সত্যবীর দেওয়ান
বাংলার মহান এক বরেণ্য কবি বলেছেন, “পরের অনিষ্টের চিন্তা করে যেইজন, নিজেরই অনিষ্টের বীজ করে সে বপন”। যুগে যুগে শাসকগোষ্ঠী শাসন ক্ষমতায় থেকে নিজেদের শাসন-শোষণ চিরস্থায়ী করার জন্য নানা প্রকার কূটকৌশল অবলম্বন করেছে, তেমনি জঘন্যতম মানবতা বিরোধী, বিবেক বর্জিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কিন্তু বাস্তবতা কাউকে ছাড় দেয়নি। কথায় বলে ধর্মের ঢোল আপনিই বাজে। এক্ষেত্রে ধর্মান্ধ, ধর্মভীরু, ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠী বলে থাকেন “পাপ বাপকেও ছাড়ে না”। যেমন কর্ম তেমন ফল হবেই। কথায় বলে “অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে তব ঘৃণা তারে তৃণ সম দহে”। ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্য আপেক্ষিক ব্যাপার হলেও বাস্তবসম্মত যুক্তির ভিত্তিতে যা অন্যায় তা চীরকালই অন্যায়। শাসকগোষ্ঠী শাসনক্ষমতায় থেকে কোন জনগোষ্ঠীর ন্যায়সঙ্গত দাবিকে অগ্রাহ্য করে কোন শাসক বা শাসকগোষ্ঠী যেমনি টিকে থাকতে পারেনি, তেমনি অনেক শাসককে জীবন দিয়ে তা প্রমাণ করে যেতে হয়েছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী ভারত উপমহাদেশে তাদের শাসন ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য যেমনি এই উপমহাদেশের জনগণকে “ভাগ কর, শাসন কর” নীতি প্রয়োগ করে এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে শত সহস্র ভারতবাসীর মৃত্যু ঘটিয়েছেসাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মাধ্যমে, তেমনি জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে ১৩ এপ্রিল ১৯১৯ জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যা চালানো হয়। তা সত্বেও সেই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকে রক্ষা করা যায়নি। ২১ বছর পর ১৩ প্রপ্রিল ১৯৪০ জেনারেল ডায়ারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীকে ভারত উপমহাদেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে ১৯৪৭ সালে।
অন্যায়, অবিচার, হত্যা, গণহত্যা চালিয়ে কেউ রক্ষা পায়নি। তেমনি বাংলাদেশের জনগণকে শাসন, শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, গণহত্যা চালিয়ে আইয়ুব, ইয়াহিয়া খানরাও রক্ষা পায়নি, ইতিহাসের মঞ্চ হতে একে একে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। বাধ্য হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীকে। আইয়ুব, ইয়াহিয়া, ভুট্টো কখনও ভাবেনি পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে বাংলাদেশ হবে। তেমনি বাংলাদেশের অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামী নেতৃবৃন্দসহ ইসলামী ধর্মান্ধ মৌলবাদীরাও কোন সময়েই ভাবতে পারেনি, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে এবং সেজন্যে তারা সর্বাত্মকভাবে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল। রাজাকার, মুজাহিদ-এ ভর্তি হয়ে স্বজাতির স্বাধিকার আন্দোলনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল। নিজেদের মা-বোনকে পাক বাহিনীর হাতে তুলে দিতে তাদের এতটুকু বাধেনি। ধর্মীয় লেবাস পরে এরা কেবল ব্যক্তিগত স্বার্থে এসব কাজ বিবেক-বর্জিতভাবে করেছিল। এর পরিণতি আজ জামায়াতী ইসলামী নেতৃত্বকে ভোগ করতে হচ্ছে। জঘন্য এদের চরিত্র, এরা ধর্মকে কেবল ব্যক্তিগত স্বার্থে কাজে লাগিয়ে আর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী তাদের সেসব করার সর্বাত্মক সুযোগ করে দিয়েছিলো। একারণে তাদের মধ্যে আজও পাকিস্তান প্রীতি বিদ্যমান। তেমনি পাক-ভারত বিভক্তির পূর্বে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর কিছু সুবিধাভোগী ভারতীয় নাগরিক, ব্রিটিশ শাসনকে চিরস্থায়ী রাখার স্বপ্ন দেখেছিল। তেমন একজন কবি হচ্ছেন ঈশ্বর গুপ্ত। তার একটি কবিতার ছন্দটি অনেকটা এই রকম-
ভারতে ব্রিটিশ রাজলক্ষী স্থির যেন রয়,
এদেশে ব্রিটিশ শাসন যেন চিরস্থায়ী হয়।
চিরকাল হয় যেন ব্রিটিশে জয়।
বাস্তবতা কিন্তু তাদের সেই আশা পূরণ হতে দেয়নি। উপনিবেশবাদী ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীকে শেষ পর্যন্ত ভারত পাকিস্তানকে স্বাধীনতা প্রদান করে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনে বাধ্য করেছিল।
ঐতিহাসিক সেই প্রেক্ষাপটকে স্মরণ করে বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলেও দীপঙ্কর, বীর বাহাদুররা শাসকগোষ্ঠীর পদলেহন করে আজ কোটি কোটি টাকার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, ভূ-সম্পত্তি আর একেক জনের কতিপয় ফ্ল্যাট বাড়ির মালিক হয়েছেন। জনগণের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দকৃত বিভিন্ন প্রকল্প হতে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে লক্ষ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে যাচ্ছেন। আর এই সুযোগ শাসকগোষ্ঠী তাদের বাধাহীনভাবে প্রশ্রয়দিয়ে যাচ্ছে। সে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদেরকে সরকার ‘নপুংসক’ করে রেখেছে, যাতে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণের অধিকারের কথা কোন সময়েই তুলে না ধরে এবং সেটেলার মুসলমান জনগোষ্ঠীকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি স্থাপনেরবিরুদ্ধে সম্পূর্ণ নীরব থাকে। এমনকি বিভিন্ন গণহত্যার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী গ্রামবাসীদের উচ্ছেদ করে সেটেলার বাঙালি মুসলমান বসতি দিয়ে যে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করছে, তথা পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকার মর্যাদাকে চিরতরে বিলুপ্ত করার যে সরকারি ষড়যন্ত্র চলছে, সেসব নীলনক্সা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। তাদের আত্মসাৎকৃত অর্থ হতে বিভিন্ন উপজেলা পর্যায়ের কিছু মাঝারি আকারের দালালরাও তাদের উচ্ছিষ্ট ভোগ করার জন্য শাসকগোষ্ঠীর দালালি করে রাজাকারদের মতো তাবেদারী ভূমিকা গ্রহণ করছে। এই জুম্ম রাজাকারদেরও একদিন তার জবাব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে দিতে হবে। আজ শাসকগোষ্ঠীর দালালি করে সাধারণ জুম্ম জনগণের উপর যে অন্যায়, অবিচার, হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ জাতীয় অপকর্ম করতে সরকারি প্রশাসনকে বিবেকহীনভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছে তার জবাব জাতির কাছে দিতে হবেই। মনে রাখা উচিত সত্য, ন্যায়ের পক্ষে যেকোন দেশের, যেকোনো জাতির, যেকোন অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের নীরব সমর্থন থাকে।
স্মরণাতীত কাল থেকে, এমনবিমোগল আমলের বহু পূর্ব হতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জুম্ম জনগণ এই অঞ্চলে স্বাধীনভাবে বসবাস করে আসছে। তারাই এই শ্বাপদ সংকুল দুর্গম গভীর জঙ্গলাকীর্ণ জন-মানবহীন বনাঞ্চলকে মানুষের বসবাসযোগ্য করেছিল। কেবলমাত্র জুমচাষ পদ্ধতির মাধ্যমে এই অঞ্চলকে আদিবাসী পাহাড়িরাই মনুষ্য বসবাসযোগ্য করেছে। একথা শুধু এই উপমহাদেশের মানুষই নয়, গোটা বিশ্ববাসী জানে। রাষ্ট্রক্ষমতায় উন্মত্ত হয়ে উড়ে এসে জুড়ে বসে রাষ্ট্রের প্রজাপালনের নীতি, বিবেক-বর্জিতভাবে লঙ্ঘন করে, রাষ্ট্রশক্তিকে অপব্যবহার করে, জুম্মদের বলা হচ্ছে “তোমরা বহিরাগত, বাঙালিরাই আদিবাসী।”
দেশে এখন সেই সেবকের আবির্ভাব হওয়া প্রয়োজন, যে সেবক সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, জুলুমের বিরুদ্ধে শুধু প্রতিবাদই করবেনা, প্রয়োজনে পাল্টা আঘাত করবে। প্রতিটি আক্রমণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে (প্রতিঘাত করবে) পাল্টা আঘাত করবে এবং প্রতিঘাতও বুকে পেতে নেবে, এরূপ সাহসী ও নির্ভীক ব্যক্তিরাই জুম্ম ছাত্র যুবকদের মধ্য হতে বেরিয়ে আসাই হচ্ছে সবচেয়ে জরুরী। যারা নেতৃত্বের হাল ধরতে সক্ষম এমন ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। কেবল দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের ‘নন্দলালের’ মত ঘরে বসে দেশ সেবা জনসেবার মাধ্যমে অধিকার পাওয়া যায় না। অধিকারের জন্য লড়াই সংগ্রাম করতে হয়। যারা ভীরু, কাপুরুষ, প্রতিবাদ করার সাহস যাদের নেই, তাদের ভূমিকা তিন ধরনের হয়ে থাকে। তাদের একটি অংশ শাসকগোষ্ঠীর গোলামিত্বকে নির্বিবাদে মেনে নেয়। দ্বিতীয় অংশটি ধর্মের আশ্রয় নিয়ে নির্বাণ কামনা করে, অথচ দিবা অন্ধেরা দেখে না যে, শাসকগোষ্ঠী তাদের নির্বাণে পাঠানোর সকল আয়োজন ইতিমধ্যেই তৈরী করে রেখেছে। তৃতীয় অংশটি দালালির ভূমিকা গ্রহণ করে স্বজাতির সর্বনাশ করার জন্য তৎপর হয়ে মীরজাফরের ভূমিকা গ্রহণ করে। অবশিষ্ট দেশপ্রেমিকরা অধিকার সচেতন যারা তারা সংগ্রামী জীবন গ্রহণ করে, লড়াই সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণ বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করে কি অধিকার আদায় করতে পারবে কি? অথবা লড়াই সংগ্রাম করে জয়যুক্ত হতে পারবে কি? কারণ বাংলাদেশ বিপুল জনসংখ্যার দেশ। তন্মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদেরজনসংখ্যা মাত্র ১০ লক্ষ হয়। সেই হিসেবে অর্থাৎ জনসংখ্যার বিচারে পাত্তাই পাওয়া যায় না। এতই নগণ্য যে শতকরা এক অংশেরও অর্ধেক। হয়তো একারণে অনেকের কাছে প্রশ্ন জাগতে পারে, এত বিপুল জনসংখ্যার দেশের বিপরীতে গিয়ে কিভাবে অধিকার আদায় সম্ভব?
অবশ্যই সম্ভব, জনগণ যদি ইস্পাত কঠিন ঐক্যে ঐক্যবদ্ধ হয়। কেননা জুম্ম জনগণের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম কোন প্রকারেই বাঙালি জাতির তথা বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে নয়। তাদের সংগ্রাম হচ্ছে উগ্র বাঙালিজাতীয়তাবাদ এবং ইসলামী সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। আর এই সংগ্রাম হচ্ছে ন্যায়ঙ্গগত।আত্মরক্ষার অধিকার মানুষের জন্মগত। তাদের সংগ্রামের ন্যায়সঙ্গত চরিত্রের কারণে দীর্ঘ ২১ বছর (১৯৭৬ হতে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত)-এর সশস্ত্র সংগ্রামকে তৎকালীন বাংলাদেশের সরকারসমূহ দেশে-বিদেশে মিথ্যে অপপ্রচার চালানো সত্ত্বেও কোন সময়েই পার্বত্য জনগণের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন হিসেবে প্রমাণ করতে পারেনি। কারণ তাদের যুগযুগ ধরে বসবাস করা ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে দেশের অন্য অঞ্চল থেকে লোক এনে বসতি প্রদান করাযে নীতিগতভাবে অন্যায় তা সকলের কাছে সুস্পষ্ট। দেশের প্রজাপালনের নীতি থেকে রাষ্ট্র সরে গিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশের একটি জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে অন্য জনগোষ্ঠীকে বসতি প্রদান করার কাজ যেকোনো দেশের প্রজাপালনের নীতির বহির্ভূত। আর সেই কাজ তৎকালীন বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারই শুরু করেছিল। যে কারণে তার শাসন আমলে আরও বড় ধরনের গণহত্যা পরিচালনার জন্য জাতীয় সংসদে উপদ্রুত এলাকা বিল পাশ করতে চেয়েছিলো।
কিন্তু জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের তীব্র প্রতিবাদের মুখে জাতীয় সংসদে সেই বিল প্রত্যাখ্যাত হয়। কারণ রাষ্ট্রীয় নীতি-নৈতিকতা তথা দেশের সংবিধানের সাংবিধানিক নীতি লঙ্ঘন করে কেবল রাষ্ট্রীয় সামরিক শক্তিকে অপব্যবহার করে জিয়াউর রহমান পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় জুম্ম জনগণকে উচ্ছেদ করে অন্য জেলা থেকে মুসলিম জনসংখ্যা এনে বসতি স্থাপন করে। এটা যে অন্যায় করা হয়েছে সে কথা দেশের অধিকাংশ সেনা কর্মকর্তা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষিত ও মানবতাবাদী বিবেকবান বাঙালি সমাজ অবশ্যই স্বীকার করেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী পাহাড়িদের উচ্ছেদ করে অন্য জেলা থেকে বাঙালি মুসলমান এনে বসতি স্থাপন একটা সরকারি ভুল সিদ্ধান্ত এবং এ পদক্ষেপে পাহাড়িদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীসমাজ, মানবতাবাদী ও বিবেকবান সংখ্যাগরিষ্ট সেনা কর্মকর্তারা এটা স্বীকার করেন এবং একমতও পোষণ করেন। যে কারণে বাংলাদেশের গরিষ্ট জনগণ আমাদের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে। কিন্তু তাদের সংগঠিত করার সমস্যাটা হচ্ছে প্রধান। শাসকগোষ্ঠীরা অবশ্যই সংখ্যায় কম, কিন্তু তারা ক্ষমতায় আছে বলে তাদের দাপট ও প্রবলতাকেই দেখা যায়, তারা সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিয়ে সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করে। এ কারণে অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে পারলে তবেই শাসকগোষ্ঠীর দূর্বলতা প্রকাশ পাবে। তারা প্রকৃতপক্ষে কতটুকু দূর্বল তখনই বোঝা যাবে।
