নিপন ত্রিপুরা
দেশে এখন সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, সন্ত্রাস, দুর্নীতি-লুটপাট ও দুর্বৃত্তায়নের হীন তৎপরতা চরম আকার ধারণ করেছে। স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরের কাছাকাছি এলেও দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক মুক্তি আসেনি। দেশের মাঝি-মাল্লা-কৃষক-শ্রমিক-রিক্সা চালক-নিষিদ্ধ পল্লীর মা-বোনদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন আসেনি। এখনো পূর্বের মতো সমাজে শোষণ-নিপীড়ন প্রকট আকারে বিদ্যমান রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে তা আরও বেড়ে চলেছে। শাসকগোষ্ঠী আগের মত এখনো জুম্ম জনগণসহ দেশের অবহেলিত-উপেক্ষিত আদিবাসী জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, ভূমি ও আত্মপরিচয়ের অধিকার অস্বীকার করে চলেছে। তাদেরকে ভিটেমাটি থেকে চিরতরে উচ্ছেদ করা হচ্ছে এবং আদিবাসী জনগণের অস্তিত্ব নির্মূলীকরণের ষড়যন্ত্র জোরদারভাবে চলছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে সমাধানের লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কালক্ষেপণের ফলে পাহাড়ের বুকে দেখা দিয়েছে অনাগত দিনের অনিশ্চিত পরিস্থিতি। বলা যায় দেশে আদিবাসী, সংখ্যালঘু, শ্রমজীবী মানুষ আজ তার অধিকার থেকে বঞ্চিত ও নিষ্পেষিত। দেশ এক কঠিন সংকটের মধ্যে যাচ্ছে।
যখনই এ সংকটগুলোর কথা উঠে আসে তখনই এম এন লারমার কথা উঠে আসে। গণপরিষদে দেয়া বাংলাদেশ নামক দেশটি কিভাবে পরিচালিত হবে তার রূপরেখা প্রণয়নে ঐতিহাসিক সংসদীয় বিতর্কের কথা মনে পড়ে যায়।
একটি স্বাধীন রাষ্ট্র কিভাবে পরিচালিত হবে? একটি মুক্তিযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট রাষ্ট্র কিভাবে গড়ে তুলতে হয় সে পথ এম এন লারমা দেখিয়েছিলেন। তাঁর তৎকালীন সংসদীয় বক্তব্যগুলো দেখলে বোঝা যাবে না তিনি স্বতন্ত্র জোট থেকে নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধি। তাঁর সে বক্তব্য আমলে নিলে আজ বাংলাদেশের এমন দশা হতো না। সংবিধান প্রণয়নকালে সংবিধানের নানা দুর্বলতা ও অসংগতির চিত্র কেউ বুঝতে অক্ষম হলেও তিনি বুঝতে পেরে এর দুর্বলতা ও অসংগতির কথা সংবিধান প্রনয়ণকালে গণপরিষদ ও প্রণয়ন পরবর্তী জাতীয় সংসদে তুলে ধরেছেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী তার সংশোধনীয় প্রস্তাবকে সবসময় তুচ্ছতাচ্ছিল্যের সাথে পাশ কাটিয়ে গিয়েছে। বলা হয়, তিনি বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে যে অবদান রেখেছিলেন, আওয়ামীলীগ সরকারকে যেভাবে হাপিত্যেশ করে ছেড়েছিলেন দীর্ঘ ৫০ বছরে এমন কাজ আর কেউই করতে পারেননি। প্রকৃত অর্থে সংসদের একজন বিরোধী পক্ষ হিসেবে সংসদে সবসময় সরকার দলের ভালো কাজে প্রশংসার পাশাপাশি নেতিবাচক কাজের তুখোড় সমালোচনা করেছিলেন।
মহান এ নেতা পার্বত্য চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি কখনো জাতিগত সংকীর্ণ পরিসরে আবদ্ধ থাকেননি। তিনি জুম্ম জনগণের ন্যায্য অধিকারের কথা, তাদের জাতীয় অস্তিত্বের কথা যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি দরদী কণ্ঠে জাতিগত সংখ্যালঘু, নিপীড়িত ও নির্যাতিত, অধিকার বঞ্চিত গরীর ও শ্রমজীবী মানুষের কথা সংসদের ভেতরে ও বাইরে বারবার তুলে ধরেছেন। সংবিধানে তাদের সে অধিকারের কথা সন্নিবেশিত করার জন্য সংসদে জোড়ালো আওয়াজ তুলেছিলেন। তাঁর সে স্বপ্ন যে স্বপ্নগুলো শাসকগোষ্ঠী মানলে আজ সোনার বাংলা গড়তে বেগ পেতে হতো না।
সংবিধান প্রণয়নকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের তথা সমগ্র বাংলাদেশের আদিবাসীদের আত্মপরিচয় ছিল না। তার জন্য সাংবিধানিক স্বীকৃতি চেয়ে সংগ্রাম করেছেন সংসদের ভিতরে। পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জন্য পৃথক শাসন কাঠামো এবং জুম্ম জনগণের স্বতন্ত্র জাতীয় সত্তা ও বৈশিষ্ট্যের প্রেক্ষাপটে সংবিধানে সংবিধি ব্যবস্থা প্রণয়নের জন্য তিনি সংবিধান প্রণয়ন কমিটির নিকট আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য দাবিনামা তুলে ধরেছিলেন। শুধু সেখানে নয় কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের অধিকারের কথা সংবিধানে নাই বলে তাদের অধিকারের কথা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদানেরও জোর দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু সে দাবিনামাও শাসকগোষ্ঠী আমলে নেয়নি। যার ফল ২২ বছর যাবত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র সংগ্রাম। তিনি জোরালো দাবি তুলেছিলেন নারীর অধিকার পুরুষের মতন সমানভাবে দেয়ার জন্য। যেহেতু নারী সমাজের অর্ধেক অংশ। তার পাশাপাশি আজকে যাদেরকে পতিতা বলে সমাজের মানুষ ঘৃণার চোখে দেখে তাদের কথাও সংবিধানে সন্নেবেশিত করার দাবি জানিয়েছিলেন।
এম এন লারমাকে যে শাসকগোষ্ঠী ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’, ‘দুষ্কৃতিকারী’ ইত্যাদি আখ্যা দিয়েছে, সেই এম এন লারমাই সংসদে দাঁড়িয়ে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য প্রত্যকে বাহিনীকে ৪৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার জন্য জোর দাবিসহ আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত করারও দাবি জানিয়েছিলেন। অথচ এ দেশের শাসকগোষ্ঠী তা বেমালুম ভুলে গিয়ে সন্ত্রাসী তকমা লাগানোর ক্ষেত্রে বেশ আগুয়ান। ধন্যবাদ জানাই রাঙ্গামাটি আসনের সাবেক সাংসদ শ্রী ঊষাতন তালুকদার এমপিকে যাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে জাতীয় সংসদে দীর্ঘ ৩৩ বছর পর ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে এম এন লারমার স্মরণে শোকপ্রস্তাব পাঠ ও পাশ হয়েছিল।
বাংলাদেশের মানুষ কথায় কথায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলে যান। কিন্তু এম এন লারমা কথায় নয় কাজেই তিনি প্রমাণে পটু ছিলেন। সে সময় জাতীয় সংসদ অধিবেশনের শুরুতেই কেবল পবিত্র কোরান ও পবিত্র গীতা পাঠের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু এম এন লারমাই প্রথম তার পাশাপাশি পবিত্র ত্রিপিটক ও পবিত্র বাইবেল পাঠ চালু করার দাবি জানিয়েছিলেন। আজ সে মহান সংসদে সব ধর্মের পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ হচ্ছে।
মত প্রকাশের স্বাধীনতা আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রক্ষাকবচ। তৎকালীন সময়ে সংবিধান প্রণয়নের সময় জনগণের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে নানা শর্ত দিয়ে সংকুচিত করে রাখা হয়েছিল। তার জন্য এম এন লারমা অত্যন্ত জোরের সাথে বলেছিলেন চিন্তা ও বিবেকের এবং বাক স্বাধীনতা মৌলিক অধিকারের রক্ষাকবচ। কিন্তু এ অধিকারকে আবার কতগুলো শর্ত দ্বারা খর্ব করা হয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃংখলার নামে, নৈতিকতার নামে যদি আমার বাক স্বাধীনতা আটকে দেয়া হয় তাহলে আমার মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার কী অর্থ আছে? তিনি এ অনুচ্ছেদটি সংশোধন করে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে উন্মুক্ত করে দেয়ার জন্য জোর দাবিও তুলেছিলেন। তাঁর এ বক্তব্যের বাস্তবতার নমুনা আজ আমরা দেখি, যখন তথাকথিত গুজব ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নাম করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ জারি করে ফ্যাসীবাদী এই সরকার মানুষের বাক স্বাধীনতাকে ঝাপটে ধরেছে। যাতে কেউই তার কর্মকান্ডে সমালোচনা করতে না পারে ।
