হিল ভয়েস, ১৬ ডিসেম্বর ২০২০, বান্দরবান: বান্দরবান পার্বত্য জেলার আলিকদম উপজেলার আদিবাসী জুম্ম অধ্যুষিত বিভিন্ন গ্রামের ঝিরি ও ছড়া থেকে অবাধে ও অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
একটি কায়েমি স্বার্থবাদী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী কর্তৃক দীর্ঘদিন ধরে এই পাথর ও বালু উত্তোলন ও পাচারের ফলে এলাকার ঝিরি, ঝর্ণা ও প্রাকৃতিক জলাধার শুকিয়ে যাচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এতে এলাকার মানুষের পানীয় ও ব্যবহার্য জলের সংকট যেমন দেখা দিচ্ছে, তেমনি জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্যও হুমকি সৃষ্টি করছে।
এলাকাবাসীর বারবার প্রতিবাদ এবং জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের একাধিক পদক্ষেপ সত্ত্বেও এখনও বন্ধ হয়নি এই পাথর ও বালু পাচার। ক্ষমতাসীন দলের কায়েমি স্বার্থবাদী একটি মহল পরিবেশ বিরোধী এই ব্যবসায় জড়িত থাকায় এই পাচার বন্ধ হচ্ছে না বলে অনেকের ধারণা।
জানা গেছে, আলীকদম উপজেলার মাতামহুরী রির্জাভ অঞ্চলে অবস্থিত বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকা থেকে একটি প্রভাবশালী ব্যবসায়ী চক্র দীর্ঘ দিন ধরে পাথর ও বালু পাচার করছে। সম্প্রতি আলিকদম উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক অবৈধভাবে পাথর ও বালু উত্তোলন ও পাচারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করলেও এই পাথর ও বালু পাচার থেমে নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। এইসব ব্যবসায়ীরা মেশিন নিয়ে পাথর ভাঙছে এবং ট্রাক দিয়ে এই পাথর ও বালু পাচার করে নিয়ে যাচ্ছে।
গত ১৪ ডিসেম্বর ২০২০ আলিকদম উপজেলাধীন কুরুকপাতা ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের আদিবাসী ম্রো অধ্যুষিত লেলং পাড়া ও বেওলা কার্বারি পাড়ার গ্রামবাসীরা বান্দরবান জেলার ডেপুটি কমিশনারের নিকট এবিষয়ে একটি অভিযোগপত্র দাখিল করেছেন। উক্ত গ্রামবাসীরা এই পাথর উত্তোলন ও পাথর ভাঙা বন্ধ করাসহ পাথর উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। এই অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকারীরা ম্রো গ্রামবাসীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হুমকি প্রদান করেছে বলেও অভিযোগ করেছেন গ্রামবাসীরা।
লেলং পাড়া ও বেওলা কার্বারি পাড়ার গ্রামবাসীদের পক্ষে অভিযোগ পত্রে স্বাক্ষর করেন- (১) পাইং ম্রো, গ্রাম-লেলং পাড়া; (২) মেনক্রাত ম্রো, গ্রাম-ঐ; (৩) চেরকম ম্রো, গ্রাম-ঐ; (৪) রেংঙন ম্রো, গ্রাম-ঐ; (৫) তংক্য ম্রো, গ্রাম-ভেওলা কার্বারি পাড়া; (৬) কাইনেট ম্রো, গ্রাম-লেলং পাড়া; (৭) কতনং ম্রো, গ্রাম-ভেওলা কার্বারি পাড়া; (৮) দাংয়া ম্রো, গ্রাম-লেলং পাড়া; (৯) পনক্লা ম্রো, গ্রাম-ঐ।
অপরদিকে গ্রামবাসীরা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন তারা হলেন- (১) মোঃ কামাল উদ্দিন, পিতা-মোঃ শফি, ঠিকানা-নয়াপাড়া; (২) মংচিংথোয়াই মারমা, পিতা-চাথুইপ্রু মারমা, ঠিকানা-আলিকদম বাজার পাড়া; (৩) মোঃ শাহীন, পিতা-অজ্ঞাত, ঠিকানা-খুল্যা মিয়া পাড়া; (৪) মোঃ ইউনুছ মিয়া, পিতা-মৃত হাজী খুইল্যা মিয়া, ঠিকানা-খুইল্যা মিয়া পাড়া; (৫) মোঃ ইলিয়াছ, পিতা-মোঃ ইউনুছ, ঠিকানা-নয়াপাড়া।
অভিযোগপত্রে গ্রামবাসীরা উল্লেখ করেন, ‘আমাদের পাড়াগুলি অত্যন্ত দুর্গম হওয়ার ফলে আমরা পাহাড়ি ঝিরি, ঝর্ণা ও নদীর পানি পান করিয়া জীবনধারণ করি। কিন্তু বর্ণিত বিবাদীগণ বিগত প্রায় একবছর যাবৎ আমাদের লেলং পাড়া, বেওলা পাড়ার বিভিন্ন ঝিরি ও নদীনালা থেকে তাদের নিয়োগকৃত লেবার দ্বারা অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন অব্যাহত রাখে। ফলে পাহাড়ি এলাকায় পানির উৎস হারিয়ে যাওয়ার কারণে আমরা পানির দূরূহ সংকট ভোগ করিতেছি।’ তারা আরও উল্লেখ করেন, ‘বর্ণিত বিবাদীগণকে আমাদের পাড়া তথা ঝিরি থেকে পাথর উত্তোলন না করার জন্য নিষেধ করিলে বিবাদীগণ অত্যন্ত প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালী লোকজন বিধায় আমাদেরকে পাড়া থেকে উচ্ছেদ করাসহ মামলায় জড়ানোর ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদান করে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এইসব পাথর পাচারকারীরা কুরুকপাতা ইউনিয়নের ৬,৭,৮ নং ওয়ার্ডের লেলং পাড়া, বেওলা পাড়া, গর্জন পাড়া, কাপুই পাড়া, দুঃখাই পাড়া, নেপীইউ ম্রো পাড়াসহ মাতামুহুরী রির্জাভ অঞ্চলের পাইনির ছড়া, কচুর ছড়া, বড় বুচি খাল, বড় বেতি, ছোট বেতি এলাকার বিভিন্ন ঝিরির শাখা প্রশাখা থেকে অব্যাহতভাবে পাথর ও বালু তুলছেন। এইসব পাথর উত্তোলন ও বালু পাচারে প্রশাসনের অনুমতি না থাকলেও তারা এসব অবৈধ কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
এদিকে এলাকাবাসীদের বাধা সত্বেও মাতামহুরী রির্জাভ অঞ্চলের ৮ নং ওয়ার্ড এর ইয়াংরিং ম্রো পাড়া ও ৬ নং ওয়ার্ড এর কোক্ষাই মুখ এলাকায় এস্কেবেটর যন্ত্র দিয়ে ঝিরি থেকে অবৈধ ভাবে পাথর ও বালু উত্তোলন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
কুরুকপাতা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ক্রাতপুং ম্রো বলেন, আলীকদম উপজেলার কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে পারমিট না থাকা সত্বেও আমার এলাকায় অবৈধ ভাবে প্রবেশ করে বিভিন্ন ঝিরি থেকে পাথর ও বালু তুলছে।