বাচ্চু চাকমা
গত ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ দিবাগত রাত ২:৩০ ঘটিকার সময় খাগড়াছড়ি জেলার সদরের গোলাবাড়ি ইউপি অফিস সংলগ্ন বলপিয়ে আদামে ৯ জন মুসলিম বাঙালি সেটেলার কর্তৃক একজন মানসিক প্রতিবন্ধী জুম্ম নারীকে (২৬ বছর) গণধর্ষণ করা হয়েছে। কেবল ধর্ষণ নয়, সেই সাথে বাড়ি থেকে সোনার অলঙ্কার ও নগদ ৮ হাজার টাকাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করা হয়েছে। দুর্বৃত্তরা দুই ঘন্টা যাবত উক্ত মানসিক প্রতিবন্ধী নারীকে ধর্ষণ করেছে বলে খাগড়াছড়ি জেলার এসপির বক্তব্য থেকে জানা যায়। এমনকি ৯ জনের মধ্যে কেউ কেউ একাধিক বার ধর্ষণও করেছে। উল্লেখ্য যে, ২০০৫ সালে ভাইকে এবং ২০০৬ সালে বাবাকে হারানোর পর থেকেই অসহায় এই নারী মানসিকভাবে খুবই অসুস্থ ছিলেন বলে তার পরিবারের সূত্রে জানা যায়। এই নৃশংস লোমহর্ষক ঘটনায় জড়িত নরপশুদের বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে সারাদেশে প্রতিবাদ চলছে।
ঘটনার পর ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ পুলিশ খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে ৭ জনকে গ্রেফতার করেছে। তবে এখনও প্রশাসনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে দুইজন ধর্ষক। গ্রেফতারকৃতরা হলো- ১) রামগড়ের তৈচালা পাড়ার মৃত আবুল কাশেমের ছেলে মো: আমিন ওরফে নুরুল আমিন (৪০), ২) খাগড়াছড়ির কুমিল্লাটিলার মৃত আকবর আলীর ছেলে মো: বেলাল হোসেন (২৩), ৩) গুইমারার বড় পিলাকের মো: ইমরান হোসেনের ছেলে মো: ইকবাল হোসেন (২১), ৪) মাটিরাঙ্গার আমতলী ইউনিয়নের আদর্শগ্রামের মো: হাবিল মিয়ার ছেলে মো: আব্দুল হালিম (২৮), ৫) গুইমারার পশ্চিম বড়পিলাকের আব্দুল কাদেরের ছেলে মো: শাহিন মিয়া (১৯), ৬) রামগড়ের দারোগা পাড়ার আহম্মদ উল্লাহয়ের ছেলে মো: অন্তর (২০) এবং ৭) মাটিরাঙ্গার দক্ষিণ মুসলিম পাড়ার শামসুল হকের ছেলে মো: আব্দুর রশিদ (৩৭) প্রমুখ।
গ্রেফতারকৃত কাছ থেকে লুণ্ঠিত স্বর্ণালঙ্কারের বিক্রয়লব্দ ৪৮,০০০ টাকা, লুণ্ঠিত নগদ ৮,০০০ টাকার মধ্যে ৪,৯০০ টাকা, আসামী অন্তরের হেফাজত থেকে লুণ্ঠিত একটি মোবাইল সেট, দরজা ভাঙ্গার শাবল, ডাকাতি ও গণধর্ষণের সময় ব্যবহৃত ২টি ছোরা, ২টি দা, ১টি নাম্বার বিহীন সবুজ রঙের সিএনজি,গণধর্ষণ শেষে আসামীদের ফেলে যাওয়া একজোড়া প্লাষ্টিকের জুতা, যা পরবর্তীতে ধৃত রশীদ কর্তৃক তার নিজের জুতা বলে সনাক্তকৃত ইত্যাদি উদ্ধার করা হয়েছে বলে ২৭ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি জেলার এসপি মোহাম্মদ আবদুল আজিজের সংবাদ সম্মেলন থেকে জানা যায়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা অপরাধ স্বীকার করেছে বলে তিনি নিশ্চিত করেছেন। এ ঘটনায় ভিকটিমের মা পুষ্প রানী চাকমা (৫৩) খাগড়াছড়ি থানায় বসতঘরের ভিতর ডাকাতি ও গণধর্ষণের ঘটনায় পেনাল কোডের ৩৯৫/৩৯৭ ধারা এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩) এর ৯(৩)/৩০ ধারায় একটি মামলা করেন, যার নং ১৪, তারিখ- ২৪/০৯/২০২০।
