নীলোৎপল খীসা
পার্বত চট্টগ্রামকে অস্থির, সংঘাতময় ও নিরাপত্তাহীন এক অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে। মানুষের স্বাভাবিক জীবন এখানে বিঘ্নিত, পদদলিত। মানুষকে প্রতিনিয়ত তাড়িত করে ভীতি, আশংকা, উদ্বেগ। রাষ্ট্রীয় ষড়ষন্ত্র, সন্ত্রাস, ‘ভাগ কর, শাসন কর’ নীতির ফলে সৃষ্ট অনৈক্য, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও সাম্প্রদায়িক হামলা এবং প্রসাশনের স্বেচ্ছাচারিতাই এর মূল কারণ।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নই পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার একমাত্র সমাধান – এ কথাটি সর্বজন স্বীকৃত। পার্বত্যাঞ্চলের ভূমি সমস্যার সমাধান; জুম্মদের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিতকরণ; ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধকরণ; সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিতকরণ করতে হবে। অপরদিকে নিরাপত্তহীনতা, ধর্ষণ, হত্যা, গুম, অপহরণ, বে-আইনী আটক, হয়রানি, সাজানো ও মিথ্যা মামলা দায়ের ও গ্রেফতার ইত্যাদি দমন-পীড়ন ও নির্যাতনের অবসান একমাত্র পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সম্ভব।
বাংলাদেশের প্রগতিশীল, মানবতাবাদী ও গণতন্ত্রমনা মানুষ চুক্তি বাস্তবায়নের মাধ্যমে এতদাঞ্চলের সমস্যার সমাধানের কথা বললেও সরকার, সামরিক ও বেসামরিক আমলার একাংশ চুক্তি বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় বাধা। এই চুক্তিবিরোধী মহল এ ধরণের বাধা সৃষ্টি করে সংকীর্ণ, অগণতান্ত্রিক, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও মৌলবাদী মানসিকতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী শক্তি ও উন্নয়নকামী মানুষ অবশ্যই এই চুক্তিবিরোধী গোষ্ঠীকে মোকাবেলা করতে এগিয়ে আসবে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভিন্ন ভাষাভাষী ১৪টি জুম্ম জাতিসমূহ নিজ ভূমে পরবাসীর মত নিরাপত্তাহীন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় থাকতে বাধ্য হচ্ছে। জুম্ম জাতি বাংলাদেশের বাঙালি জাতি থেকে স্বতন্ত্র জাতি হয়েও তাদের স্বতন্ত্রতার বা স্বকীয়তার পরিচয় বাংলাদেশের সংবিধানে স্বীকৃত হয়নি। বরং সংবিধানে বলা হয়েছে- বাংলাদেশের জনগণ বাঙালি বলে পরিচিত হবেন। অর্থাৎ, জুম্মদেরকে বাঙালি বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ‘জুম্ম জাতি’ হিসাবে স্বীকৃতি না দিয়ে সংবিধানে তাদেরকে ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তা’, ‘নৃগোষ্ঠী’, ও ‘সম্প্রদায়’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে তাদের জাতীয় পরিচিতিকে তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞা করা হয়েছে- যা জুম্ম জাতি মানতে পারেনি, আর মানা সম্ভবও নয়। জুম্ম জাতিকে বাঙালিকরণের এই হীন, জঘন্য ও অপমানকর অপচেষ্টা জুম্ম জাতিকে নিশ্চিহ্নকরণের ঘৃণ্য উদ্যোগ ছাড়া আর কিইবা হতে পারে। এসব অপরিনামদর্শী কর্ম দ্বারা জুম্মদের মধ্যে অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রামী মনোভাব তীব্র হবেই সেটাই স্বাভাবিক, এবং অতীতে যেমনি হয়েছিল, বর্তমানেও হচ্ছে তাই।
১৯৭২ সাল থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত জুম্ম জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে দুইটি অংশে ভাগ করে মূল্যায়ন করা যায়। প্রথম অংশ ১৯৭২ সাল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠন এবং তার নেতৃত্বে জুম্ম জণগণের অধিকার আদায়ের গণতান্ত্রিক ও অগণতান্ত্রিক আন্দোলন ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে সফল সমাপ্তি ঘটে। বাংলাদেশ সরকারই জুম্ম জনগণকে এই আন্দলনে ঠেলে দিয়েছিল যে আন্দোলনে জুম্ম জনগণ অবর্ণনীয় নিপীড়ন, নির্যাতন, হত্যা, নারী-ধর্ষন, ভূমি বেদখলসহ বহুবিধ মানবাধিকার লংঘনের শিকার হয়েছিল। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে আওয়ামীলীগ সরকার জুম্ম জনগণের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সংবলিত চারদফা দাবিকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছিল। এতে করে শাসকগোষ্ঠীর উগ্রজাত্যভিমান, অগণতান্ত্রিক, উপনিবেশবাদী ও উগ্র-সাম্প্রদায়িক মানসিকতা উন্মোচিত হয়েছিল।
আন্দোলনের দ্বিতীয় অংশে দেখা যায়, চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই সরকারের একটি অংশ এবং পার্বত্যাঞ্চলে কর্মরত সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই-এর চুক্তি বিরোধী অব্যাহত কর্মকান্ড ও ষড়যন্ত্রের ফলে চু্ক্তি বাস্তবায়নে সরকারের সদিচ্ছা সম্পর্কে জনগণের মনে সন্দেহের বীজ রোপন করে। ভূমি সমস্যার সমাধান, অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের ক্ষমতায়ন ও নির্বাচনসহ চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন কেবল সরকারের বক্তব্যের মধ্যেই সীমিত ছিল। সরকারের কথা এবং কাজের মধ্যে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। উপরন্তু সরকার চুক্তিবিরোধী ও চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালিয়ে আসছে।
পাশাপাশি চুক্তির একটি পক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতা-কর্মীদের দমন-পীড়ন, মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে প্রেরণ ও এলাকাছাড়া করেছে। চুক্তির মাধ্যমে অর্জিত পার্বত্য মন্ত্রণালয়, তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডকে চুক্তি বিরোধী কর্মকান্ডে কাজে লাগানো হচ্ছ। ফলত জুম্মরা বাধ্য হয়েই আবার চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু সরকারের একাংশ ও পার্বত্যাঞ্চলের সেনাবাহিনী এবং ডিজিএফআই গণতান্ত্রিক আন্দোলনও কার্যত রুদ্ধ করে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠা অত্যন্ত সঙ্গত যে, জুম্ম জনগণ তাহলে কি ধ্বংস হবে? নাকি বৃহত্তর বা উচ্চতর আন্দোলন করে চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারকে বাধ্য করবে? যদি আন্দোলন করে সে আন্দোলনের রূপ কেমন হবে? তার আগেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়, রাষ্ট্র কেন এভাবে জুম্ম জনগণকে বৃহত্তর আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে?
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বকে ধ্বংস করতে পার্বত্য চট্টগ্রামে কর্মরত সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা একের পর এক নীলনক্সা বাস্তবায়ন করে চলেছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বাংলাদেশের জনগণকে আদিবাসী জুম্মদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে তারা নানান প্রপাগান্ডা ও কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে, আর আর্থিক সুবিধা লাভ করছে। কাঠ ব্যবসা, ঠিকাদারী ব্যবসাসহ সকল উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে তাদের একচেটিয়া হাত রয়েছে এবং বখরা আদায় করছে। তাদের এহেন প্রভাব কার্যত অনপনেয়।
পার্বত্যাঞ্চলের সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টি ও তাদেরকে মদদ দিয়ে পার্বত্যাঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। এতদাঞ্চলে সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে মদদদান, সংঘাতে উস্কানী, সাম্প্রদায়িক মনোভাব ও হামলার পাশাপাশি হত্যা, অপহরণ, মিথ্যা মামলা দায়ের ও গ্রেফতার, ক্রস ফায়ারিং এর মাধ্যমে বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, হয়রানি এক কথায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল নিপীড়ন, নির্যাতন, অত্যাচার ও অপকর্মের মূল হোতা হলো তারা।
বাংলাদেশের সার্বিক উন্নতি ও ঐক্যবদ্ধ সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার জন্য দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ আবশ্যক। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল রেখে এদেশ কিভাবে সমৃদ্ধি লাভ করবে। এজন্য এটাই সত্যি যে, পার্বত্য চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নই এতদাঞ্চলের সংঘাত বন্ধের একমাত্র পথ। সরকার যদি পার্বত্যাঞ্চলে অবস্থানরত সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার মিথ্যা, মনগড়া ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রিপোর্ট নিয়ে ভুল পথে বা উল্টোপথে পার্বত্যাঞ্চলের সমস্যার সমাধানের দিকে এগিয়ে চলে তবে সংঘাত আরো ঘনীভূতই হবে বৈকি।
এজন্য সরকার ও সেনাবাহিনীই দায়ী থাকবে। আর চলমান দমন-পীড়ন, অন্যায়-অবিচার ও হয়রানি করে জুম্মদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম দমানো যাবে। এমন আশা করা শুধু বোকামী নয়, চরম আত্মঘাতী হবে।