হিল ভয়েস, ১১ অক্টোবর ২০২০, বান্দরবান: লামা উপজেলাধীন সরই ইউনিয়নের এলাকায় ডলুছড়ি, লুলেইন ও বমু মৌজায় ‘কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন’ কর্তৃক ২০০১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আদিবাসী ম্রো জনগোষ্ঠী এবং আদি ও স্থায়ী বাঙালি অধিবাসীদের আনুমানিক ২০০০ একরের মতো বিস্তর এলাকা জবরদখল করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ভূমি জবরদখলের শিকার কেবল আদিবাসী জুম্মরা নয়, কতেক ক্ষেত্রে স্থায়ী বাঙালি অধিবাসী ও সেটেলার বাঙালিরাও শিকার হয়েছে। তার অন্যতম শিকার হলেন আব্দুর রশিদ নামে এক স্থায়ী বাঙালি কৃষক।
লামায় আবারো আব্দুর রশিদ নামে এক কৃষকের চাষের জমি ও আবাদি পাহাড় দখলের অভিযোগ উঠেছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে। আব্দুর রশিদের ছেলে ভুক্তভোগী কৃষক রফিকুল ইসলাম ও স্থানীয় জনগণ জানায়, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন একের পর এক মানুষের জায়গা গায়ের জোরে দখল করছে। অর্থ, ক্ষমতা ও লোকবল থাকায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না। যারা তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে তাদের অসংখ্য মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। কোয়ান্টাম এই এলাকার মানুষের কাছে এক আতংকের নাম।
ভুক্তভোগী রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার বাবা আব্দুর রশিদ লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের ৩০৩নং ডলুছড়ি মৌজাস্থ লম্বাখোলা এলাকায় আর/৬২৫ হোল্ডিং মূলে ৪.৫০ একর ও পার্শ্ববর্তী ১১নং খতিয়ানের ৪৯ হোল্ডিংয়ের ১.০০ একর জায়গার মালিক। উক্ত ৪৯ নং হোল্ডিংয়ে আমার চাচা তমিজ উদ্দিনের নামে ১.০ একর জায়গা আছে। তিনি ঝিনাইদাহ থাকেন। উক্ত ১.০ একর জায়গা তিনি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের কাছে বিক্রয় করেন। কিন্তু কোয়ান্টাম আমার চাচার ১.০ একর জায়গা দখল করতে গিয়ে আমার বাবার নামীয় আর/৬২৫ হোল্ডিংয়ের ৪.৫০ একর ও তার পার্শ্বে খালের পাড়ে আমাদের দীর্ঘদিনের শ্রমে তৈরি করা ২ কানি খাস জমি জোরপূর্বক ঘেরাবেড়া দিয়ে দখল করে নিয়েছে। এবিষয়ে আমি নিরুপায় হয়ে লামা সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেছি। সিআর মামলা নং-৪৯, তারিখ- ১৮ মার্চ ২০২০।
তিনি আরো বলেন, একই এলাকায় এই জমির উত্তর পাশে আমার বাবা ও আমরা কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের কাছে আর/৪৩৭ থেকে ৪.০ একর, আর/৪৪৫ থেকে ৩.৫০ একর ও আর/৪৪৬ থেকে ৩.৫০ একর মোট ১১ একর জায়গা বিক্রি করি। সেখানেও কোয়ান্টাম ১১ একরের জায়গায় প্রায় ১৪ একর জায়গা গায়ের জোরে দখল করে নিয়েছে। এই এলাকার মানুষ তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে। আমরা সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
লম্বাখোলা এলাকার প্রবীন মানুষ মোঃ খলিলুর রহমান বলেন, আজ ১০ অক্টোবর ২০২০ শনিবার ঢেঁকিছড়া এলাকায় বজল আহমদ নামে এক ব্যক্তিকে তার জমি থেকে ফেরার পথে কোয়ান্টামের লোকজন আটক করে। পরে সরই পুলিশ ফাঁড়ি থেকে পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে আনে। সরই পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পুলিশ পরিদর্শক) আবুল হাসেম বলেন, ঝামেলা হচ্ছে শুনে আমি নিজে গিয়ে বজল আহমদকে নিয়ে আসি। পরবর্তীতে পুলিশকে অবহিত করে নিজের জায়গায় যাওয়ার জন্য তাকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
উক্ত ওয়ার্ডের ইউপি মেম্বার মোঃ আশরাফ আলী বলেন, কোয়ান্টামের অন্যায় অত্যাচারে অতিষ্ট এলাকাবাসী। এদের অর্থ, ক্ষমতা ও লোকবল থাকায় যা ইচ্ছে তা করছে। এলাকার মানুষের ক্ষোভ দিনে দিনে বাড়ছে। যে কোন সময় জনগণের সাথে তাদের সংঘাত হতে পারে। তাদের শতশত লোক আছে। মুহর্তে লোকজন এনে ঘিরাবেড়া দিয়ে মানুষের জায়গা দখল করে নেয়। রফিুকুল ইসলামের বাবার নামের জায়গাটি দিনে-দুপুরে লোকজন দিয়ে দখল করে নিয়েছে কোয়ান্টাম। সে সময় রফিকুল ইসলাম তার মা ও বোনকে মারধর করে আহত করেছে। তারা বিচার দিয়েও পায়নি।
এবিষয়ে জানতে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন সরই অর্গানিয়ার আরিফুল ইসলামের মুঠোফোনে কল দিলে তিনি ফোন রিসিভ না করায় তাদের বক্তব্য দেয়া সম্ভব হয়নি। সরই ইউপি চেয়ারম্যান ফরিদ উল আলম বলেন, আমরা সাধারণ মানুষ। কোয়ান্টামের সাথে ক্ষমতাসীন মহল ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীসহ দেশের সব বড় মানুষের সম্পর্ক। আমাদের কথা তারা শুনবে না।
উল্লেখ্য যে, লামা উপজেলাধীন সরই ইউনিয়নের এলাকায় ডলুছড়ি, লুলেইন ও বমু মৌজায় ‘কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন’ কর্তৃক ২০০১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আনুমানিক ২০০০ একরের মতো যে বিস্তর এলাকা জবরদখল করা হয়েছে সেসব জায়গা-জমি ছিল মূলত আদিবাসী ম্রো গ্রামবাসীর জুম ভূমি। লামায় কোয়ান্টাম সংস্থা কর্তৃক ভূমি বেদখলের কারণে এলাকার ২৫০ পরিবার ম্রো গ্রামবাসীরা জুম চাষ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে তাদের জীবন-জীবিকা হুমকির মধ্যে পড়েছে।
কতিপয় স্থানীয় ব্যক্তির সহায়তায় অর্থের বিনিময়ে কোয়ান্টাম কর্তৃক জুম্মদের জমি দখল করে চলেছে। ব্যক্তি নামে জমি ক্রয় করে কোয়ান্টামের জন্য দানকবলা করে হস্তান্তর করা হয় বলে জানা যায়। তবে অবৈধভাবে ক্রয়কৃত জমির পরিমাণের চেয়ে অনেক বেশি জমি প্রভাব খাটিয়ে ও জোর জবরদস্তি করে দখল করা হয়েছে বলে জানা যায়। যেমন জনৈক ম্রো পরিবারের ৩.০ একর জমিসহ আরো অনেকের ভূমি নিয়ে বিরোধ রয়েছে। এসব জায়গাজমি ক্রয় করার ক্ষেত্রে বা মালিকানা লাভের ক্ষেত্রে আইন মোতাবেক বান্দরবান জেলা পরিষদের পূর্বানুমোদন নেয়ার বিধান মানা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, ঢাকা থেকে দেখতে আসা অনেক প্রভাবশালী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদেরকে কোয়ান্টাম স্কুল ও কলেজের আশেপাশে এলাকায় জায়গা ক্রয় করতে উৎসাহিত করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এভাবে অতি সুক্ষ্মভাবে বহিরাগত কর্তৃক জমি দখল এবং ম্রোদেরকে তাদের স্বভূমি থেকে উৎখাত করার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা হচ্ছে।