মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা: মুক্তির আকাশে শান্তির ধ্রুবতারা

মিতুল চাকমা বিশাল

“কাপ্তাই বাঁধের দরজা বন্ধ করার সাথে সাথে দেখতে দেখতে বাঁধের পানি গ্রামের পর গ্রাম গ্রাস করে নিচ্ছে। আমাদের সুন্দর প্রিয় গ্রামটিও ডুবে যাবে। সবার মধ্যে একধরনের উৎকন্ঠা, অনিশ্চয়তা, শোক শোক ভাব। ধীরে ধীরে আমাদের বাড়ির দিকেও ধেয়ে আসছে পানি। ঠিক এমনি সময়ে মঞ্জু (এম এন লারমা) আমাদের বাড়ির দেয়াল থেকে এক খন্ড আর উঠোন থেকে আরেক খন্ড মাটি নিয়ে কাগজে ভালভাবে মুড়িয়ে আমার হাতে তুলে দিল। আর আমাকে বলছিল, এই জিনিসগুলো সযত্নে রেখে দিতে। সেদিন সেগুলো হাতে তুলে নিতে নিতে আমি ভাবনার সাগরে ভাসছিলাম আর অবাক হচ্ছিলাম। আমার ছোট ভাই আমাকে কি কোন যাদুকরের অমূল্য সম্পদ সংরক্ষণ করে দেয়ার ভার দিচ্ছে! কাগজের প্যাকেটটি খুলে মাটির খন্ডগুলোর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ভাবতে থাকি আর মনে মনে প্রশ্ন করি, এই মাটির খন্ডটিতে কী স্বার্থ বা কোন সাক্ষী বহন করছে কি? তখন মঞ্জুকে (এম এন লারমা) প্রশ্ন করেছিলাম, কেন এই মাটির টুকরো? তখন সে উত্তরে ‘এই মাটি অমূল্য জিনিস’ বলে আর কিছু না বলে কেবল একগাল হেসে চুপ করে থাকে।” -জ্যোতিপ্রভা লারমা মিনু (মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা- জীবন ও সংগ্রাম, পৃষ্ঠা-৬৩)

শিল্পী: পাপিয়া চাকমা

ভূমিই মানুষের জীবন, সংস্কৃতির আধার, বেঁচে থাকার অবলম্বন। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে মৌলিক অধিকারের প্রয়োজন, তার সমস্ত কিছুই এই ভূমিকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। সেই ভূমির প্রতি এমনই টান অনুভব করতেন আমাদের মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। কৈশোর বয়সেই যাঁর মনে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ আর দেশপ্রেমের জোয়ার উঠেছিল, সেগুলো তাকে আরো উচ্চমাত্রায় বিকশিত করে তুলেছিল। প্রকৃতপক্ষে তিনি কেবল একজন জাতীয়তাবাদীই ছিলেন না, ছিলেন একজন আন্তর্জাতিকতাবাদীও বটে। সংসদীয় বক্তব্যগুলো দেখলে তার স্পষ্ট প্রমাণ মিলে।

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সময়ে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করে দেওয়া হয়। সর্বোপরি এক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হয় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা। কিন্তু সেসবের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারেনি। তার কারণ, পশ্চাদপদ এই ঘুঁণেধরা সামন্তীয় সমাজব্যবস্থায় সমগ্র জুম্ম জনগণকে সংগঠিত করা সহজ কাজ ছিল না। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান গৃহীত হয়। সেই সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘শাসন-বহির্ভুত এলাকা’ (এক্সক্লুডেড এরিয়া)-এর মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখা হলেও ১৯৬০ সালে কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়, যা পার্বত্য চট্টগ্রামের পুরো সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার পট-পরিবর্তন করে দেয়। সেই সময়ে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে অধ্যায়নরত অবস্থায় মাত্র ২৪ বছর বয়সে কাপ্তাই বাঁধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে প্রচারপত্র বিলি করেছিলেন তিনি। তাও আবার সেই সময়ে, যখন ১৯৫৮ সালে স্বৈরাচারী আইয়ুব খান পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছিল এবং ’৬২-তে একটি মনগড়া সংবিধান উপহার দিয়েছিল। এর থেকেই তার প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতার প্রমাণ মেলে। সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের শিক্ষিত সমাজ, সামন্তীয় নেতৃবৃন্দের কাছে যা চিন্তারও বাইরে ছিল, সেগুলোই তিনি তুলে ধরতে চেষ্টা করেছিলেন জুম্ম জনগণের কাছে এবং সর্বোপরি সমগ্র বাংলাদেশের জনগণের কাছে। এখানেই তার বিশেষত্ব। জাতির ক্রান্তিলগ্নে, ঘুমন্ত জুম্ম জাতিকে জাগ্রত করতে পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনিই আবির্ভূত হয়েছিলেন শান্তির ধ্রুবতারা হিসেবে। সমগ্র নিপীড়িত-নির্যাতিত, শোষিত-বঞ্চিত জন-মানুষদের পথ প্রদর্শকরূপে।

জুম্ম জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা এম এন লারমা:

আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সমগ্র জুম্ম জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নিয়ে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এগিয়ে গেছেন। ভিন্ন ভাষাভাষি ১৪টি জাতিগোষ্ঠীকে এক কাতারে নিয়ে আসতে তিনি জুম্ম জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন। মূলত জুম্ম জাতীয় চেতনা থেকেই জুম্ম জাতীয়তাবাদ শব্দের উৎপত্তি। যার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে জুম বা পাহাড় নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার দ্বারা অর্থনৈতিক জীবনধারা এবং ঐতিহাসিকভাবে পশ্চাৎপদ এক সামন্তীয় শাসন-শোষণের অবসান তথা বিজাতীয় শাসন-শোষণ থেকে মুক্তির জন্য একই রাজনৈতিক আকাঙ্খা। মিজোরামের মিজোদের ক্ষেত্রে যদি দেখি, তাহলে সেখানে দেখা যায় যে, মিজোরামের প্রধান সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠী লুসাই এবং লুসাই ছাড়াও এখানে পাংখো, লাই, কুকি, মারা প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। মূলত মিজো ভাষা বলতে সংখ্যাগরিষ্ট লুসাইদের ভাষাকেই বুঝানো হয়, তবে কালক্রমে এ ভাষার সাথে মারা, লাই প্রভৃতি ভাষারও মিশ্রণ ঘটেছে। কিন্তু জাতিগতভাবে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির অধিকারী হলেও রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে তারা একই বন্ধনে আবদ্ধ আর এই বন্ধনই তাদেরকে মিজো হিসেবে একটি স্বতন্ত্র জাতীয়তাবোধের জন্ম দিয়েছে। তাই মিজো বললে কেবল লুসাইদেরকে বুঝানো হয় না, বরং মিজোরামে বসবাসরত লুসাই ভিন্ন পাংখো, বম, লাই প্রভৃতি জনগোষ্ঠীকেও বুঝানো হয়ে থাকে।

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জানতেন, পার্বত্য চটগ্রাম ঐতিহাসিকভাবে একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ সাংস্কৃতিক পরিবেশ দ্বারা গঠিত অঞ্চল। এতদঞ্চলের ভিন্ন ভাষাভাষি জনগোষ্ঠী এই অঞ্চলের বৈচিত্র্যকে এক বিশেষ মর্যাদা দান করেছে। যাদের অর্থনৈতিক জীবনধারা একই ধারায় প্রবাহিত এবং এই অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থা থেকেই তাদের সাংস্কৃতিক এবং আত্মিক মিল লক্ষ্য করা যায়। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, যুগ যুগ ধরে এই অঞ্চলের মানুষ শাসন-শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে আসছে। নিজেদের মধ্যে স্বাতন্ত্র্য থাকলেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন যুগে তাদেরকে সমষ্টিগতভাবে ভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়েছে। কখনও হিল পিপলস, কখনও ট্রাইব, কখনও পাহাড়ি ইত্যাদি। বস্তুত জুম্ম শব্দটি দ্বারা পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসরত ভিন্ন ভাষাভাষি প্রত্যেকটি জনগোষ্ঠীকেই বুঝানো হয়। নৃ-তাত্ত্বিক দিক থেকে এর বিচার ভিন্ন হতে পারে, তবে ‘জুম্ম’ শব্দের উৎপত্তি কেবলমাত্র নৃ-তাত্ত্বিক নয়। এর পশ্চাতে রয়েছে সুদীর্ঘকাল ধরে চলে আসা রাজনৈতিক দমন-পীড়নের এক অনন্য ইতিহাস। উল্লেখ্য যে, জুম্ম শব্দের অর্থ জুমচাষী নয়, এর বিশদ অর্থ হচ্ছে ‘পাহাড়ের অধিবাসী’। নিজেদেরকে স্বতন্ত্র হিসেবে দাবি করার মধ্য দিয়ে এবং এক ঐক্যবদ্ধ জাতীয় চেতনা থেকেই জুম্ম জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি। জুম্ম জাতীয়তাবাদ হচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের নির্যাতিত ও নিপীড়ত মানুষের অধিকার আদায়ের এক চাবিকাটির নাম।