মুষ্টিমেয় সরকারি উচ্চ পদস্থ কিছু সেনাকর্তা ও আমলারা পার্বত্য এলাকায় কর্মরত রয়েছেন যারা আসলেই ভূমিদস্যু। তারা তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থচরিতার্থ করার জন্যই পর্যটন কেন্দ্র তৈরীর নামে জুম চাষিদের উচ্ছেদ করে নির্বিচারে ভূমি বেদখল করে যাচ্ছে। আর এরা কারা তা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করলে দেখা যাবে এরা অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের সামরিক ও বেসামরিক আমলা এবং কিছু সরকারি উচ্চস্তরের লোক। যাদেরকে নিয়ে বা যাদের পরামর্শে সরকার চলছে ঐসব সামরিক-বেসামরিক আমলারা যখন অবসর নিবেন, তখন দেখবেন, ঐ সমস্ত পর্যটন কেন্দ্রগুলোর মালিক হয় কোন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে, অথবা অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা মিলে যৌথ মালিকানায়(ট্রাস্টের নাম বা অনুরূপ একটা সংগঠনের নামে হয়ে গেছে) কোনো গোষ্ঠীগত বা পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে গেছে। কারণ সরকারের মধ্যেই ভূমিদস্যুরা বিদ্যমান, যাকে বলে সর্ষের মধ্যেই রয়েছে ভুত। তাই তাদের অর্থাৎ সরকারি সামরিক বেসামরিক উচ্চপদস্ত কর্মকর্তারাতো ইতিমধ্যে একেক জন হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। পক্ষান্তরে সংখ্যাগরিষ্ট বাঙালি কৃষক, শ্রমিকসহ সাধারণ জনগণ যে শাসকগোষ্ঠীর শাসন-শোষণের ফলে দরিদ্র হতে দরিদ্রতর সর্বহারায় পরিণত হচ্ছে, তারা অবশ্যই আমাদের পক্ষে। কেবল তাদের সংগঠিত করার, নেতৃত্ব গড়ে তোলার, তাদের সংগ্রামী ঐক্যকে জাগিয়ে তোলার কাজটা হচ্ছে প্রধান। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সামরিক উচ্চপদস্ত কর্মকর্তাদের তো আয়ের উৎসের অভাব নেই। ‘করোনা ভাইরাস’ সারা বিশে^ আক্রমণের পূর্বে যখন ব্যবসা-বাণিজ্য সচল ছিল তখন তাদের দৌরাত্ম্য অকল্পনীয়।
পার্বত্য চুক্তি-পূর্ব সময়ে গৃহীত ‘শান্তকরণ প্রকল্প’ নামে কাউন্টার-ইনসারজেন্সী কর্মসূচি বাবদে সেনাবাহিনী এখনো হাজার হাজার মেট্রিন টন খাদ্যশস্য পেয়ে থাকে। পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনীকে এই শান্তকরণ প্রকল্পের খাদ্যশস্যের কোনো জবাবদিহি করতে হয়না। এসব খাদ্যশস্যের অর্থ ইচ্ছামত নয়ছয় করতে পারে। এসব খাদ্যশস্য মুসলিম সেটেলারদের বসতি সম্প্রসারণ ও নতুন নতুন অনুপ্রবেশকারীদের বসতি প্রদানের কাজে ব্যবহার করে থাকে।অন্যদিকে সেনাবাহিনীর আয়ের আরেকটি খাত হচ্ছে বনজ সম্পদের উপর চাঁদাবাজি এবং জুম্ম সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় ও মদদ দিয়ে তাদের মাধ্যমে অবাধে চাঁদাবাজি করা এবং উক্ত চাঁদাবাজির একটা মোট অংশ লাভ করা। এভাবেই সেনাবাহিনী তাবেদার জুম্ম সশস্ত্র সন্ত্রাসীদেরকে চাঁদাবাজ হিসেবে নিয়োগ করে যাবতীয় পণ্য হতে চাঁদা আদায় করে নিজেদের মধ্যে ভাগ ভাটোয়ারা করে থাকে। আর সেনাবাহিনী উচ্ছিষ্টভোগী কতিপয় হলুদ সাংবাদিকদেরমাধ্যমে চাঁদাবাজির জন্য জেএসএস’কে দায় চাপিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রচার করা হয়ে থাকে। নিজেরা ধুয়ো তুলসীপাতা। আরসরকারতো সেনা কর্মকর্তাদের কথায় চলে, আর চিন্তা কি? অতএব এসময়ে টাকা কামাই না করলে আর কখন করা? এইভাবে সরকারি সামরিক ও বেসামরিক আমলারা মিলে জনগণকে চিনা জোঁকের মত শুষে খাচ্ছে।
আর কোথাও সংস্কারপন্থী বা গণতান্ত্রিক (ইউপিডিএফ) কর্তৃক হামলা হলে, মামলা দেয়া হচ্ছেজেএসএস নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে। মরলে জুম্ম মরবে, মামলাতো জেএসএস’র নামে চালিয়ে দিতে অসুবিধা কোথায়? কথায় বলে “কারো পৌষ মাস আর কারো সর্বনাশ।” তাই এখন ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও সংস্কারপন্থীদের দিয়ে জুম্ম দিয়ে জুম্ম ধ্বংসের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আর নির্বোধ অপদার্থরা কেবল কলুর বলদের মত সরকারি বাহিনীর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। সামরিক-বেসামরিক ভূমিদস্যুদের এখন সেটেলারের মাধ্যমে ভূমি দখল করে পর্যটন স্পট গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নেয়ার মোক্ষম সুযোগ। আর সেটেলারদের মধ্যে যারা