মিতুল চাকমা বিশাল
রোহিঙ্গা সমস্যা:
২০১৭ সালে মায়ানমারের আরাকান রাজ্যে সংহিসতার জের ধরে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে এবং বাংলাদেশ সরকার তাদেরকে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় প্রদান করে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট ভোররাতে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি (আরসা) মায়ানমারের সেনাবাহিনী ও পুলিশের ৩০টি পোষ্টে একযোগে হামলা চালায়। এই হামলার পর থেকেই মায়ানমার সেনাবহিনীর অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ঢল নামতে শুরু করে। এর আগে সত্তর দশকের শেষান্তে ও নব্বই দশকে যেসমস্ত রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে তাদের কিছু অংশকে মায়ানমার নানা কূটনৈতিক চাপের মুখে ফেরত নিলেও অধিকাংশই বাংলাদেশে থেকে যায়, যাদের অধিকাংশই এখন রাজনীতিতে বিভিন্ন দলের ক্ষমাতসীন পদে বহাল রয়েছেন।
মায়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং এলাকায় ১৯৯১ সালে বন বিভাগের কয়েক শ একর পাহাড় কেটে তৈরি করা হয় প্রায় ১৫ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য শিবির। শুরু থেকেই স্থানীয়রা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে নারাজ ছিল, কেননা এতসংখ্যক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে গেলে অত্র এলাকার ভৌগলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলোর উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
শুরু থেকেই স্থানীয়দের অভিযোগ ছিল এই যে, পর্যাপ্ত কাজ না পেলে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন অপকর্মের সাথে যুক্ত হবে, এমনকি জঙ্গী তৎপরতা, মাদক চোরাচালান এসমস্ত কর্মেও যুক্ত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাছাড়া এতগুলো শিশু যখন লেখাপড়া করার সুযোগ পাবে না, তখন স্বভাবতই তারা বিপদগামী হয়ে কিশোর অপরাধে জড়িয়ে পড়বে।
২০১২ সালে স্থানীয়দের নেতৃত্বে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন আন্দোলন কমিটির ব্যানারে উক্ত শরণার্থী শিবিরের পাশে একটি সমাবেশ ও মানববন্ধন করা হয়। উক্ত সংগঠনটি ২০০৯ সাল থেকে অবৈধ রোহিঙ্গাদের মায়ানমারে ফেরত পাঠানোর দাবিতে আন্দোলন করছে। সংগঠনের আহ্বায়ক উখিয়া বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, বর্তমানে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবৈধভাবে বসবাস করছে। তারা দেশের শ্রমবাজার দখলের পাশাপাশি ইয়াবাসহ মাদক পাচার, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, অস্ত্র ব্যবসা ও জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত। এ কারণে দেশের জননিরাপত্তা ও পর্যটন শহর কক্সবাজারের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। এখন নতুন করে আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে কক্সবাজারে নিয়ে আসার চক্রান্ত করছে দেশি-বিদেশি একটি চক্র।
সংগঠনের সদস্য-সচিব নূর মোহাম্মদ সিকদার অভিযোগ করে বলেন, ‘কুতুপালং শিবির থেকে কিছু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রোহিঙ্গা ক্যাডার জঙ্গি সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারেটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) ও আরাকান রোহিঙ্গা ইসলামিক ফ্রন্টের (আরিফ) সঙ্গে আঁতাত করে মায়ানমারের ভেতর ঢুকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উসকানি দিচ্ছে এবং রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে বাধ্য করছে। তাদের উদ্দেশ্য কক্সবাজারের ভূমি দখল করে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার সমাগম ঘটিয়ে কক্সবাজারকে রোহিঙ্গা রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা (প্রথম আলো, ২৩ জুলাই ২০১২)।
২১ জানুয়ারি ২০১৬ “টেকনাফ নিউজে” প্রকাশিত “উখিয়ার বনভূমি নিধনে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী টাইগার বাহিনী” শিরোনামে বলা হয় যে, ৫০-১০০ জনের দলবদ্ধ রোহিঙ্গারা নানা অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বনে ঢুকে দিবারাত্রি ছোট বড় গাছ কাটার ফলে বনভূমির অস্তিস্ত সংকটে পড়েছে এ নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছে বনকর্মী ও সামাজিক বনায়নপ্রাপ্ত অংশীদারগণ।
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সালে যুগান্তরের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, পূর্ব শত্রুতার জের, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুন, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদকসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। রোহিঙ্গাদের এমন আচরণ ভাবিয়ে তুলেছে স্থানীয় জনসাধারণ ও প্রশাসনকে। সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে অপরাধ ক্রমাগত বাড়ছে। এক বছরে রোহিঙ্গাদের হাতে ২২ জন রোহিঙ্গা খুনসহ ৪ শতাধিক অপরাধ লিপিবদ্ধ হয়েছে উখিয়া-টেকনাফ থানায়। খুন, মাদক, অস্ত্র প্রদর্শনসহ রোহিঙ্গাদের নানা অপরাধে শঙ্কিত স্থানীয়রাও।
মায়ানমার থেকে বাংলাদেশের ভেতরে ইয়াবা নিয়ে আসার মূল কাজটা করে রোহিঙ্গারা। মায়ানমারের যারা ইয়াবা তৈরি করে, তারাই বাংলাদেশের ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, যাতে তারা গিয়ে ইয়াবা নিয়ে আসে। এরপর এগুলো বাংলাদেশি নানা চক্রের মাধ্যমে দেশের ভেতর ছড়িয়ে যায়। ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা কারাগারে রয়েছে।
২০১৯ সালের জানুয়ারি-জুন মাসে বিজিবির সাথে বন্দুকযুদ্ধে অন্তত ২০ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। যাদের অধিকাংশই মানব পাচার চক্রের সাথে যুক্ত (বিবিসি, ২৫ জুন ২০১৯)। ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, বিডি জার্নালে “রোহিঙ্গাদের যত অপকর্ম” শিরোনামে উল্লেখ করা হয় যে, গত রমজান মাসে একাধিক সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনাকারী সন্দেহে চার ব্যক্তিকে আটক করে মালয়েশিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী। আটককৃতদের মধ্যে দু’জন ছিলেন রোহিঙ্গা। পুলিশ জানায়, রোজার সময় কুয়ালালামপুর এবং আশেপাশের এলাকায় অনেক মানুষকে হত্যা ও সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা করছিলো ওই চারজন।
এছাড়াও একই বছরের ফেব্রুয়ারিতে মা ও দুই শিশু কন্যাকে অপহরণের অভিযোগ তুলে কক্সবাজারের উখিয়ায় তিন জার্মান সাংবাদিকসহ চার ব্যক্তির ওপর হামলা চালায় রোহিঙ্গারা। হামলার সময় সাংবাদিকদের গাড়ি ভাংচুর করে লুটপাট চালানো হয়।
রোহিঙ্গাদের হামলা, হত্যাসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়ানোর খবর আসছে ২০১৭ সাল থেকে। সে বছর এক মাসে রোহিঙ্গাদের অন্তত ৩০টি অপরাধের ঘটনা রেকর্ড করে টেকনাফ ও উখিয়া থানা। রোহিঙ্গাদের হামলায় তখন কমপক্ষে দু’জন পুলিশও আহত হয়।
সম্প্রতি পুলিশ জানায়, গত দুই বছরে কক্সবাজার এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছে ৩৩ জন রোহিঙ্গা। পুলিশের দাবি, নিহতরা বিভিন্ন ধরনের অপরাধকর্মে জড়িত ছিলেন। গত দু’ বছরে ক্যাম্পের ভেতরেই খুন হয়েছে ৪৩ জন। গত ০৩ অক্টোবর ২০২০ রোহিঙ্গা শিবিরে দুই গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলির ঘটনায় দুই জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও ১৫ জন।
রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের সুযোগও নিচ্ছেন অনেকে। ফলে কক্সবাজারে দেহব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন অনেক রোহিঙ্গা মেয়ে। কেউ ইচ্ছায়, কেউ অনিচ্ছায় জড়াচ্ছেন এই পেশায়। কক্সবাজারের কিছু সস্তা হোটেলে রোহিঙ্গা মেয়েরা যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করছেন।
১১ সেপ্টেম্বর ২০২০,বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,”রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কবে হবে জানে না কেউ। উপরন্তু রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়ভাবে সৃষ্ট নানা সংকট ও সমস্যা জটিল আকার ধারণ করছে। মাদক ও মানবপাচার, ডাকাতি ও বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা।”
সংখ্যাগত তারতম্য:
স্বরাষ্ট্র এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মায়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের বর্তমান সংখ্যা হচ্ছে ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন। এই হিসাব গত ২৮ মে ২০২০ পর্যন্ত। কিন্তু ডেইলী স্টারের অনুসন্ধানে জানা গেছে কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিগত ৩ বছরে প্রায় ৭৬,০০০ শিশুর জন্ম হওয়ার পরেও রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নেমে দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৬০ হাজারে। ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ(আইএসসিজি)-এর অনুসারে যা ২০১৮ সালের শেষের দিকে ছিল ৯ লাখ ৫৭ হাজার। সেই হিসেবে রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়।
২০২০ সালের জুলাই মাসের প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে, সবগুলো ক্যাম্প মিলিয়ে মোট রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ৮ লাখ ৬০ হাজার ৪৯৪ জন। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা ও শরণার্থীদের আগমনের পরে ২০১৭ সালে ১৬ সেপ্টেম্বর তারা একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ওই প্রাথমিক প্রতিবেদন বলছে, এক মাসে চার লাখ ৮০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছিল এবং এর আগেই কক্সবাজার এলাকায় দুই লাখ ১২ হাজারের মতো রোহিঙ্গা বাস করছিল। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত ‘রোহিঙ্গা মানবিক সংকটের জন্য যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা ২০১৯’ শিরোনামে আইএসসিজি প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর সাত লাখ ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আসে।
২০১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৭৩তম সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে এক দশমিক এক মিলিয়ন (১১ লাখ) রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে।
১১ সেপ্টেম্বর ২০২০, বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে সাত লাখ ৪১ হাজার ৮৪১ জন রোহিঙ্গা মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়াও আশ্রয়প্রার্থী এতিম শিশু রয়েছে ৩৯ হাজার ৮৪১ জন। আশ্রয় প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিবছর জন্ম নিচ্ছে ৩০ হাজারেরও বেশি শিশু। প্রতিবছর অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছে ৩৫ হাজারের বেশি নারী। রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের প্রায় ১০ হাজার একর ভূমি ব্যবহার হচ্ছে। শুধুমাত্র নতুন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ক্যাম্পের জন্য সাড়ে ছয় হাজার একর ভূমি বরাদ্দ করা হয়েছে।
ছড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা:
কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির পেরিয়ে রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশের জাতীয়পত্র হাতে আসছে তাদের। স্থানীয় প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের সহায়তায় তারা এসব কাগজপত্র হাতে পাচ্ছে। যার ফলে বাংলাদেশী পাসপোর্ট ব্যবহার করে তারা বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশেও পাড়ি জমাচ্ছে। ১১ ডিসেম্বর ২০১৯ চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানার বাদামতলী মোড় থেকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দুই কর্মকর্তাকে টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের এনআইডি দেয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়াও ৬৭ লাখ ৮৩ হাজার ২৯৬ টাকা হস্তান্তর ও স্থানান্তরের অভিযোগ এনে ইসির ৪ কর্মচারীসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়।
২০১৭ সালের ২৪ আগস্টের পর থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কেবলমাত্র এই ১৭ মাসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রায় ৫৭ হাজার রোহিঙ্গাকে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছে। সম্প্রতি গত ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের সময় যশোরের বেনাপোল থেকে ৭ জন রোহিঙ্গাকে আটক করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) (ডেইলী স্টার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০)।
পার্বত্য চট্টগ্রামে রোহিঙ্গা:
পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলাটি মায়ানমার এবং কক্সবাজারের সাথে অতি নিকটে হওয়ায় এখানে রোহিঙ্গারা অনেক আগে থেকেই অনুপ্রবেশ করছে। বিশেষ করে নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা, আলিকদম ও বান্দরবান সদরে রোহিঙ্গারা এখন অবস্থান করছে। তাদের হাতে রয়েছে বাংলাদেশী জাতীয় পরিচয়পত্রও। এই এলাকার কিছু প্রভাবশালী ব্যাক্তির আশ্রয়ে তারা এখন বাংলাদেশের নাগরিক। বিপুল অর্থের বিনিময়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র করতে সাহায্য করে চলেছে। যার ফলশ্রুতিতে সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও এখন তারা ভোগ করছে। নির্বাচনের সময়ে ভোটের ব্যালট হিসেবে ব্যাবহার করতেই রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
বান্দরবানের আলিকদম উপজেলায় ‘গত সাত থেকে আট বছর ধরে প্রায় ৫০০ রোহিঙ্গা পরিবার বসতি স্থাপন করেছে। এমনকি আলিকদমে বার্মাইয়া (বার্মিজ) পাড়া নামে একটি গ্রামও আছে। বান্দরবান সদর উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান উক্যনু মারমা বলেন, ‘২০০৭-২০০৮ সালের আগে এখানে কোনো রোহিঙ্গা পরিবার ছিল না। তবে এখন এই ইউনিয়নে ২০০টিরও বেশি রোহিঙ্গা পরিবার বসবাস করছে। তাদের মধ্যে প্রায় ৫০টি রোহিঙ্গা পরিবার ভোটার তালিকায়ও নিবন্ধিত আছে।’
নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুনধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যনের কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রায় ৫০০ রোহিঙ্গা ভোটারের লিস্ট রয়েছে তাদের কাছে, যেগুলো তারা আলাদা ফাইলে সযত্নে রেখে দিয়েছেন। ওয়ার্ড মেম্বারদের পক্ষ থেকে এসব ভোটারদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হলেও ঘুনধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান একেএম জাহাঙ্গীর আজিজ এগুলো বাতিলের জন্য কোন ব্যবস্থা করেননি।
জুন ২০২০ মাসের প্রথম সপ্তাহে করোনাভাইরাসের লকডাউন ভেঙ্গে কক্সবাজার থেকে পালিয়ে এসে রোহিঙ্গারা অবাধে বান্দরবান জেলায় প্রবেশ করছে। বান্দরবান পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডের কালাঘাটার ‘পাইংসি ঘোনা’ নামক পাড়ায় তারা আশ্রয় নেয়। পাইংসি ঘোনার পাশে রূপনগর নামে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত একটি গ্রাম অনেক আগে পার্বত্য মন্ত্রী বীর বাহাদুর স্বয়ং উদ্বোধন করেন।
গত ১লা জুন ২০২০ নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের মায়ানমার সীমান্ত ঘেষা বাইশফাঁড়ি এলাকায় বিজিবি’র সাথে সশস্ত্র রোহিঙ্গা ডাকাতদের বন্দুকযুদ্ধ হয়েছে। নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তবর্তী এলাকায় আরসা, আরএসও, আলিকান প্রভৃতি রোহিঙ্গা মুসলিম সশস্ত্র জঙ্গী গোষ্ঠীগুলোর ক্যাম্প ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে।
রাঙামাটি জেলার ৭টি উপজেলায় সর্বমোট ১২০টি রোহিঙ্গা পরিবারের সন্ধান পাওয়া গেছে। তারমধ্যে রাঙামাটি পৌরসভায় ১৫টি পরিবার, কাউখালী উপজেলায় ৭২টি পরিবার, কাপ্তাই উপজেলায় ১১টি পরিবার, বিলাইছড়ি উপজেলায় ১৩টি পরিবার, রাজস্থলী উপজেলায় ৩টি পরিবার, লংগদু উপজেলায় ৫টি পরিবার এবং বরকল উপজেলায় ১টি পরিবার রয়েছে বলে জানা গেছে।
খাগড়াছড়ি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ৫৬টি রোহিঙ্গা পরিবারের সন্ধান পাওয়া গেছে। তারমধ্যে মানিকছড়ি উপজেলায় ৩০টি পরিবার, মহালছড়ি উপজেলায় ১৫টি পরিবার, গুইমারা উপজেলায় ৫টি পরিবার এবং রামগড়, দীঘিনালা ও খাগড়াছড়ি সদরে ২টি করে রোহিঙ্গা পরিবার রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা ও রোহিঙ্গা:
পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার অন্যতম দিক ভূমি সমস্যা। নানাভাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনী, সরকারি-বেসরকারি এবং ব্যাক্তিগত উদ্যোগে বিভিন্ন প্রকারে জুম্মদের ভূমিকে দখল করা হচ্ছে। উন্নয়নের নাম দিয়ে ভূমি দখল করে, সেখানে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ ঘটানো হচ্ছে। সামাজিক বনায়ন, রাবার প্ল্যান্টেশন ও হর্টিকালচার প্লটের নাম করে হাজার হাজার একর ভূমি দখল করে জুম্মদের ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। পর্যটনের নাম দিয়ে মৌজাভূমি/জুমভূমিকে দখল করে, জুম্মদের জীবিকা নির্বাহের পথকে রোধ করে দিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বান্দরবানের বিভিন্ন জায়গায় রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ এই পরিস্থিতিকে আরো জটিল এবং ঘোলাটে করে তুলেছে। এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহল নিজেদের হীন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য রোহিঙ্গাদের অত্র এলাকায় বসবাসের সুযোগ প্রদান করছে।
বান্দরবানে বিশেষ করে লামা, আলিকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে প্রভাবশালী ভূমিদস্যুরা বিভিন্ন সময় জুম্মদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করছে এবং আরও অনেক জুমচাষী পরিবার উচ্ছেদ আতঙ্কে রয়েছে। ২০১৬ সালে লামা উপজেলার ছোট কলার ঝিরি এলাকায় শহিদুল ইসলাম নামে একজন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে ওই এলাকার ৮২টি ম্রো পরিবারের জুমের জায়গা দখলের অভিযোগ রয়েছে। ওই এলাকায় রশিদ আহমেদ নামে একজন রোহিঙ্গা যিনি অর্থের বিনিময়ে ম্রোদের জায়গা দখল করতে গিয়েছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রশিদ জানান, শহিদুল প্রায় ২০-২৫ জন রোহিঙ্গাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল এবং তাদের সেখানে থাকার ব্যবস্থা করেছিল। যেন ম্রোরা ভয়ে জায়গা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হন। বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের ২৯ মে ২০১৬ তারিখের ‘ম্রো লাইফ টার্নড আপসাইড ডাউন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছিল।
নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের বিছামারা, বাগানঘোনা ও ঠান্ডাঝিড়ি এলাকার খন্ড খন্ড পাহাড় চূড়ায় গড়ে উঠেছে রোহিঙ্গা বসতি। এসব বসতিতে ওপেন সিক্রেটভাবে চলছে মাদকের কারবার। একই এলাকার এক প্রভাবশালী ব্যাক্তির কাছ থেকে জমি ক্রয় করে তারা অনেকটা নিরাপদভাবেই সেখানে অবস্থান করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
২০১৮ সালে রোহিঙ্গা ডাকাতদের হয়রানি ও হুমকির ফলে চাক জনগোষ্ঠীর সাতঘর্য্যা গ্রাম পরিত্যাগ করতে হয়। এর কয়েক বছর আগে ভূমি বেদখলকারী ও রোহিঙ্গা ডাকাতের হুমকি ও হয়রানির ফলে নাইক্ষ্যংছড়ির বাদুঝিরি নিজ ভূমি থেকে চাক জনগোষ্ঠীর ১৫ পরিবার উচ্ছেদ হয়েছিল। নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকায় রোহিঙ্গা সশস্ত্র গ্রুপ কর্তৃক সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কমপক্ষে ২০ জনের মারমা ও তঞ্চঙ্গ্যা গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
আরএসও, আরসা ও আলিকান প্রভৃতি রোহিঙ্গা সশস্ত্র জঙ্গীরা নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় বাংলাদেশ-মিয়ারমার সীমানার ৩৯-৪১নং পিলার দিয়ে মায়ানমার থেকে এনে ইয়াবা ও বিভিন্ন ধরনের মাদক এবং স্বর্ণ ব্যবসা করে যাচ্ছে। এসমস্ত মালপত্রগুলো বাংলাদেশে এনে তারা নাইক্ষ্যংছড়িতে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে থাকে।
বাংলাদেশের এক দশমাংশ অঞ্চল জুড়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম হলেও এখানে আবাদী জমির পরিমাণ খুবই কম৷ অন্যদিকে কাপ্তাই বাঁধের ফলে প্রায় ৫৪ হাজার একর জমি পানির নিচে তলিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলশ্রুতিতে একটি বিশাল পরিমাণ বাস্তুচ্যুতের ঘটনা ঘটেছে এবং এই সময়ে বিভিন্ন বনাঞ্চলে মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। কেউ বা পাড়ি জমিয়েছে দেশ ছেড়ে বিদেশের মাটিতে। অন্যদিকে ৮০’র দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সমতল থেকে মুসলিম বাঙালি বসতি প্রদানের মধ্য দিয়ে এতদঞ্চলের ভৌগলিক এবং জনমিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটানো হয়।
অমুসলিম অধ্যূষিত পার্বত্য অঞ্চলকে মুসলিম অধ্যূষিত পার্বত্য অঞ্চলে পরিণত করার নীল-নকশা বাস্তবায়নের হীন পরিকল্পনা শুরু করা হয়। পর্যাপ্ত আবাদী জমি এবং বাসযোগ্য ভূমি না থাকায় জুম্মদের ভূমি দখল করে সেটেলারদের বসতি প্রদান করা হয়। ফলশ্রুতিতে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামকে এক সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে ধাবিত করানো হয়। অসহায় একটি শ্রেণিকে জুম্মদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে হিংস্রতার থাবা বসানো হয়েছে পাহাড়ে। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে কলুষিত করা হয়েছে এতদঞ্চলের আকাশ-বাতাসকে। যার রেশ এখনো কাটেনি, এখনো জুম্ম জনগণের ঐতিহ্যগত ও প্রথাগত ভোগদখলীয় ভূমিতে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ এবং পুনর্বাসন করানো হচ্ছে।
রোহিঙ্গা সংকট তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য এক অশানি সংকেত হয়ে আছে এখনো। মুসলমি বাঙালি সেটেলারদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে কোন এক সময় এ রোহিঙ্গারাও পার্বত্য চট্টগ্রামে ভয়াবহ রকমের ঘটনা সৃষ্টি করবে, এই আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেননা রাষ্ট্র সরাসরি রোহিঙ্গাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন না করলেও স্থানীয় আওয়ামীলীগ, বিএনপি ও জামায়েত ইসলামীর প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের সহায়তায় তারা এখন বাংলাদেশী নাগরিক বনে যাচ্ছে। বিগত সময়ে এবং বর্তমান সময়ে পুনর্বাসিত সেটেলারদের চাপে পাহাড়ের স্থায়ী অধিবাসীরা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ধারায় ধাবিত হচ্ছে। এই মুহুর্তে রোহিঙ্গাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে অনুপ্রবেশ, পার্বত্য চটগ্রামে ইসলামীকরণ এবং বাঙালিকরণের এক নব্য ষড়যন্ত্র বলেই প্রতীয়মান।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কড়া নজরদারি রাখা হয়েছে, এরকম বক্তব্য রাষ্ট্রপক্ষ এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হলেও কিভাবে রোহিঙ্গারা পার্বত্য চট্টগ্রামে তথা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে, তা অবশ্যই বিবেচনার দাবি রাখে। ২৪ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে ডয়েচ ভেলে (DW)’তে “রোহিঙ্গার চাপে পাহাড়, পাহাড়ী বিলীন হওয়ার আশঙ্কা” শীর্ষক শিরোনামে এক সংবাদ প্রকাশিত হয়। উক্ত সংবাদে বান্দরবান জেলার বিভিন্ন উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন যে, এখন হয়তো কিছু ঘটছে না। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে যে ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কেথায়?
বিশালায়তনের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির বান্দরবানের অতি নিকটবর্তী হওয়ায় এই আশঙ্কা আরো বেশি প্রকট। বর্তমানে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখলে সেই আশঙ্কার সত্যতা বোঝা যাবে। প্রতিনিয়ত অপরাধমূলক কার্যক্রমের সাথে লিপ্ত হচ্ছে রোহিঙ্গারা। মানবিকতার দোহাই দিয়ে রাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি এখনো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। স্বাভাবতই স্থানীয়দের মনে প্রশ্ন জাগে, যুগ যুগ ধরে ঐতিহাসিকভাবে বিশেষ শাসনব্যবস্থার দ্বারা পরিচালিত পার্বত্য অঞ্চলের জুম্ম জনগণের মৌলিক মানবাধিকারে বিষয়ে রাষ্ট্রের কোন মাথাব্যাথা নেই। অথচ হঠাৎ করে ধেয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রতি এত মানবতা কোন কিছুর ইঙ্গিত নয় তো! পার্বত্য চট্টগ্রামের বিগত সময়ের রক্তের দাগ না শুকাতেই রাষ্ট্র কি আবারো রোহিঙ্গাদের সুকৌশলে হীনউদ্দেশ্যে পাহাড়ে চাপিয়ে দেবে! প্রশ্ন থেকেই যায়।
তথ্যসুত্র: পিসিজেএসএস আর্কাইভ, হিল ভয়েসসহ বিভিন্ন জাতীয় ও অনলাইন দৈনিক এবং নিউজ চ্যানেল থেকে সংগৃহীত উপাত্ত।