হিল ভয়েস, ২০ অক্টোবর ২০২০, ঢাকা: বান্দরবান পার্বত্য জেলার চিম্বুক পাহাড়ে ম্রোদের উচ্ছেদ করে পাঁচ তারকা হোটেল ও পর্যটন কেন্দ্র নির্মাণ সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধ পরিপন্থি বলে মত দিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। গতকাল ১৯ নভেম্বর রাত ৮.০০ টার দিকে আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস এর অনলাইন মতবিনিময় সভায় এ কথা বলেন বক্তারা।
গবেষণা ও উন্নয়ন কালেক্টিভ এর সহযোগিতায় উক্ত আলোচনা সভায় মিডিয়া পার্টনার হিসেবে ছিলেন আদিবাসীদের অনলাইন নিউজ পোর্টাল আইপিনিউজ বিডি। সংসদীয় ককাসের টেকনোক্র্যাট সদস্য জান্নাত-এ-ফেরদৌসী লাকীর পরিচালনায় এবং ককাসের আহ্বায়ক সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা’র সভাপতিত্বে উক্ত অনলাইন আলোচনায় যুক্ত থেকে আলোচনায় অংশ নেন সাংসদ ও ওয়াকার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এমপি, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাবেক সভাপতি ও সাংসদ র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি, আওয়ামীলীগের সাংসদ এ.কে.এম. ফজলুল হক এমপি, জনসংহতি সমিতির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক কে এস মং মারমা, মানবাধিকার কর্মী ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিসদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত, ককাসের টেকনোক্র্যাট সমন্বয়ক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল, আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, ককাসের কমিউনিটি প্রতিনিধি কাজল দেবনাথ, নির্মল রোজারিও এবং ভদন্ত সুনন্দপ্রিয় ভিক্ষু, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান, বান্দরবানের উন্নয়ন সংস্থা ‘অনন্যা’র নির্বাহী প্রধান ডনাই প্রু নেলী এবং পাহাড়ী ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য ও চিম্বুক পাহাড়ের বাসিন্দা রেং ইয়ং ম্রো প্রমুখ।
আলোচনায় ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সাংসদ রাশেদ খান মেনন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি বিশেষ অঞ্চল। পার্বত্য চুক্তি ও আইন অনুযায়ী এই প্রকল্প বৈধ হতে পারে না। কেবল সিকদার গ্রুপ নয়, কোনো গ্রপই এটি করতে পারে না। এছাড়া কোনো জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করে এ ধরনের অনৈতিক প্রকল্প সেখানে হতে পারে না বলেও মনে করেন এই সাবেক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী।
ককাসের অন্যতম সদস্য ও সাংসদ এ.কে.এম. ফজলুল হক বলেন, সিকদার গ্রুপ একটা সর্বগ্রাসী গ্রুপ। তারা কেবল বঙ্গোপসাগর খায় নাই, এখন পাহাড়েও হানা দিচ্ছে বলেও অভিযোগ এই সাংসদের। আদিবাসী ম্রোদের জায়গায় এই প্রকল্প যেন কোনো মতেই বাস্তবায়ন না হতে পারে তার জন্য সবাইকে সোচ্চার থাকার কথাও বলেন তিনি। এছাড়া পর্যটন মন্ত্রণালয়ে একটা লিখিত অভিযোগ করে এই ম্রো আদিবাসীদের অস্তিত্ব সংকট থেকে বাঁচানোরও আহ্বান জানান তিনি।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সাংসদ র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন সূত্র থেকে এই সর্বগ্রাসী প্রকল্পের কথা যখন জানলাম তখন আমি সংশয় প্রকাশ করি। আমি মনেকরি, আমাদের পর্যটন বিকাশের যথেষ্ট সুযোগ আছে। কিন্তু এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেকেই দুর্বৃত্তায়নে মেতে ওঠে। এই প্রকল্পও তার একটা অংশ বলেও মনে করেন এই সাংসদ। পর্যটনকে আকর্ষণ করতে হবে কিন্তু স্থানীয় আদিবাসীদেরকে বিপন্ন করে নয় বলেও দাবী করেন তিনি। এছাড়া যদি কিছু করতে হয় তাহলে সেখানকার আদিবাসীদের জনজীবনকে বিপন্ন করে এবং পার্বত্য চুক্তিকে লঙ্ঘন করে করা উচিত নয় বলেও মনে করেন তিনি।
জাসদ সভাপতি ও সাংসদ হাসানুল হক ইনু বলেন, আমি পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান, এমনকি সরকারের কোনো মন্ত্রণালয় আইনের উর্ধ্বে নয়। সবাইকে আইন মেনেই কাজ করা উচিত। পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি বিশেষ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত অঞ্চল যার বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের জন্যই পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি করা হয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আঞ্চলিক পরিষদ, ভূমি কমিশন এবং এই অঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যত্নবান করা হয়েছে। এই চুক্তির ছাতার তলে পাহাড়ের প্রশাসন, উন্নয়ন সবকিছু আইন অনুসারেই করতে হবে। পাহাড়ের এক শতক জমি কিনতেও আইন অনুযায়ী করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যারা অনুমতি দিয়েছে তারা আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন করেই দিয়েছে। স্থানীয় জনগণের সাংস্কৃতিক ভারসাম্য, জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার বিরুদ্ধে যারা আইন বহির্ভূত সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে বলেও দাবি করেন তিনি। এছাড়া শান্তি চুক্তির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনতে হবে বলেও মনে করেন তিনি। এ প্রকল্প বন্ধে সবসময় তিনি সোচ্চার থাকবেন বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন সাবেক এই মন্ত্রী।