হিল ভয়েস, ৬ ডিসেম্বর ২০২০, আন্তর্জাতিক ডেস্ক: এশিয়া ইন্ডিজেনাস পিপলস প্যাক্ট (এআইপিপি), থাইল্যান্ড ও ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্ক গ্রুপ অন ইন্ডিজেনাস এ্যাফেয়ার্স (ইবগিয়া) জোরপূর্বক উচ্ছেদ থেকে আদিবাসী ম্রোদের রক্ষা ও চিম্বুক-থানছি সড়কে বিলাসবহুল হোটেল নির্মাণ অবিলম্বে বাতিল এবং পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমপি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈ সিং এমপির বরাবরে এক আবেদন জানিয়েছে।
গত ১ ডিসেম্বর ২০২০ জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ, মানবাধিকার কর্মী, শিক্ষক-গবেষক ও অন্যান্যসহ বিশ্বের ৮২টি সংগঠন ও ১০৬ ব্যক্তির স্বাক্ষর নিয়ে এআইপিপি ও ইবগিয়া ইমেইল, ফ্যাক্স ও ডাক এর মাধ্যমে প্রেরিত খোলা চিঠির মধ্য দিয়ে এই আবেদন জানান। তারা আদিবাসী ম্রো জনগোষ্ঠীকে তাদের অধিকারের জন্য সংগ্রামে সহযোগিতা করার জন্যও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রীর নিকট আবেদন জানান। এআইপিপি’র সেক্রেটারি জেনারেল গ্যাম এ শিমরে স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়।
চিঠিতে গভীর উদ্বেগ এবং এই মুহূর্তে নিজেদের ভূখন্ডে পাঁচতারা হোটেল নির্মাণের কারণে তাদের পূর্বপুরুষের ভূমি থেকে উচ্ছেদ ও অন্যান্য মানবাধিকার লংঘনের সম্মুখীন হওয়া আদিবাসী ম্রো সম্প্রদায়ের সাথে সংহতি প্রকাশ করা হয়।
খোলা চিঠিতে বলা হয়, সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট ও একটি বৃহৎ বাণিজ্য সংস্থা (সিকদার গ্রুপের মালিকানাধীন আরএন্ডআর হোল্ডিংস লিমিটেড) এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যৌথভাবে হোটেল নির্মাণ করা এবং ট্রেকিং, সাঁতার, ক্যাবল কার চড়া ও ১২টি বিলাসবহুল ভিলার জন্য পার্শ্ববর্তী ভূমি ব্যবহারের জন্য আদিবাসী ম্রোদের জুমভূমি, গ্রামের বন, শ্মশানভূমি, অন্যান্য পবিত্র স্থান, ও অন্যান্য ফলের বাগান বেদখল করেছে। গত ১২ সেপ্টেম্বর ২০২০ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও সিকদার গ্রুপের এক ঘোষণার মাধ্যমেই কেবল প্রকল্পটির কথা প্রচার করা হয়। বিলাসবহুল হোটেল ও সংশ্লিষ্ট পর্যটন সুযোগ-সুবিধার স্থাপনা নির্মাণ কার্যকরভাবে আদিবাসী ম্রো জনগোষ্ঠীর সামাজিক, অর্থনৈতিক, ঐতিহ্যগত ও সাংস্কৃতিক কাঠামোকে ধ্বংস করে দেবে। এই ভূমি ব্যতীত টিকে থাকার কোন উপায় নেই ম্রো গ্রামবাসীদের, সর্বোপরি এই বাস্তুচ্যুতি ও উচ্ছেদ আদিবাসী ম্রো জনগোষ্ঠীর সভ্যতার ইতিহাসে ধ্বংস ডেকে আনবে বলেও চিঠিতে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।
চিঠিতে আরও বলা হয়, এই প্রকল্প কেবল বাংলাদেশের সংবিধান, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭, এবং চুক্তি সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিমালাসমূহ লংঘন করছে না, এটা জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশন ও মানবাধিকার পরিষদসহ মানবাধিকারের সুরক্ষা ও উন্নয়নে আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ সরকারের অঙ্গীকার ও বাধ্যবাধকতারও লংঘন।
সংগঠনসমূহ, ম্রো সম্প্রদায়ের সদস্যরা যারা প্রকল্পটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংঘটিত করেছেন, যারা রাষ্ট্রীয় পক্ষের হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেছেন তাদের নিরাপত্তা ও শারীরিক নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বেগ তুলে ধরেন। ম্রো সম্প্রদায়ের সদস্যরা যদি ভবিষ্যতে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের পরিকল্পনা ও আয়োজন করে, তাহলে সেনাবাহিনী তাদের প্রকাশ্যে নির্বিচারে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যার হুমকি দিয়েছে।
সংগঠনসমূহ ও ব্যক্তিগণ সরকারের নিকট নিম্নোক্ত আহ্বান জানান-
-অবিলম্বে চিম্বুক-থানছি সড়কে বিলাসবহুল হোটেল নির্মাণ পরিত্যাগ করুন, এবং নিশ্চিত করুন যে, ম্রো ও অন্যান্য আদিবাসী ভূমিতে আরও যেকোনো নির্মাণ ও স্থাপনার ক্ষেত্রে জাতিগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতিকে সম্মান জানানো হবে।
-সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে বাংলাদেশের অঙ্গীকার অনুসারে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা সুরক্ষা ও উন্নয়ন করুন।
-অবিলম্বে প্রকল্পটির বিরুদ্ধে আদিবাসী ম্রো জনগোষ্ঠীর শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আন্দোলনের কর্মীদের হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন বন্ধ করুন।
-(ভান করা প্রতিবাদ ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অবৈধ আটকাবস্থার বিষয়ে) একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন কর্তৃক তদন্ত পরিচালনা করা হোক।
-আদিবাসী ম্রো সমাজ ও তাদের প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠনসমূহের সাথে তাদের উদ্বেগ বিষয়ে গঠনমূলক সংলাপ গড়ে তুলুন।
-পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭ এর দ্রুত, যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য একটি সময় কাঠামো বা রোডম্যাপ ঘোষণা করুন।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এআইপিপি’র সেক্রেটারি জেনারেল গ্যাম এ শিমরে বলেন, ‘বাংলাদেশে ম্রো আদিবাসী ভূখন্ডে একটি পাঁচতারা হোটেল নির্মাণ অবৈধ।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটা আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী, বিশেষত ম্রো জনগোষ্ঠীর স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতির অধিকারের সাথে যুক্ত কর্ম ও মানবাধিকার এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদন্ড সংক্রান্ত জাতিসংঘের নির্দেশক মূলনীতির মধ্যে পড়ে। সরকারকে অবিলম্বে নিশ্চিত করতে হবে যে, সেনাবাহিনী ও কোম্পানিটিকে জবাবদিহির আওতায় আনা হবে এবং পার্বত্য শান্তি চুক্তি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদন্ডসমূহকে সম্মান করে ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সাথে সংলাপ করা হবে।’
অপরদিকে, ইবগিয়া’র নির্বাহী পরিচালক ক্যাটরিন ওয়েজেনদর্প বলেন, ‘আদিবাসী ম্রোরা তাদের জীবিকা, তাদের সংস্কৃতি, তাদের ঘরবাড়ি-তাদের সবকিছু হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন। এবং এটা কিসের জন্য? একটি পাঁচতারা হোটেলের জন্য। এটা হাস্যকর। বাংলাদেশ সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে, আদিবাসী অধিকারের প্রতি সম্মান জানানো হবে, এবং এইসব ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রকল্প অনুমোদনের পূর্বে যথাযথ প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।’