দ্রুততার সাথে চট্টগ্রামের মতো দূরবর্তী স্থানসহ বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে ৯ জনের মধ্যে ৭ জনকে গ্রেফতার করায় পুলিশ বাহিনীকে ধন্যবাদ জানাই। পুলিশ সততা ও আন্তরিকতার সাথে তৎপর হলে অপরাধীদের গ্রেফতার করা যে সম্ভব এটা তার প্রমাণ। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণের পূর্বের ঘটনাবলীর আলোকে জনমনে কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে, ঘটনায় জড়িত সেটেলারদের কি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে? বাকি ধর্ষকরা কি ধরা পড়বে? গ্যাং-রেপের ঘটনাটি জাতিগত ইস্যু নয়, ৯ জনের মধ্যে বাকি দুইজনের নাম প্রকাশ না করা, ধর্ষণের চাইতে ডাকাতির বিষয়টিকে বড় করে তুলে ধরা ইত্যাদির আলোকে ন্যায় বিচার ও ধর্ষণে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে স্বভাবতই জনমনে এধরনের প্রাসঙ্গিক প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে।
‘জাতিগত বিষয় বিবেচ্য নয়’:
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ এক সংবাদ সম্মেলনে এসপি মোহাম্মদ আবদুল আজিজ বলেছিলেন, “অপরাধীর পরিচয় কিন্তু কেবলই অপরাধী; ডাকাতি যে করে তার পরিচয় শুধুই ডাকাতি; যে রেপ করে তা কেবল রেপই; কোন সম্প্রদায়ের, কোন ধর্মের, কোন বর্ণের, পাহাড়ি-বাঙালি এগুলো আমাদের কাছে মোটেও বিবেচ্য নয়। …পাহাড়ি-বাঙালির ইস্যু টেনে এনে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। আমরা অপরাধীকে অপরাধী হিসেবে দেখছি। এই অপরাধীকে কোন কোটরীগত স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি থেকে ঐ দিকে ধাবিত করে যদি বলা হয়, বাঙালি বলে ব্যবস্থা হচ্ছে না কিংবা পাহাড়ি বলে ব্যবস্থা হচ্ছে না, তাহলে এটা হবে আমাদের জন্য অত্যন্ত দু:খজনক, আমাদের পেশাদারিত্বের উপর বিরাট একটা প্রশ্ন আসতে পারে। আমরা সেই প্রশ্ন কিন্তু আসতে দিতে চাই না।”
কিন্তু এই নৃশংস গণধর্ষণের ঘটনার ক্ষেত্রে কি সত্যিই পাহাড়ি-বাঙালি ইস্যু বিবেচ্য নয়? এখানে অপরাধীকে কি স্রেফ অপরাধী হিসেবে কিংবা স্রেফ ধর্ষক হিসেবে সাধারণীকরণ করা যায়? ঘটনাটা যেখানে কর্তৃত্বশীল জনগোষ্ঠীর সেটেলার কর্তৃক শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা থেকে প্রান্তিকতায় অবস্থিত জুম্ম জনগোষ্ঠীর এক নারীকে, তাও আবার প্রতিবন্ধীকে ধর্ষণ করা হয়েছে সেখানে অপরাধের সাথে সম্প্রদায়, বর্ণ, ধর্ম ও জাতিগত বিষয় জড়িত নেই তা বলার অবকাশ আছে বলে বলা যেতে পারে না।
বিগত আশি দশক সরকারি অর্থায়নে এই সেটেলারদের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি প্রদান করা হয়েছে। চার দশক ধরে তারা সরকারি রেশন পেয়ে চলেছে। তারা সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন পর্যন্ত রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল পর্যায়ে সকল ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা ও আশির্বাদপ্রাপ্ত। নিজ ভূমিতে জুম্ম জনগণকে সংখ্যালঘু করা এবং অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার নেতিবাচক সাম্প্রদায়িক পলিসির অংশ হিসেবে তাদেরকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসতি প্রদান করা হয়েছে। ফলে জুম্ম নারী ধর্ষণ বা ধর্ষণের পর হত্যা থেকে শুরু করে সাম্প্রদায়িক হামলা, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া, ভূমি বেদখল ইত্যাদি সকল অপরাধের ক্ষেত্রে তারা বরাবরই দায়মুক্তি পেয়ে আসছে। সেজন্য তারা এধরনের অপরাধ থেকে বিরত না হয়ে বরঞ্চ দায়মুক্তিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে একের পর এক ঘটনা সংঘটিত করে চলেছে।
জাতিগত বিষয় জড়িত থাকে বলেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত অনেক ধর্ষণের ঘটনায় মেডিকেল রিপোর্ট প্রদানে গড়িমসি করা হয়। উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে ফাঁক-ফোকর রেখে এজাহার লিখে দিয়ে ভিকটিম বা ভিকটিমের অভিভাবকদের মাধ্যমে পুলিশ কর্তৃক দুর্বল মামলা দায়ের এবং দুর্বল সার্জসিট প্রদান করা হয়। ফলে ঘটনার সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করা হলেও পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃতরা সহজেই জামিন নিয়ে জেল থেকে বেরিয়ে যায়। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ধর্ষণের ঘটনায় প্রতিবাদে আহুত বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিলেও বাধা সৃষ্টি করা হয়।
সমাজের মধ্যে দুর্বল ও প্রান্তিক শ্রেণি যারা, যেমন জাতিগত, ভাষাগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসী, নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী প্রভৃতি জনগোষ্ঠী অধিকতর বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার হয়ে থাকে। তাই সেসব জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার সুরক্ষায় ইতিবাচক নীতিমালার আলোকে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হয়। তাই ৯ জন সেটেলার কর্তৃক এক প্রতিবন্ধী জুম্ম নারীকে ধর্ষণের ঘটনাকে অবশ্যই অধিকতর ভঙ্গুর/ঝুঁকিপূর্ণ জুম্ম জনগোষ্ঠী সদস্য হিসেবে, নারী হিসেবে, প্রতিবন্ধী হিসেবে বিবেচনা করে বিশেষ কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। তার ব্যত্যয় ঘটানোর অর্থ হচ্ছে ন্যায় বিচার ও জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের প্রক্রিয়াকে অনিশ্চিত করে তোলা।
ডাকাতি ও ধর্ষণ:
এসপি সাহেবের সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যে ৯ জন ধর্ষণকারীকে প্রধানত ডাকাত দল হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। ডাকাত করতে গিয়েই অভিযুক্তরা ধর্ষণও করেছে। এসপি সাহেব বলেছেন, “(অভিযুক্তরা) ডাকাতি করেছে পাশাপাশি ধর্ষণও করেছে।” স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে যে, ধর্ষণের ঘটনাকে হালকা করতেই কি এসপি সাহেব ডাকাতির বিষয়টাকে বড় করে তুলে ধরেছেন?
অভিযুক্তদের ডাকাতিই যদি প্রধান টার্গেট হতো তাহলে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে একজন জুম্ম গ্রামবাসীর বাড়ি টার্গেট করলো কেন? এটা তো সবাইয়ের জানা অধিকাংশ জুম্ম হচ্ছেন গরীব। তাদের বাড়ি ডাকাতি করে কিই বা অর্থ-সম্পদ পাওয়া যাবে? ঢাবি শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন কণা ঠিকই বলেছেন, একই এলাকার বলেই তারা (ধর্ষকরা) জানতেন মেয়েটি ভারসাম্যহীন; তাকে ধর্ষণ করা অপেক্ষাকৃত সহজ। নয়জন মিলে সেই মানসিক ভারসাম্যহীন নারীকে ধর্ষণের পর তারা বাড়িতেও লুটপাট চালায়।
এটা বলা যায় যে, দুবৃর্ত্তদের মূল মোটিভ ছিল ধর্ষণ। তারপরেই ডাকাতি। এভাবেই খাগড়াছড়ি জেলার পুলিশ সুপারের সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যে গণধর্ষণের জঘন্য ও বর্বর ঘটনাকে ডাকাতি হিসেবে হাইলাইট করে খাগড়াছড়ি সদরে মানসিক প্রতিবন্ধী জুম্ম নারীর গণধর্ষণের ঘটনাকে হালকা করে উপস্থাপন করারই একটা প্রবণতা চোখে পড়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে গেল কিভাবে?
রাত ২:২৬ ঘটিকা থেকে ঘটনার সংঘটনের পূর্বে সেটেলাররা রামগড়, জালিয়াপাড়া, মাটিরাঙ্গা হয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। রাত গভীর হওয়ার জন্য ঘটনাস্থলে কয়েকঘন্টা ঘুরেফিরেও থাকে। এসপি সাহেব বলেছেন, “রাত গভীর হওয়ার জন্য তারা খাগড়াছড়ি বাসস্ট্যান্ডে চলে আসে। সেখানে তারা পান সিগারেট খায় এবং প্রায় ৩০ মিনিটের মত সময় অবস্থান করে। …আসামীরা রাস্তার একটা মন্দিরের পাশে একটা বাড়িতেও গিয়েছিল।” দুইঘন্টা ধরে ঘটনা ঘটানোর পর ভোর রাত ৪:৩০ মিনিটে সিএনজি ও মোটর সাইকেল যোগে আবার ফিরেও গিয়েছিল।
যে জায়গায় ঘটনাটি ঘটেছে, তার ৩০০ থেকে ৪০০ গজের মধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দুইটি চেকপোস্ট রয়েছে। এছাড়া সরকারি ভাষ্য মতে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি সন্ত্রাসী প্রবণ এলাকা’ হিসেবে খাগড়াছড়ি জেলার প্রতিটি সড়ক বরাবর আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর অসংখ্য চেকপোষ্ট রয়েছে। ধর্ষণকারীরা গভীর রাতে সুদূর রামগড়, জালিয়ে পাড়া, মাটিরাঙ্গা থেকে এসেছে, রাত গভীর করতে ঘটনাস্থলের আশেপাশে দীর্ঘসময় পর্যন্ত অবস্থান করেছিল, ঘটনা সংঘটিত করার পর আবার চলেও গিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, দুর্বৃত্তদের এতসব কর্মকান্ড সত্ত্বেও আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর চোখে পড়লো না কেন? আজকে ৯ জন দুবৃর্ত্ত যদি সেটেলার না হয়ে জুম্ম হতো, তাহলে কি তারা এভাবে গভীর রাতে এতদূর রাস্তা নির্বিঘ্নে আসা-যাওয়া ও ঘুরাফিরা করতে পারতো? তারা কখনোই পারতো না। এখানে কি সাম্প্রদায়িকতার গভীর ষড়যন্ত্রের বিষবাষ্প নেই বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়?
দুইজনের হদিশ নেই কেন?
খাগড়াছড়ি গণধর্ষণের সাথে জড়িত ৯ জনের মধ্যে ৭ জনকে গ্রেফতার করা হলেও বাকি ২ জনকে এখনো প্রশাসন গ্রেফতার করতে পারেনি। এমনকি তাদের নামও পুলিশ বা প্রশাসন প্রকাশ করেনি। গ্রেফতারকৃত ৭ জনের কাছ থেকে নিশ্চয় বাকি দুইজনের নাম জানা গেছে অনায়াসে। কিন্তু কেন পুলিশ বা প্রশাসন তাদের নাম জনসমক্ষে নিয়ে আসছে না? এ নিয়ে মানুষের মনে নানা সন্দেহ দেখা দিয়েছে। পুলিশ বা প্রশাসন কি বাকি দুইজনকে নিয়ে লুকোচুরি খেলা খেলছে? তাদের দুইজনের নাম প্রকাশ না করার পেছনে জড়িত সেই দুইজনকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে কিনা তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
ঘটনায় জড়িত দুইজন ধর্ষক ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ব্যক্তি, আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনী এবং রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর সদস্য নয় তো? এটাকে অনেকের কাছে রহস্যজনক মনে হচ্ছে। দায়িত্বশীল প্রশাসনের মধ্যে যদি “শস্যের ভেতর ভূত” থাকলে সেটি তাড়ানো অনেক কঠিন! রক্ষক যখন ভক্ষকের ভূমিকায় হাজির হয় তখন বাংলাদেশের বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দোষারোপ করতেই হয়।
সেতুমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ঢাবি শিক্ষক সমিতির একচোখা বিবৃতি:
আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনায় সরকারের অবস্থান কঠোর। অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না” (সমকাল, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০)। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, “এমসি কলেজের ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি পেতেই হবে” (ক্যাম্পাসটাইমস.কম, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০)। কিন্তু এমসি কলেজের ঘটনার চেয়ে অধিকতর লোমহর্ষক একজন মানসিক প্রতিবন্ধী জুম্ম নারীকে ৯ জন শক্তসামর্থ সেটেলার পুরুষ কর্তৃক নৃশংস গণধর্ষণের ঘটনা তারা উল্লেখ করলেন না কিংবা উক্ত ঘটনায় জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা ও শাস্তি প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করলেন না।
আরও উল্লেখ্য যে, গত ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক মোঃ লুৎফর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. নিজামুল হক ভূইয়া “নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতনের প্রতিবাদ” শিরোনামে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সিলেটের এমসি কলেজের গণধর্ষণ, চট্টগ্রামে এক তরুনীকে ধর্ষণ, সাভারে প্রেমের নামে প্রতারনা করে তরুণীকে ধর্ষণ, একইভাবে প্রতারণা করে ঢাবিতে একছাত্রীকে ধর্ষণ, সাভারে প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় উঠিয়ে নিয়ে একজন তরুণীকে হত্যা ইত্যাদি সাম্প্রতিক নারীর উপর সহিংসতার একের পর এক ঘটনার প্রতিবাদ করলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে, খাগড়াছড়ি এক মানসিক প্রতিবন্ধী জুম্ম নারীকে ৯ জন সেটেলার কর্তৃক সবচেয়ে নৃশংস গণধর্ষণের ঘটনা তারা বেমালুম এড়িয়ে গেলেন।
প্রশ্ন হলো, দুই প্রভাবশালী মন্ত্রী ও ঢাবি শিক্ষক সমিতি কেন খাগড়াছড়ির গ্যাং-রেপের ঘটনা এড়িয়ে গেলেন? অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত পরিণত করার অংশ হিসেবে সরকারি উদ্যোগে বহিরাগত মুসলিম বাঙালিদের বসতি প্রদান এবং সেই পোষ্য সন্তান সেটেলার কর্তৃক গণধর্ষণ করা হয়েছে বলে কি তারা এড়িয়ে গেলেন? নাকি জাতিগত নির্মূলীকরণের হাতিয়ার হিসেবে ধর্ষণকে ব্যবহার করা হয় বিধায় অপরাধীদের দায়মুক্তি দেয়ার জন্য কিংবা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিষয়টি দেশের প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর বিষয় বিধায় উক্ত মন্ত্রী-বুদ্ধিজীবীরা সযত্নে নীরবতা পালন করে গেলেন?
সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ ঢাবি শিক্ষক সমিতির মতো দেশের নীতি-নির্ধারক ও বুদ্ধিজীবীদের এধরনের দৃষ্টিভঙ্গিকে নি:সন্দেহে চরম বর্ণবাদী হিসেবে বলা যেতে পারে এবং এধরণের দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই বাংলাদেশে যেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বেড়েই চলেছে তেমনিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের ধর্ষণকারী সেটেলারদের দায়মুক্তি দিয়ে প্রকারান্তরে ধর্ষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে নির্দ্বিধায় বলা যায়।
পাহাড়ের যেকোন ঘটনাকে বুঝতে হলে পাহাড়ের ঐতিহাসিক পরিস্থিতি ও বাস্তবতার আলোকেই বুঝতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এসব জঘন্য, বর্বর ঘটনার পেছনে পাহাড়ের নারী ধর্ষণ, ভূমি বেদখল, সাম্প্রদায়িক হামলা, সেনাবাহিনীর নির্দয় নিপীড়ন ইত্যাদি ঘটনাগুলো জুম্মদেরকে জাতিগতভাবে নির্মূলীকরণের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শাসকগোষ্ঠী পরিচালিত করে থাকে। যার কারণে পাহাড়ের জুম্ম নারী ধর্ষণের ঘটনার সাথে জড়িত ধর্ষক সেটেলাররা নিজেরাই প্রকাশ্যে অপরাধ স্বীকার করলেও তাদের সাজা হয় না। জামিনের মাধ্যমে এসব জঘন্য অপরাধীদের জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়!
পাহাড়ের আপোষহীন জুম্ম নারী নেত্রী কল্পনা চাকমার অপহরণের যথাযথ বিচার আজও হয়নি, লংগদুর সুজাতা চাকমা, খাগড়াছড়ির পণেমালা ত্রিপুরা, রাঙ্গামাটি সদরের বলিমিলা চাকমা এবং কাউখালীর তুমাচিং মারমাসহ অসংখ্য ধর্ষণের জঘন্য ঘটনায় জড়িত কাউকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হয়নি। ২০১১ সালে লংগদুতে কিশোরী সুজাতাকে ধর্ষণের পর হত্যাকারী সেটেলার ইব্রাহিম গ্রেফতার হয়েছিল এবং নিজেই অপরাধ স্বীকার করেছিল, কিন্তু তার সাজা হয়নি। এধরনের অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়।