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, ককাসের পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থলে সফর করে স্থানীয়দের সাথে মতবিনিময় করা এবং প্রধানমন্ত্রীকে অবগত করা উচিত। এছাড়া সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষকে জাষ্টিস ডিমান্ড নোটিশ দিয়ে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনের কথাও বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, পাহাড়ে শান্তিচুক্তি হয়েছে আমরা জানি, কিন্তু এই চুক্তির কোনো বাস্তবায়ন নেই। কেন বাস্তবায়ন নেই সেগুলোও কমবেশি আমরা জানি। পাহাড়ে এখন যা হচ্ছে সবই স্বেচ্ছাচারমূলক মানসিকতার প্রতিফলন বলে মনে করেন তিনি। তাই পাহাড়ের মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে এবং অসহায় হয়ে পড়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নে দীর্ঘ সূত্রিটা হলে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে যা কারোর কাম্য নয় বলেও মনে করেন এই মানবাধিকার কর্মী।
আদিবাসী নেতা সঞ্জীব দ্রং প্রশ্ন তুলে বলেন, যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকেন তারা আসলেই পাহাড়িদেরকে নাগরিক বা মানুষ মনে করে কিনা। যারা স্বাধীনতার সুফল পেয়ে বিকশিত হচ্ছে তারা আসলে ম্রোদেরকে মানুষ মনে করে কি না। ম্রোদেরকে দেশান্তরী করলেই এই রাষ্ট্র কি বড় হয় কিনা বলেও প্রশ্ন তোলেন এই আদিবাসী নেতা। এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের প্রতিশ্রুত নির্বাচনী ইশতেহার লঙ্ঘনের কথাও বলেন তিনি।
অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল বলেন, ম্রোদের মত এত নির্বিরোধী জাতিকে বিনষ্ট করার যে প্রকল্প নেয়া হয়েছে তা তাদেরকে গলা টিপে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। কেবল ম্রোদের নয় পাহাড়ের শান্তিচুক্তিকেও পদদলিত করা হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি। এই প্রকল্প দ্রুত বন্ধ করার জন্যও জোর দাবি জানান এই আদিবাসী গবেষক।
উক্ত আলোচনায় জনসংহতি সমিতি নেতা কে এস মং বলেন, ম্রোদের এই লড়াইটা অস্তিত্বের। চিম্বুকে পর্যটন স্থাপনা নিয়ে ২০১৪ সালে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তীতে ২০১৫ সালে নিরাপত্তাবাহিনী সিকদার গ্রুপের সাথে ৪০ বছর ব্যাপী একটি চুক্তি করে সেখানে অবকাঠামো নির্মাণ এবং পর্যটন স্থাপনার পরিকল্পনা করে। যা বাংলাদেশের সংবিধান, পার্বত্য চুক্তি এবং জেলা পরিষদ আইন সহ অন্যান্য সকল আইনকে লঙ্ঘন করে করা হয় বলে অভিযোগ করেন তিনি। এছাড়া পাহাড়ে কোনো ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যাপারে আঞ্চলিক পরিষদের অনুমতির বাধ্যবাধকতার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
ম্রো জাতিগোষ্ঠীর কালচারাল শো আয়োজন নিয়ে পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ নেতা রেং ইয়ং ম্রো বলেন, এই ম্রোদের হাজার হাজার একর ভূমি হারানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে। হঠাৎ করে নিজেদের ভূমিতে কর্পোরেট কোম্পানির মানুষ এসে বলছে পর্যটন স্থাপনা হবে। তাই তাদের অস্তিত্বের কথা চিন্তা করেই কালচারাল শো করেছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি। এছাড়া যারা এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন তাদেরকে নানা ধরনের হুমকির সম্মুখীন হতে হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। ম্রোদেরকে নিজেদের স্বার্থের বিরুদ্ধে নাটকীয়ভাবে দাঁড় করানো হচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
সভাপতির বক্তব্যে সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ও সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, এই প্রকল্পের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান এবং পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিও লংঘিত হচ্ছে। এছাড়া শান্তিচুক্তি এবং আদিবাসীদের প্রচলিত প্রথা, রীতি, ভূমি ব্যবস্থা এসব কিছুকেই ভুলুন্ঠিত করেই এই কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন হচ্ছে। এই প্রকল্প অনতিবিলম্বে বন্ধ করতে হবে বলেও দাবি করেন তিনি। পরিবেশ, জনগোষ্ঠী ও মানুষকে বিপন্ন করে কোনো প্রকল্প উন্নয়ন প্রকল্প হতে পারে না বলেও মনে করেন এই সাংসদ।
এছাড়া উক্ত আলোচনায় অংশ নেন ককাসের কমিউনিটি প্রতিনিধি কাজল দেবনাথ, নির্মল রোজারিও এবং ভদন্ত সুনন্দপ্রিয় ভিক্ষু, পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির সভাপতি গৌতম দেওয়ান, বান্দরবানের উন্নয়ন সংস্থা অনন্যার নির্বাহী প্রধান ডনাই প্রু নেলী।