বাচ্চু চাকমা
আজ ১৭ সেপ্টেম্বর মহান শিক্ষা দিবস। তৎকালীন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শে প্রণীত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজের শক্তিশালী প্রতিরোধ সংগ্রাম করেছিল। সকল ছাত্র সংগঠনগুলো এ সাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে রাজপথে নেমেছিল। আন্দোলনের অংশ হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ‘১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতাল’ আহ্বান করা হয়েছিল। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে দেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। সেদিন পুলিশের গুলিতে নিহত হন ৩ জন। তাই ১৭ সেপ্টেম্বর মহান শিক্ষা দিবস সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্র সমাজের রক্তদানের পর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষানীতি কি আজও গণমুখী ও বাস্তবমুখী হতে পেরেছে?
আজকের যে শিক্ষানীতি প্রতিষ্ঠার পেছনে বাংলাদেশের মানুষের শুধু উদ্যেগ নয়-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই শিক্ষানীতি গড়ে তোলা হয়েছে। আজও শিক্ষাঙ্গণের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ যথাযথভাবে গড়ে উঠেনি। শিক্ষাঙ্গণে সন্ত্রাস, হল দখল, ক্যাম্পাস দখল, দুর্নীতি ও অনিয়ম চলছে। শিক্ষাঙ্গণকে ঘিরে শিক্ষার অনুকুল পরিবেশ ছাত্র সমাজকে তাদের মেধা ও প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে আরও অধিকতর অনুপ্রাণিত করতে পারে। আমাদের দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে, নিঃসন্দেহে সেই ব্যবস্থাপনা, সেই শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের উৎসাহিত করতে পারেনা। আমাদের দেশে শিক্ষাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে- সাধারণ শিক্ষা, কারিগরী শিক্ষা এবং ধর্মীয় শিক্ষা। বস্তুত আমাদের বাংলাদেশের গোটা ছাত্র সমাজকে যেই শিক্ষায় শিক্ষিত করার দরকার সেই শিক্ষা আমাদের দেশে এখনো গড়ে উঠতে পারেনি।
আমাদের সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে গণমুখী, বিজ্ঞানভিত্তিক ও সার্বজনীন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও অতীত হতে বর্তমান সরকারের আমলে তা হয়েছে উপেক্ষিত। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের অঙ্গীকার ছিল গণমুখী, সার্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ১৯৭২ সালের কুদরত -ই-খুদা শিক্ষা কমিশন পুনরায় বাস্তবায়নের ঘোষণা দিলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয়ে উঠেনি। শিক্ষানীতির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে- ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে নৈতিক, মানবিক, সাংস্কৃতিক, বিজ্ঞানভিত্তিক ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠাকল্পে শিক্ষার্থীদের মননে, কর্মে ও ব্যবহারিক জীবনে উদ্দীপনা সৃষ্টি করা। বস্তুত বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিজ্ঞানভিত্তিক, গণমুখী ও বাস্তবমুখী এখনও হতে পারেনি। যার কারণে বাংলাদেশের অসহায় গরীব মেহনতি মানুষের ছেলে-মেয়েরা আসল শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তা নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হবে।
আমাদের দেশে রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা নিযুক্ত আছেন, যারা নীতি নির্ধারণ করেন তাদের সম্পর্কে যদি এই শিক্ষাকে ঘিরে বলা যায়- তাহলে আমরা দেখতে পাই যে, সেখানে যথাযথ নীতি আদর্শকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না। আজকে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বছরকে বছর ধরে পরীক্ষামূলক একটা ব্যবস্থা চলছে। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা হতে হবে গণমুখী ও শিক্ষা হতে হবে বাস্তবমুখী। আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক যে শিক্ষা হয় সেখানে শিক্ষার অর্জনের প্রক্রিয়াটা অপূর্ণতা থেকে যায়। যে শিক্ষা ব্যবস্থা সমাজব্যবস্থাকে বাদ দিয়ে বা বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে যদি শিক্ষা দেওয়া হয় তাহলে সেই শিক্ষা যথাযথ হতে পারে না। আমাদের ছাত্র সমাজকে জ্ঞান অর্জনের জন্য শিক্ষা দরকার। শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি হয় যেনতেন করে একটা ডিগ্রী লাভ করা, একটা সার্টিফিকেট অর্জন করা, একটা চাকরী পাওয়া তাহলে এই জায়গাটিতে আমি দ্বিমত পোষণ করি।
শিক্ষার উদ্দেশ্য হতে হবে প্রকৃত অর্থে জ্ঞান অর্জন, যেখানে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে চিনবে, জানবে এবং যথাযথ মর্যাদা দেবে। মানুষ বলতে এখানে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষের কথায় বলা হচ্ছে, যার মধ্যে থাকবে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মেধা, সততা, নিয়মানুবর্তিতা, নিষ্ঠা ও মানবিকতা এসবগুলোর সমন্বয়ে সে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে আমার যেটুকু পরিলক্ষিত হয়, সমাজের ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা জানার পরিবেশ যেমনি কম তেমনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুঁখে দাঁড়ানোর সাহসও মানুষের মধ্যে কম। তাহলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা গোড়ায় গলদ এবং আমাদের দেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্বরত ব্যক্তিদের তা স্বীকার করতেই হবে।
সমগ্র বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থা সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। যারা শিক্ষক নিয়োগ করেন সেই কর্তৃপক্ষ দুর্নীতি ও অনিয়মের মধ্য দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে থাকেন। প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে গড়ে উঠতে না পারলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থাও মুখ থুবড়ে পড়ে থাকবে। বাংলাদেশের এই অব্যবস্থাপনার মধ্যে শিক্ষা কখনো এগিয়ে যেতে পারে না। এখানে পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব, একাডেমি ভবনের অভাব, শ্রেণিকক্ষের সংকট, কলেজগুলোতে ছাত্রাবাসের অভাব, কলেজে লাইব্রেরীর অভাব ইত্যাদি শিক্ষাক্ষেত্রে যে অসঙ্গতি ও নানাবিধ সমস্যা রয়েছে সেগুলো দূর করতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কিভাবে ভাল হতে পারে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা যদি এরকমই হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজগুলো কি রকম হবে? আজকে গুণগত রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে অথবা বিশেষ উন্নয়নের কারণে যদি এধরনের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় তাহলে আমাদের সমাজ, আমাদের দেশ তথা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীরা শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া কখনোই সম্ভব নয়, এটাই বাংলাদেশের শিক্ষার নির্মম বাস্তবতা। আমাদের শিক্ষার্থী বন্ধু, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সুশীল সমাজ এবং সর্বোপরি দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দরা শিক্ষার ক্ষেত্রে গভীরভাবে অনুভব করতে হবে।
ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত চেয়ারম্যান-সদস্যদের নিয়ে পরিচালিত তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের ফলে তিন পার্বত্য জেলার প্রাথমিক শিক্ষার আজ বেহাল দশা। একজন প্রাথমিক পদে মেধা ভিত্তিতে নিয়োগ না করে ১০/১৫ লক্ষ ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে ও দলীয়করণের ভিত্তিতে অযোগ্য লোকদের নিয়োগের ফলে তিন পার্বত্য জেলার প্রাথমিক শিক্ষার এমন করুণ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। ফলে তিন পার্বত্য জেলায় শিক্ষকতার অবৈধ বর্গা প্রথা আজ অন্যতম স্বীকৃত ব্যবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষা একটা জাতির মেরুদণ্ড। সেজন্য শিক্ষাকে নিয়ে ঢং বা ন্যাকামি করা যায় না। পৃথিবীতে সব জিনিসই আসলে শিক্ষা। আজকে এ্যারোপ্লেন উড়ছে আকাশে, রেলগাড়ি চলছে, মানুষ চাঁদে গেছে, চিকিৎসা ব্যবস্থার অবিশ্বাস্য উন্নতি, কৃষির উন্নতি, অদ্ভুতপূর্ব শিল্পায়ন, মানবসভ্যতার বিকাশ, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং মানুষের বিস্ময়কর সাফল্য সবকিছু আসলেই শিক্ষা উন্নতমানের জন্য আমরা পেয়েছি। সুতরাং মানবসভ্যতাও শিক্ষা দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষার মান যতদিন থাকবে এই সভ্যতাও ততদিন থাকবে। মানুষের অর্থনীতি উন্নতির ক্ষেত্রে শিক্ষার একটা বিরাট অবদান রয়েছে। এক সময় আমেরিকাতে এক বছরে অর্জিত যে সম্পদ উৎপাদন হয়েছিল, সেই সম্পদের শতকরা ৮৭ ভাগ হল বিদ্যাজাত। তাহলে আজ পৃথিবীর যে সম্পদ অর্জিত হয়েছে তা সবকিছু শিক্ষার মাধ্যমে পেয়েছি। বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা নিযুক্ত আছেন তারপরও তারা কি শিক্ষাকে নিয়ে ঢং করবেন এবং শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি, অনিয়ম করবেন? আমার প্রশ্ন থেকে যায়! বাংলাদেশের সকল মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ কমিয়ে এনে শুধুই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ শতকরা যদি ৯০ ভাগ করা হয় এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে দুর্নীতি, অনিয়ম জেরো-টলারেন্ট করতে পারলে ১০ বছরের মধ্যে গণমুখী, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল একটা সমৃদ্ধশালী দেশ আমরা পেতে পারি বলে আমি মনে করি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষেত্রে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ সম্পর্কে সরকারের কাছে আমরা দাবি করেছিলাম প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা এবং সরকারী কলেজগুলো যাতে যথাযথভাবে পরিচালিত হতে পারে সেই ধরনের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতার নিরিখে সেই দাবিকে অস্বীকার করে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠায় গণবিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে এই পার্বত্যাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়নের জন্য দাবি করা হয়েছে একটা প্যারামেডিকেল ইনস্টিটিউট। এসকল প্রাথমিক বিষয়গুলো আগে গুরুত্ব না দিয়ে রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা যথাযথ নয় বলে পার্বত্যাঞ্চলের মানুষ মনে করে। তারপরও জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার নীতি অনুসরণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাকে অকার্যকর অবস্থায় পেলে রেখে রাঙ্গামাটিতে গনবিরোধী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছে। সরকারের এই বাস্তবতা থেকে সহজে অনুমান করা যায়, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে গণমুখী ও বাস্তবমুখী করা রাষ্ট্র পরিচালনায় নিযুক্ত প্রধান ব্যক্তিদের কোন ইচ্ছায় নেই। অথচ পৃথিবীতে যা কিছু মহান, যা কিছু বড়, যা কিছু কল্যাণকর এবং যা কিছু শ্রেষ্ঠ এসব কিছু শিক্ষা থেকেই এসেছে। আজ মহান শিক্ষা দিবসকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের শিক্ষানীতি যেন সবার জন্য শিক্ষানীতি হয় এবং গণমুখী ও বাস্তবমুখী শিক্ষানীতি হয়ে উঠে- এই প্রত্যাশা সবার।