হিল ভয়েস, ৭ অক্টোবর ২০২০, বান্দরবান: বান্দরবান পার্বত্য জেলার চিম্বুক পাহাড়ের উপর পাঁচ তারকা হোটেলসহ বিলাসবহুল পর্যটনের স্থাপনা বন্ধ করার দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি পেশ করেছেন স্থানীয় আদিবাসী নেতৃবৃন্দ।
আজ ৭ অক্টোবর ২০২০ স্থানীয় কাপ্রু পাড়া, দোলাপাড়া, এরাপাড়ার বাসিন্দা ও চিম্বুক পাহাড়ে বসবাসরত ম্রো জনপ্রতিনিধিবৃন্দ বান্দরবান জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট এই স্মারকলিপি পেশ করেন। এই স্মারকলিপিতে প্রায় দেড়শজন স্থানীয় ম্রো আদিবাসী স্বাক্ষর করেন।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, গত ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকা ট্রিবিউন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যে, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চট্টগ্রামের ২৪তম পদাতিক ডিভিশন ও বান্দরবানের ৬৯ পদাতিক বিগ্রেডের সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট এবং সিকদার গ্রুপ (আর এ্যান্ড আর হোল্ডিংস) এর যৌথ উদ্দ্যোগে চিম্বুক পাহাড়ে হোটেল ম্যারিয়ট নামের এই পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ করা হবে। হোটেল বিল্ডিং এর সাথে থাকবে আলাদা ১২টি বিলাসবহুল ভিলা, আধুনিক ক্যাবল রাইড ও সুইমিং পুল।’ সাম্প্রতিককালে পর্যটনের নামে সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট ও কিছু করপোরেট কোম্পানীর ক্রমাগত ভূমি দখল করার কারণে স্থানীয় আদিবাসীদের টিকে থাকাটা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়, ‘সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট ওয়াইজংশন, চিম্বুক চূড়া এলাকা, কাপ্রু পাড়া এলাকায় নীলগিরি নাম দিয়ে ভূমি দখল করেছে। একইভাবে একই চিম্বুক রেঞ্জ আলীকদম লামা সড়কের ক্রাউডং পাহাড়ে ২১ কিলোমিটার থেকে ২৬ কিলোমিটারে প্রায় ৬ কিলোমিটার এলাকা সেনাবাহিনী সংরক্ষিত এলাকা সাইনবোর্ড দিয়ে রেখেছে। সেখানে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। ১৯৮০ এর দশকে অশান্ত পরিস্থিতির সময় ঐ এলাকায় উচ্ছেদ কুলিং ম্রো পাড়াটির পুনঃস্থাপনেও বাঁধা দেওয়া হচ্ছে।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, ‘মোট অবৈধ দখলের জমির অবস্থান এবং পরিমাণ হচ্ছে, বান্দরবান চিম্বুক-থানচি সড়কের ৪৭ কিলোমিটার কাপ্রু ম্রো পাড়া (সেনাবাহিনী পরিচালিত নীলগিরি অবকাশ যাপনকেন্দ্র এলাকা) থেকে নাইতং পাহাড় (সেনা কল্যাণ ট্রাস্টের দেওয়া নাম চন্দ্রপাহাড়) হয়ে জীবননগর পর্যন্ত ৫২ কিলোমিটার। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার জায়গার এলাকা। জমির পরিমাণ আট শতাধিক (৮০০) একর।’
এতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘করোনা ভাইরাসের দুর্যোগের সময় বান্দরবান-চিম্বুক-থানচি সড়কে সেনা কন্যাণ ট্রাস্ট ও এক্সিম ব্যাংকের এমডি হত্যার চেষ্টা মামলার পলাতক আসামিদের সিকদার গ্রুপ (আর এ্যান্ড আর হোল্ডিংস) উপরে বর্ণিত জায়গায় আট শতাধিক একর জমি সম্পূর্ণ অবৈধভাবে দখল করছে।’
আরও বলা হয়, ‘সম্পূর্ণভাবে অবৈধ এবং বেআইনিভাবে দখল করা এ জমিতে দোলাপাড়া, কাপ্রু পাড়া, এরা পাড়ার শতাধিক ম্রো পরিবার বংশপরম্পরায় বহু প্রজন্ম ধরে ফলজ এবং বনজ বাগান করে জীবনধারণ করে আসছে। বর্তমানে তাদেরকে নিজেদের জমি ও বাগানেও সেনাবাহিনীরা ঢুকতে দিচ্ছে না।’
স্মারক লিপিতে আরেও উল্লেখ করা হয়, ‘সম্প্রতি সেনাবাহিনীর সদস্যরা এই বিশাল এলাকার জরিপ করে বিভিন্ন স্থানে সাইনবোর্ড ও খুটি বসিয়ে দেয়। এতে করে পাড়াবাসীর শত শত বছরের সংরক্ষিত পাড়া বন, শশ্মানভূমি, জুম চাষের জমি, ফলজ-বনজ বাগানের সবকিছু দখলে চলে গিয়েছে। এই অবস্থায় কাপ্রু পাড়া, দোলাপাড়া ও এরাপাড়া উচ্ছেদ হবে। একইভাবে মার্কিনপাড়া, লংবাইতং পাড়া, মেনসিং পাড়া, রিয়ামানাইপাড়া ও মেনরিং পাড়া উচ্ছেদের মুখে পড়েছে। স্থানীয় সেনাক্যাম্প থেকে পাড়ার কার্বারী ও পাড়াবাসীদের ডেকে দখলকৃত জায়গা জমি নিয়ে কোনো কথা না বলার জন্য হুমকি দেওয়া হয়েছে।’
উল্লেখ্য, সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট ও সিকদার গ্রুপের দাবি মোতাবেক ২০০৭ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে (স্মারক প্রম/ই-৩/২০০৬/ডি-৯/২৬৭ তারিখ ১১.০৭.২০০৭) ১৬ একর জমি বান্দরবান সেনাজোনের নামে আবেদন করা হয়। ঐ আবেদনে ১৬ একর জমির অবস্থান প্রথমে জীবননগর উল্লেখ করা হয়। একই আবেদনে আবার একই ১৬ একরের অবস্থান ৩৫৫ নং সেপ্রু মৌজার কাপ্রু পাড়ায় বলা হয়েছে।
স্মারকলিপির শেষে বলা হয়, ‘পাহাড় কেটে বিলাসবহুল হোটেল স্থাপনা এবং শত শত কর্মকর্তার বাসস্থান নির্মাণ, পাহাড়ের জলধারায় ও ঝর্ণায় বাঁধ নির্মাণ করা হলে প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই অনতিবিলম্বে এ ভূমি অধিগ্রহণ বন্ধের দাবি জানান। এই ধরনের ভূমি দখল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও পার্বত্য অঞ্চলের বিদ্যমান আইন লঙ্ঘনেরও সামিল বলা হয়।’
এছাড়া, সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর কান্ট্রি ডিরেক্টরের নিকট স্মারকলিপির অনুলিপি প্রেরণ করা হয়।