যুদ্ধাপরাধী বিচারের দাবিতে এম এন লারমা সবসময় সোচ্চার ছিলেন। তিনি এ যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারের দাবি জানিয়েছিলেন। তিনি এটাও আশংকা করে বলেছিলেন, এ যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচার করতে না পারলে দেশে গৃহযুদ্ধ আসন্ন। আমরা তার বাস্তবতা দেখি এসব যুদ্ধাপরাধীরা পরবর্তীতে স্বাধীন দেশের পতাকা লাগিয়ে সংসদে বক্তব্য রাখতে।
কৃষি প্রধান দেশ বাংলাদেশ। অথচ এ দেশে কৃষকেরই কোন মূল্য নেই ও ন্যায্য মুজুরি থেকে সবসময় বঞ্চিত। তিনি বলেছিলেন, আমরা হরহামেশায় শুনি কোথাও কোথাও কৃষকের আত্মহত্যা। এম এন লারমা রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে কৃষককে উৎপাদন ও শ্রম সম্পর্কের সাথে পরিচয়কে যুক্ত করে চেয়েছিলেন। তিনি তাই বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটে মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কৃষকের অন্তর্ভুক্তির জন্য জোর দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু নিদারুণভাবে দেখতে পাই, নাছোড়বান্দা শাসকগোষ্ঠী কৃষকের আত্মপরিচয়কে পদদলিত করে গড়ে তুলেছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট এর মতো প্রতিষ্ঠান।
শিক্ষার অধিকার দেশের জনগণের একটি মৌলিক অধিকার। কিন্তু এ মৌলিক অধিকার নিয়ে এখন সবার প্রশ্ন বাড়ছে। রাষ্ট্র তার জনগণের সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য দায়বদ্ধ হলেও প্রকৃত অর্থে জনগণকে এ অধিকারটুকু পাওয়ার জন্য বেগ পেতে হচ্ছে। টাকা দিয়ে শিক্ষাকে কিনে নিতে হচ্ছে। জনগণের মৌলিক অধিকার শিক্ষা সম্পর্কে বলতে গিয়ে এম এন লারমা বলেছিলেন, শিক্ষা একটা জাতিকে উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে কার্যকরি ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা জনগণের মৌলিক অধিকার। দেশে চলমান দুই ধারা আমাদের সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষার মধ্যে বৈষম্য কমাতে হবে। তিনি শিক্ষা খাতে বাজেট বেশী ও শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য জোর দিতে বলেছিলেন। যদি শিক্ষা ব্যবস্থা পরিকল্পনা মত বিন্যাস করা না যায় তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যহত হবে বলে আশংকা জানিয়েছিলেন। আজ তাঁর এ আশংকা সত্যি পরিণত হয়েছে। দেশে একমুখী বিজ্ঞান সম্মত শিক্ষা ব্যবস্থার বদলে এখন চার ধারা শিক্ষা ব্যবস্থা চলমান। শিক্ষা ও গবেষণা খাতে নেই কোন পরিকল্পিত বাজেট। বলা যায়, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আজ এক ভঙ্গুর অবস্থায় পড়ে আছে।
তাছাড়াও এম এন লারমা স্বাধীন দেশে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণের সময় জনণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ পরিকল্পনায় কৃষি, প্রতিরক্ষা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনকল্যাণমূলক বিষয় গুলো আছে কিনা প্রশ্ন তুলেছিলেন। থাকলে কতটুকু আছে সেগুলো পুনঃবিবেচনা করার জন্য জোর দিয়েছিলেন।
গণপরিষদের অধিবেশনে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর আব্দুর রাজ্জাক যখন ‘বাংলাদেশের জনগণ সকলে বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবে’ মর্মে দাবি উত্থাপন করেছিলেন, তখনি তিনি বজ্রকন্ঠে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন ‘আমি বাঙালি নই, আমার বাপ দাদা চৌদ্ধ পুরুষ কেউ বলে নাই আমি বাঙালি। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। সংবিধানে যদি এ বিল পাশ হয়ে যায় তাহলে বাংলাদেশের সংখ্যায় কম সকল জাতিসত্তাগুলো লোপ পেয়ে যাবে।’ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গণপরিষদের রুমে কেবল সেই ধ্বনির প্রতিধ্বনি হয়েছিল বটে, কিন্তু ক্ষমতাসীন শাসকগোষ্ঠী তাঁর সে আবেদন কর্ণপাত করেননি। তুচ্ছতাছিল্যের সাথে তাঁর এ দাবিটিও প্রত্যাখান করা হয়েছিল। আজ তাঁর বক্তব্য থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, আদিবাসীদেরকে চিরায়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ, ভূমি বেদখল, হত্যা, সাম্প্রদায়িক হামলা, নারী ধর্ষণ, দেশ থেকে বিতাড়ণ, পপুলেশন ট্রান্সফার করে জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে ও সামরিকীকৃত অঞ্চলে পরিণত করাসহ অসংখ্য পাঁয়তারার মাধ্যমে। এখন জুম্মদের জাতিগত অস্তিত্ব বিলুপ্তির লক্ষে শাসকগোষ্ঠীর নয়া নয়া ষড়যন্ত্র দেখতে পাই। যদি সে সময় জুম্মদের অধিকার তথা আত্মপরিচয় সংবিধানে লেখা থাকতে তাহলে জুম্মদের উপর এমন বেহাল দশা নেমে আসতো না।
মহান নেতা এম এন লারমার দাবি বার বার প্রত্যাখাত হওয়ার পরও শাসকগোষ্ঠীর প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা কমেনি। তিনি বারে বারে শাসকগোষ্ঠীর কাছে ছুটে গিয়েছিলেন, বোঝাবার চেষ্টা করেছিলেন। জুম্ম জনগণের দাবির প্রতি শাসকগোষ্ঠীর অনীহাকে জুম্ম জনগণের ভালোবাসায় ভরে নিয়ে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর গঠিত বাকশালেও যোগদান করেছিলেন। তিনি শাসকগোষ্ঠীকে বোঝাতে চেয়েছিলেন পাহাড়ের জুম্মরা সত্যিকার অর্থে এ দেশকে ভালোবাসে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের মধ্যে দিয়ে তার সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের সময়টুকু তিনি পাননি।
বলা যায়, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে নিয়ে এম এন লারমার অনেক স্বপ্ন ও গভীর ভাবনা ছিল। তাঁর চিন্তা-চেতনায় একদিকে যেমনি নিখাদ জুম্ম জাতীয়তাবাদ, তেমনি অন্যদিকে বাংলাদেশসহ নিপীড়িত ও শোষিত জাতি ও সর্বহারা মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধের স্বপ্নের কথাও প্রকাশ পাওয়া যায়। তাঁর সে স্বপ্নের কথা সংবিধান রচনার সময় বারে বারে উচ্চারণ করেছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ও আশা ছিল সংবিধান জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে দেশের আপামর জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করবে এবং সকল প্রকারের জাতিগত-শ্রেণিগত নিপীড়ন, শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটাবে। তাই তো তিনি ১৯৭২ সালে ৪ নভেম্বর গণপরিষদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “আমাদের দেশে সমাজতন্ত্র হবে, দেশে অভাব থাকবে না, হাহাকার থাকবে না, মানুষে-মানুষে কোন ভেদাভেদ থাকবে না, হিংসা, দ্বেষ, বিদ্বেষ থাকবে না, শুধু থাকবে মানুষে মানুষে প্রেম, প্রীতি, মায়া-মমতা এবং তার দ্বারা এক নতুন সমাজ গড়ে উঠবে। মানবতার এই ইতিহাস থাকবে এবং তাতে লেখা থাকবে ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই’। আমি আজ কামনা করি, তাই হোক।”
তাঁর সমগ্র রাজনৈতিক জীবন ও সংগ্রামের মাধ্যমে এটাই প্রমাণ করে গেছেন যে, তিনি শুধু জুম্ম জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের তথা বিশ্বের বুকে নির্যাতিত, নিপীড়িত, অধিকারহারা মেহনতি মানুষের একনিষ্ঠ বন্ধু ও তাদের একজন যোদ্ধা।
আজ দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে, শাসকগোষ্ঠী যতই এম এন লারমাকে উগ্র জাতীয়তাবাদী, বিচ্ছিন্ননতাবাদী ও সন্ত্রাসবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করুক না কেন সেসব ছিল নামেমাত্র শাসকগোষ্ঠীর অপবাদ ও অপপ্রচার মাত্র। তারই প্রমাণ পাওয়া যায়, বাংলাদেশে সংসদীয় অবস্থার অধপতন ও নানামুখী সংকটে জর্জরিত অবস্থা দেখে। যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশে সংকট বিদ্যমান থাকবে ততদিন এ সংকটগুলো কাটিয়ে উঠার জন্য এম এন লারমাকে স্মরণ করতে হবে। তার জন্য এম এন লারমার চিন্তা আজো প্রয়োজন। তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন জরুরি।
নিপন ত্রিপুরা: পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ।