হিল ভয়েস, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০, পার্বত্য চট্টগ্রাম: আগস্ট ২০২০ মাসে সেনাবাহিনী কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে ছাত্র ও বয়স্ক ব্যক্তিসহ অন্তত ৩০ জন জুম্মকে আটক, এবং তাদের মধ্যে ৮ জনকে বিভিন্ন মামলায় জড়িত করে জেলে প্রেরণ এবং বাকি ২২ জনকে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে হয়রানি ও নির্যাতনের পর মুক্তি দেয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে আজ ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির আগস্ট মাসের মাসিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
“আগস্ট ২০২০: পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর মাসিক প্রতিবেদন” শীর্ষক জনসংহতি সমিতির মাসিক প্রতিবেদনে বলা হয় যে, বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব এখনও কোভিড-১৯ করোনা ভাইরাসের মহামারীমুক্ত হয়নি। করোনা ভাইরাসের নিরাময়ে বিভিন্ন দেশ কর্তৃক ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের কথা জানা গেলেও এখনও পর্যন্ত জনগণের স্তরে সেসব ভ্যাকসিন বা কোনো ঔষধ প্রচলন বা ব্যবহার শুরু হয়নি। ফলে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি ও আতঙ্ক এখনও দূরীভূত হয়নি কিংবা অতি সহসা এর থেকে মুক্তির সম্ভাবনাও ক্ষীণ। কিন্তু তবুও মানুষকে উপার্জনের তাগিদে, জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে কর্মস্থলে, বিভিন্ন উৎপাদনকর্মে ও হাটেবাজারে যেতে হচ্ছে। বিশেষ করে পার্বত্যাঞ্চলের প্রান্তিক জুম্মদের যেন ঘরে বসে থাকার কোন সুযোগ নেই। অপরদিকে দিন দিন পার্বত্য চট্টগ্রামের কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সরকার ও রাষ্ট্রের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও জুম্ম বিরোধী নানা কার্যক্রম এবং বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে আদিবাসী জুম্মরা না থাকতে পারছে বাড়িতে, না থাকতে পারছে বাইরে। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে এবং জুম্মদের সাধারণ জীবনধারায় প্রতিনিয়ত সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হস্তক্ষেপে জুম্মদের স্বাভাবিক জীবন যেন শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা রাজনৈতিকভাবে ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের লক্ষে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও সরকার এখন চুক্তির বাস্তবায়ন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রেখেছে এবং উল্টো চুক্তির বিপরীত ভূমিকা পালন করে চলেছে। বিগত ২৩ বছরেও চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো বাস্তবায়ন না করে, যেটুকু বাস্তবায়ন করেছে সেটুকুও চুক্তির মূলনীতির বিরুদ্ধে এবং জুম্মদের স্বার্থ পরিপন্থী কাজে ব্যবহার করে চলেছে। সরকার চুক্তির ফলে প্রবর্তিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চ সংস্থা পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদকে সম্পূর্ণভাবে অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে চলেছে এবং চুক্তি স্বাক্ষরকারী দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে ফ্যাসীবাদী কায়দায় ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে। বস্তুত সরকার পার্বত্য সমস্যাটি রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের পরিবর্তে সেনাবাহিনীসহ রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে বলপ্রয়োগ করে এবং সামরিক উপায়ে দমন-পীড়ন ও নির্যাতন চালিয়ে তথাকথিত সমাধানের পথ বেছে নিয়েছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্মদের কাছে কোভিড-১৯ মহামারীর চেয়ে অনেক গুণ ভয়াবহ ও হিংসাত্মক হয়ে দেখা দিয়েছে সরকার ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর চুক্তিবিরোধী ষড়যন্ত্র, জুম্মদের মানবাধিকার হরণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করার হীন তৎপরতা।
পূর্বের তুলনায় আগস্ট ২০২০ মাসে সেনাবাহিনীর তৎপরতা, নির্যাতন, নিপীড়ন অধিকতর পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বস্তুত পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাশাসনের মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সাথে সাথে সমানতালে বিভিন্ন গণমাধ্যমের উপর এবং মানুষের বাক স্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশের উপর সেনা ও বিভিন্ন গোয়েন্দা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ, কর্তৃত্ব ও খবরদারি উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘটিত সেনাশাসনের নির্মমতা ও দমন-পীড়নের খবর কোন গণমাধ্যমে উঠে আসে না বললেই চলে।
আগস্ট ২০২০ মাসে সেনাবাহিনী কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে ছাত্র ও বয়স্ক ব্যক্তিসহ অন্তত ৩০ জন জুম্মকে আটক, এবং তাদের মধ্যে ৮ জনকে বিভিন্ন মামলায় জড়িত করে জেলে প্রেরণ এবং বাকি ২২ জনকে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে হয়রানি ও নির্যাতনের পর মুক্তি দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলাকালে বৌদ্ধ বিহার ঘেরাও করা, ৯ জনকে নানাভাবে হয়রানি, মারধর ও হুমকি প্রদান, ১৬টি বাড়ি তল্লাসীসহ গ্রামে গ্রামে সেনা অভিযান, সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক সন্ত্রাসীদের মদদদানসহ ব্যাপকভাবে সেনা তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি চুক্তির পূর্বের ন্যায় স্থানে স্থানে বিদ্যমান চেকপোস্টে তল্লাশির নামে সাধারণ জুম্মদের উপর হয়রানি বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আরও নতুন নতুন চেকপোস্ট বসানো হচ্ছে।
শুধু তাই নয়, আগস্ট ২০২০ মাসে বাঘাইছড়িতে সেনাবাহিনী ও বিজিবি কর্তৃপক্ষ বাঙালিদের চেয়ে জুম্মদের বেশি ত্রাণ দেয়া হচ্ছে-এমন সাম্প্রদায়িক ধুয়ো তুলে বাঘাইছড়িতে দরিদ্রদের মাঝে ইউএনডিপি’র করোনাকালীন চাল বিতরণ কর্মসূচি বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়া সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঘাইছড়ির সাজেকে জুম্ম গ্রামবাসীর ১টি দোকান বন্ধ করে দেয়াসহ বিজিবি কর্তৃক খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলায় অস্থায়ী বাজারের ২০টি দোকান ভেঙে দেয়া ও লোগাঙে অস্থায়ী বাজারে পণ্য কেনাবেচায় বাধা সৃষ্টি করার ঘটনা ঘটেছে।
অপরদিকে সেনা-সমর্থিত সংস্কারপন্থী ও গণতান্ত্রিক-ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের হামলায় ও অন্তর্কলহে ২ জন খুন, ১ জন আহত এবং ২ জনকে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়, ২ জনকে হুমকি-হয়রানি ও ১টি মোটর সাইকেল ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। পূর্বের ন্যায় প্রতিমাসে জনগণের কাছ থেকে নির্দিষ্ট অংকের চাঁদা আদায়সহ যে কোন সময় কাউকে কোন না কোন অজুহাতে বড় অংকের জরিমানা গুণতে হচ্ছে। সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই এই সংস্কারপন্থী ও গণতান্ত্রিক-ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের কেবল আশ্রয়-প্রশ্রয় ও মদদ দিচ্ছে তা নয়, বিভিন্ন সময় সেনাবাহিনী তাদের পরিচালিত জুম্ম গ্রামে ও বাড়িতে তল্লাশি অভিযানে এই সন্ত্রাসী দলকে প্রকাশ্যে ব্যবহার করছে।
আগস্ট ২০২০ মাসের শেষ দিকে বান্দরবানের লামায় বহিরাগত ৬ বাঙালি সেটেলার কর্তৃক এক বিধবা ত্রিপুরা নারী (২৫) এবং খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়িতে ৪ সেটেলার যুবক কর্তৃক অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী এক মারমা কিশোরীকে (১৪) জোরপুর্বক তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করার অভিযোগ পাওয়া যায়।
পার্বত্য চুক্তির ২৩ বছরেও ভূমি কমিশন আইন কার্যকর না হওয়া এবং ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়ায় বহিরাগত মুসলিম সেটেলারদের কর্তৃক নতুন করে জুম্মদের ভূমি বেদখলের অপচেষ্টা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া সাম্প্রতিককালে তিন পার্বত্য জেলায় সরকারী-বেসরকারী বহিরাগত বিভিন্ন কোম্পানি ও ব্যক্তি কর্তৃক ভূমি বেদখলসহ নির্বিচারে পাহাড় কর্তন, জঙ্গল নিধন, প্রাকৃতিক বালু ও পাথর উত্তোলন ইত্যাদি পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকান্ড জোরদার হয়েছে। আগস্ট ২০২০ মাসে রাঙ্গামাটির বরকলের ভূষণছড়ায় বাঙালি সেটেলার কর্তৃক জোরপূর্বক এক জুম্ম গ্রামবাসীর ভূমি বেদখল করে বাড়ি নির্মাণ এবং লংগদুর বগাচতর এলাকায় জুম্মদের রেকর্ডভুক্ত ভূমি বেদখলের চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অপরদিকে বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ ও মেরিডিয়ান কোম্পানিসহ বিভিন্ন রাবার কোম্পানি কর্তৃক ম্রোদের জমি বেদখলের উদ্দেশ্যে ৩টি ম্রো পাড়ার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি, লামা উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নে ডলুছড়ির দুর্গম কালু ম্রো পাড়ার ‘পাড়াবন’-এর জায়গা দখল ও সেখান থেকে গাছ বাঁশ কেটে নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়া বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী ইউনিয়নে বিমুং মার্মা (৫০) নামের এক জুম্ম খুন হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, বহিরাগত ভূমিদস্যুরাই এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে।