ্ট ৪টি বাস্তবায়িত হয়নি। খন্ড ২ এর ন্যায় খন্ড ৩ এর প্রধান মানবাধিকারের বিষয় হচ্ছে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার – অনেকাংশে স্বশাসন ও স্বায়ত্তশাসনের রূপে, যার জন্য শান্তি চুক্তি সাধারণ রূপরেখা প্রদান করে।
উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সমন্বয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিধিমালা ১৯০০ এর সংশোধন, এবং এই অঞ্চলের সাথে সংশ্লিষ্ট যেকোনো নতুন কোনো আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে পরামর্শ করার বিধানবিষয়ে শান্তি চুক্তি এবং পরবর্তী সময়েআইনের সংশোধনীসমূহপার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে ক্ষমতা অর্পণ করে। খন্ড ৩ এর অনুচ্ছেদ ৯ শর্ত উল্লেখ করে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ তিন পার্বত্য জেলা পরিষদসমূহ কর্তৃক পরিচালিত সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড সমন্বয় সাধন করবে, এবং অন্যান্যের মধ্যে আইন ও শৃঙ্খলা। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ‘নিয়োজিত দায়িত্ববলী’ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে প্রদানের পরিবর্তে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড অর্ডিন্যান্স ১৯৭৬ সংশোধন করে, সরকার বরং নতুন আইন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড আইন ২০১৪ প্রণয়ন করেছে, যা পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডকে স্থানীয় সরকার সংস্থাসমূহকে পাশ কাটিয়ে তার কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমোদন দেয়।
(গ) পুনর্বাসন
শান্তি চুক্তির খন্ড ৪ এর লক্ষ্য হচ্ছে সংঘাতের কারণে বাস্তুচ্যুত জনগণকে পুনর্বাসন করার মাধ্যমে, ভূমি নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করে, এবং সংঘাতে যারা জড়িত ছিল তাদেরকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে স্বাভাবিক পরিস্থিতি পুনস্থাপন করা। সেখানে রয়েছে ১৯টি অনুচ্ছেদ যাতে এইসব উদ্দেশ্যসমূহ অর্জনের জন্য কার্যপদ্ধতিসমূহ বিন্যস্ত রয়েছে। সরকার দাবি করে, ১২টি অনুচ্ছেদ পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে, অপরদিকে বাকী অনুচ্ছেদসমূহ হয় আংশিকভাবে বাস্তবায়িত অথবা কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। পিসিজেএসএস’এর দৃষ্টিতে ১৯টি অনুচ্ছেদের মধ্যে ৮টি অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে, ৭টি বাস্তবায়িত এবং বাকী ৪টি আংশিকভাবে বাস্তবায়িত। খন্ড ৪ এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি এবং চাকরি ও উচ্চ শিক্ষা কোটা সংরক্ষণ করে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জন্য ইতিবাচক বৈষম্যের বিধান।
খন্ড ৪ এর অনুচ্ছেদ ৪ অ-আদিবাসী ও অস্থানীয় জনগণের নিকট প্রদত্ত ভূমির লীজ বাতিল করার ক্ষমতাসহ, ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির ম্যান্ডেট দিয়ে একটি ভূমি কমিশন প্রতিষ্ঠার শর্ত উল্লেখ করে। চুক্তির খন্ড ৪ এর অনুচ্ছেদ ৫ অনুযায়ী, প্রথম ভূমি কমিশন গঠন করা হয় ১৯৯৯ সালে (এখন পর্যন্ত পাঁচ বার গঠন করা হয়েছে)। সরকার ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন পাস করে ২০০১ সালে, সংশোধন করে ২০১৬ সালে। তবে, কমিশন আইনের অনুচ্ছেদ ১৮ অনুযায়ী, সরকার কমিশনকে কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যবিধিমালা এখনও প্রণয়ন করেনি। কমিশন তিন পার্বত্য জেলায় ইহার দপ্তরসমূহও স্থাপন করেনি এবং এখনও কোন কর্মচারী নিয়োগ করেনি। এখন পর্যন্ত ভূমি বিরোধ বিষয়ক ২২,৮৬৬টি আবেদনপত্র যাচাই করা হয়নি এবং একটি মামলাও নিষ্পত্তি করা হয়নি। বিধিমালার অভাবে কমিশন এখনও পর্যন্ত কোন বিরোধের শুনানি শুরু করেনি।
চুক্তির খন্ড ৪ এর অনুচ্ছেদ ১০ চাকরি ও উচ্চ শিক্ষা বৃত্তিতে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জন্য কোটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। সরকার সেই অনুসারে সরকারি চাকরির ১ম থেকে ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত এবং উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানমূহে বিধানের ব্যবস্থা করেছে। তবে, ২০১৮ সালে, সরকার ১ম ও ২য় শ্রেণির সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দকৃত কোটা বাতিল করে দেয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনসমূহ অসুবিধাগ্রস্ত গোষ্ঠীগুলোর অনুকূলে এরূপ ইতিবাচক পদক্ষেপের ব্যবস্থা করে। জাতিগত বৈষম্য দূরীকরণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি, যাতে বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্রপক্ষ, ‘কার্যকর সমতা’ অগ্রগতিসাধনের জন্য এবং ‘অসুবিধাগ্রস্ত গোষ্ঠীকে মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার পূর্ণাঙ্গ ও সমান উপভোগ নিশ্চিত করার জন্য’ অস্থায়ী ‘বিশেষ পদক্ষেপ’ গ্রহণে রাষ্ট্রসমূহকে অনুমোদন দেয়।
সুপারিশমালা
শান্তি চুক্তির মানবাধিকারের বিধানাবলী বাস্তবায়নের দিকে অর্থপূর্ণ অগ্রগতির উদ্দেশ্যে, এ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ সরকারকে নিম্নোক্ত আহ্বান জানায়:
১. আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট আইন পাস করতে পারার লক্ষে বাংলাদেশ সংবিধানের ধারা ২৮(৪) এর সংশোধনী প্রস্তাব করুন।
২. পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অধিকার সংরক্ষণ ও রক্ষা করুন।
৩. নিজেদের ঐতিহ্যগত ভূমির উপর আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা করুন।
৪. জনজীবনে এবং তাদেরকে প্রভাবিত করে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের অধিকারকে সম্মান, রক্ষা ও প্রতিপালন করুন।
৫. ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করুন এবং দশকের পর দশক ধরে ন্যায়বিচারকামী আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীকে প্রতিকারের ব্যবস্থা করুন।
৬. কার্যকর সমতা অর্জন এবং তাদের মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার পূর্ণ ও সমান উপভোগ নিশ্চিত করার লক্ষে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জন্য চাকরি ও উচ্চতর শিক্ষা বৃত্তিতে কোটা পুনর্বহালসহ বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।