সুবিধাবঞ্চিত তাদেরকে ব্যবহার করে জায়গা বেদখল করার ফন্দি-ফিকির তো অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পার্বত্য চুক্তি করে জুম্মদেরকে অধিকার প্রদানের নামে পার্বত্য চুক্তিকে ঝুলিয়ে রেখে সেটেলার পুনর্বাসন করার পথ প্রশস্ত করেছে। চুক্তিকে ঝুলিয়ে রেখে প্রতিনিয়ত সেটেলার এনে জুমচাষিদের জুমভূমি, মৌজাভূমি এবং বন্দোবস্তিকৃত জায়গা-জমি নানান অজুহাতে বেদখল করা হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় সেটেলার পুনর্বাসন কাজ অব্যাহত রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সংখ্যালঘু জুম্ম জনগণের পক্ষে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রাম করে অধিকার আদায় করা আদৌ কি সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব যদি জুম্ম জনগণ ইস্পাত কঠিন ঐক্যবদ্ধ হন। সর্বপ্রথম মনে রাখা দরকার, জুম্মদের নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম নীতিগতভাবে ন্যায়সঙ্গত। আর ন্যায়সঙ্গত চরিত্রের কারণে জুম্ম জনগণের পক্ষে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন রয়েছে। একইভাবে অনুকূলে রয়েছে এদেশের মানবতাবাদী বিবেকবান বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন ও সহযোগিতা। অধিকন্তু জুম্ম জনগণের রয়েছে আন্তর্জাতিক সমর্থন। একইভাবে সংগ্রামের ন্যায়সঙ্গত চরিত্রের কারণে জুম্মজনগণের অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনকে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী বরাবরই আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন হিসেবে প্রমাণ করতে চেয়েছিলো, কিন্তু পারেনি। বিশেষ করে ১৯৯১ সনের ডিসেম্বর মাসে সার্কভুক্ত দেশগুলির মধ্যে যখন যৌথভাবে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন দমন করাার উদ্দেশ্যে কলম্বোতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে বৈঠক হয়, তাতে সার্কভুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণের মধ্যে সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা পর্যালোচনা হয়। কিন্তু সন্ত্রাসবাদের একটা সবার গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে একটা সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয় তা হলো, জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ব্যতীত বাকীগুলি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে অন্তর্ভুক্ত হবে। সেই সূত্রে উপমহাদেশে যেসব সশস্ত্র আন্দোলন চলছিল সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আন্দোলনসহ অনেক আন্দোলন জাতীয় মুক্তি আন্দোলন হিসেবে পরিচিহ্নিত হয়।
এই তিনটি জাতীয় মুক্তি আন্দোলন যৌথভাবে দমন অভিযানের বাইরে থেকে যায়। যে কারণে বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী তা প্রমাণে ব্যর্থ হয়ে পরবর্তীতে আলোচনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৮৫ সালের ২১ অক্টোবর হতে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের প্রক্রিয়া শুরু করে। এই বৈঠকের প্রক্রিয়ায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এরশাদের শাসন আমল হতে বিএনপি আমল এবং পরবর্তীতে শেখ হাসিনার আমল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ২৬টি বৈঠকের পর ১৯৯৭ সালে ২রা ডিসেম্বর একটা পৃথক শাসনব্যবস্থা স্বরূপ তিনটি পার্বত্য জেলা নিয়ে একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অংশদ্বারিত্বের পরিষদীয় ব্যবস্থা রেখে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিকে যেসব রাজনৈতিক প্রশাসনিক অংশীদারিত্বমূলক ব্যবস্থা সন্নিবেশিত হয়েছে বলতে গেলে এগুলো জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠার ন্যূনতম একটা সনদ মাত্র। অথচ সরকার তা আইন ও বিচার বিভাগের মাধ্যমে চুক্তির মৌলিক ধারাসমূহ একটির পর একটি একতরফাভাবে লঙ্ঘন, সংশোধন এবং বাতিল করার পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা সম্পূর্ণ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের বিরোধী। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী উভয় পক্ষ যার যার দায়িত্ব পালনে সততা বজায় রাখাই হচ্ছে চুক্তি বাস্তবায়নের অন্যতম শর্ত। কিন্তু সরকার পক্ষ চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ন্যূনতম সততা প্রদর্শন করছে না। নিজের ইচ্ছামত সামরিক-বেসামরিক আমলারা চুক্তির বিভিন্ন ধারা ভঙ্গ করছে, আর সরকার নির্বিকারভাবে সায় দিয়ে যাচ্ছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় সংসদের সদস্যদের নিয়ে গঠিত জাতীয় কমিটির সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির চুক্তিটা অবশ্যই একটি সরকারি/রাষ্ট্রীয় চুক্তি। সেই চুক্তি যদি সরকারি কোন আমলা বিরোধিতা বা লঙ্ঘন করে থাকে, তাহলে প্রশ্ন জাগে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন হয় কী করে? একটি সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার হলে রাষ্ট্রীয় চুক্তি লঙ্ঘনকারী আমলাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না কেন? পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে শুরু থেকে পরিলক্ষিত হচ্ছে যে, সরকার বিচার ও নির্বাহী বিভাগের মাধ্যমে পার্বত্য চুক্তির বিভিন্ন ধারা একটির পর একটি লঙ্ঘন করে চলেছে। প্রথমে১৯৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অধীন বিশেষ কার্যাদি বিভাগ কর্তৃক পার্বত্য চুক্তিকে লঙ্ঘন করে মুসলিম সেটেলারদেরকে আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু হিসেবে গণ্য করে পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসনের জন্য ভারত-প্রত্যাগত শরণার্থী ও আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন সংক্রান্ত টাস্কফোর্সকে নির্দেশনা প্রদান করা। অথচ চুক্তিতে কেবল উপজাতীয় আভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের বিধান করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত ২০০০ সালে পার্বত্য মন্ত্রণালয়কে দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা সনদপত্র প্রদানের বিধান অনুযায়ী স্থানীয় মৌজার হেডম্যান/ ইউপি চেয়ারম্যান/পৌরসভার চেয়ারম্যান এর প্রদত্ত সার্টিফিকেট দাখিল সাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট সার্কেল চীফই নির্ধারণ করার কথা। সেই বিধানটিকে পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রথম আঘাত হানা হলো, সার্কেল চীফের পাশাপাশি চুক্তি লঙ্ঘন করে জেলা প্রশাসককেও স্থায়ী বাসিন্দার প্রদানের ক্ষমতাঅর্পণ করে।
তৃতীয়ত ২০০৭ সালে হাইকোর্টে মৌলবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক পার্বত্য চুক্তির বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা মোকাবেলায় দেখা যায় সরকারের গড়িমসি ও দায়ছাড়া মনোভাব।পার্বত্য চুক্তিকে অবৈধ ঘোষণা করা না হলেও আঞ্চলিক পরিষদকে অবৈধ এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ধারাঅসাংবিধানিক বলে ২০১০ সালে হাইকোর্ট কর্র্তৃক রায় দেয়া হয়। এমনকি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের আপীল বিভাগে দায়েরকৃত আপীল মামলা মোকাবেলায়ও সরকার অব্যাহতভাবে গড়িমসি চলছে। ফলে আজ ১০ বছর ধরে উক্ত আপীল মামলার যথাযথ শুনানী হতে পারেনি।
এই যদি হয় চুক্তির অবস্থা, তাহলে সেই চুক্তি স্বাক্ষর করার কোন যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। এক্ষেত্রে সরকারের নীরবতার অর্থ কী হতে পারে? তাহলে সরকারের সার্বভৌম ক্ষমতা কোথায় বন্দি রয়েছে? সরকারের গৃহিত চুক্তি যদি সরকারেরই অধীন্যস্ত অঙ্গ মন্ত্রণালয় এবং বিচার বিভাগ বাতিল করতে বা পরিবর্তন করতে পারে, তাহলে সার্বভৌম ক্ষমতা এই সরকারের আছে কিনা তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির। তাই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অবশ্যই গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারেরই সিদ্ধান্ত। আর সেই সিদ্ধান্তের যে কোন বিষয় যদি সরকারেরই অধীন কোন মন্ত্রণালয় বা বিচার বিভাগ বা নির্বাহী বিভাগ কর্তৃক ইচ্ছামত লঙ্ঘন বা বাতিল করতে পারে তাহলে সরকারের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।তাই প্রশ্ন জাগে সরকার তুমি কার?
আর একটা কথা হচ্ছে,সশস্ত্র আন্দোলন হলেই সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন হতে পারে না।বর্তমান বিশ্বে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, জনগণ বেঁচে থাকার জন্য অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান তথা মৌলিক অধিকার যদি না পায় তাহলে সে দেশ টিকে থাকতে পারে না। ষড়যন্ত্র করে কোনো জনগোষ্ঠীকে অবহেলা করে, বঞ্চিত করে দেশের অখণ্ডতা বজায় রাখা যায় না। ধর্মীয় মৌলবাদকে মদদ দিলে শেষ পর্যন্ত গুরুকেই ছোবল দেয়। যে কারণে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশের জাতীয় নেতৃবৃন্দও যদি পাকিস্তানি ধর্মীয় মৌলবাদ, ষড়যন্ত্র, বৈষম্যমূলক ঔপনিবেশিক আচরণ করে, তার পরিণতি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে পারে।
এখন বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন স্তরের সামরিক-বেসামরিক আমলা তথা জাতীয় বিভিন্ন দলের নেতা-নেতৃবৃন্দের মুখ হতে যত্রতত্র যেখানে সেখানে জেএসএস-এর আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বলে অভিহিত করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। অথচ দীর্ঘ দুই যুগের অধিক পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র আন্দোলনকে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিকভাবে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন হিসেবে প্রমাণ করতে পারেনি। এব্যাপারে এই প্রবন্ধের একপর্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। বরং পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের আন্দোলন হচ্ছে নিজেদের জাতীয় স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রক্ষার জন্য রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এই আন্দোলন কোন কালে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন ছিলোনা, আজও নয়। তাই সশস্ত্র আন্দোলন মাত্রই যদি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন হয়, তাহলে বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামকে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন হিসাবে স্বীকার করে নিতে হবে। যারা আজ যত্রতত্র পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বলে মন্তব্য করেন তারা কি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন হিসাবে স্বীকার করবেন?
বরং জুম্ম জনগণের জাতিগত স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম হচ্ছে ন্যায়সঙ্গত সংগ্রাম। অতএব এখনও সময় আছে জুম্ম জনগণের স্বতন্ত্র জাতীয় অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিন, পার্বত্য চুক্তির কোনো ধারা লঙ্ঘন বা বাতিল না করে যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাই। অন্যথায় পরবর্তী যেকোনো উদ্ভূত পরিস্থিতিরি জন্য সরকারকেই তার দায় দায়িত্ব নিতে হবে।