এম এন লারমা ও উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ:

জাতীয়তাবাদের দুটি নেতিবাচক দিক থাকে। প্রথমটি, এর উগ্রতা অর্থাৎ উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং অপরটি হচ্ছে সংকীর্ণতা অর্থাৎ সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ। উগ্র জাতীয়তাবাদের দ্বারা নিজ জাতি বড় বা শ্রেষ্ঠ, নিজ জাতি মহান, অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী নিচ, হীন ইত্যাদি ধারণা পোষণ করা হয়। এর দ্বারাই এক জাতি অপর জাতির উপর আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ জাতিসমূহকে অধীনস্থ করে রাখার মানসিকতা তৈরি হয়, যার দরুণ শাসন-শোষণ করার এক উগ্র মানসিকতার উদ্ভব ঘটে। ঠিক যেমনটা আমরা লক্ষ্য করি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হিটলারের সেই জার্মান জাতীয়তাবাদের উত্থানে। যা জার্মান জাতিকে এক মরনোন্মুখ যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়ে সমগ্র বিশ্বকে এক অস্থিতিশীল পরিবেশ দান করে।

অপরদিকে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ একটি জাতিকে সবসময় ক্ষুদ্র করে দেখার হীনম্মন্য মানসিকতা তৈরি করে। নিজ জাতিকে সবসময় ছোট, হীন, বঞ্চিত, শাসিত ইত্যাদি ধারণা পোষণ করা সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের লক্ষণ।

কিন্তু এম এন লারমার জুম্ম জাতীয়তাবাদের দ্বারা উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রকাশ পায় না, এটি নয় কোন একক সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ। এ জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণ এবং উগ্র এই দুইয়ের উর্ধ্বে এক আন্তর্জাতিকতাবাদ। যা পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসরত জুম্ম জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক আত্মিক বন্ধন সৃষ্টি করেছে, তাদেরকে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত রাখার মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে। জুম্ম জাতীয়তাবাদ কেবলমাত্র উগ্র জাতীয়তাবাদের কাউন্টার ন্যারেটিভও নয়, এটি ঔপনিবেশিকতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্খা, ভিন্ন ভাষাভাষী ১৪টি জনগোষ্ঠীর আত্মিক বন্ধন, সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক এটি। এম এন লারমা জুম্ম জাতীয়তাবাদী হলেও তার চিন্তার ব্যাপ্তি কেবলমাত্র জুম্ম জনগণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি। তিনি সমস্ত নিপীড়িত, নির্যাতিত জাতির মানুষদের কথা বলতেন, মেহনতি কৃষক, শ্রমিক, মেথরদের কথা বলতেন। বস্তুত তিনি জুম্ম জাতীয়তাবাদী হলেও বাস্তবিকপক্ষে তিনি একজন আন্তর্জাতিকতাবাদী। ২৫ অক্টোবর ১৯৭২ সালে সংবিধান বিলের উপর সাধারণ আলেচনায় তার বক্তৃতা থেকেই স্পষ্ট প্রমাণ মেলে। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনের কথা পুরোপুরি এই সংবিধানে নাই। যদি সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনের কথা এই সংবিধানে থাকত, তাহলে আমার আপত্তির কোন কারণ থাকত না। কিন্তু আজ আমি দেখতে পাচ্ছি পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা, মাতাভাঙ্গা, শঙ্খ, মাতামুহুরী, কর্ণফুলী, যমুনা, কুশিয়ারা প্রভৃতি নদীতে রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে যারা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর ধরে নিজেদের জীবন তিলে তিলে ক্ষয় করে নৌকা বেয়ে দাঁড় টেনে চলেছেন, রোদ-বৃষ্টি মাথায় করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যারা শক্ত মাটি চষে সোনার ফসল ফলিয়ে চলেছেন, তাদের মনের কথা এই সংবিধানে লেখা হয় নি। আমি বলছি, আজকে যারা রাস্তায় রাস্তায় রিক্সা চালিয়ে জীবন নির্বাহ করে চলেছেন,তাদের মনের কথা এই সংবিধানে লেখা হয় নি।’

তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আজকে যারা কল-কারখানার চাকা, রেলের চাকা ঘুরাচ্ছেন, যাদের রক্ত চুঁইয়ে আজকে আমাদের কাপড়, কাগজ প্রতিটি জিনিস তৈরি হচ্ছে সেই লক্ষ লক্ষ মেহনতি মানুষের মনের কথা এখানে নাই।’ এর থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, তিনি কেবল নিজ জাতির মধ্য, নিজের জাতীয়তাবোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন নি। পৌঁছে গিয়েছিলেন মেহনতি মানুষদের পরম বন্ধুরূপে, সমস্ত নিপীড়িতদের মুক্তির কান্ডারী রুপে।

অন্যদিকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদ উগ্র জাতীয়তাবাদে পরিণত হয়ে বাংলাদেশে বসবাসরত বাঙালি ভিন্ন অন্যান্য জাতিসমূহের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, তাদেরকে বাঙালি হয়ে যাওয়ার প্রস্তাব রাখে।

সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ (৯)এ জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে, ‘ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন, সেই বাঙালি জাতির জাতির ঐক্য ও সংহতির প্রতীক হইবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।’

এখানে প্রকাশ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধে কেবলমাত্র ‘একক সত্তাবিশিষ্ট’ বাঙালি জাতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাঙালি ভিন্ন অপরাপর আদিবাসী জনসমাজকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হয়েছে। অনুরূপভাবে সংবিধানের সংবিধানের অনুচ্ছেদ (৬) এ সংশোধনী প্রস্তাব এনে আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া প্রস্তাব পেশ করেন যে, ‘বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে, বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।’ মর্মে সন্নিবেশিত করা হোক। সেদিন সঙ্গে সঙ্গে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, ‘আমি যে অঞ্চল থেকে এসেছি, সেই পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীরা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশে বসবাস করে আসছে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষায় বাঙালিদের সঙ্গে আমরা লেখাপড়া করে আসছি। বাংলাদেশের সঙ্গে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশের কোটি কোটি জনগণের সঙ্গে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সব দিক দিয়েই আমরা একসঙ্গে বসবাস করে আসছি। কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা, চৌদ্দ পুরুষ-কেউ বলে নাই, আমি বাঙালি।’

কিন্তু সংশোধনী পাস হয়ে যায়। উগ্র জাত্যভিমানের কাছে এম এন লারমার গভীর তাৎপর্য্যপূর্ণ বক্তব্য সেদিন গৃহীত হয় নি। যার প্রতিবাদ স্বরূপ এম এন লারমা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য গণপরিষদ বৈঠক বর্জন করে পরিষদ কক্ষ ত্যাগ করে চলে যান।

এম এন লারমা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম:

‘আমরা করুণার পাত্র হিসেবে আসিনি। আমরা এসেছি মানুষ হিসেবে। তাই মানুষ হিসেবে বাঁচার অধিকার আমাদের আছে।’ -এম এন লারমা (বাংলাদেশ গণপরিষদ বিতর্ক, ২৫ অক্টোবর ১৯৭২)

পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসরত পাহাড়ি জনগণ যুগ যুগ ধরে প্রকৃতির সাথে লড়াই করে প্রকৃতিকে পরিবর্তন করে শত প্রতিক‚লতাকে ডিঙিয়ে প্রকৃতিকে বাসযোগ্য করে তুলেছে। এ হচ্ছে প্রকৃতির প্রতিক‚লতার বিরুদ্ধে এক সংগ্রাম। প্রকৃতির সাথে সাথে এতদঞ্চলের বিভিন্ন প্রাণিক‚লের সাথেও সংগ্রাম করতে হয়েছে তাদের। এই লড়াইয়ে পুরোপুরি বিজয় অর্জিত না হলেও বলা চলে মোটামুটি জীবন ধারণের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তা তারা অর্জন করতে পেরেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযথ সংরক্ষণ আর ব্যবহারের বিষয়টিও তারা করেছে জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে। সমগ্র বিশ্বে কোন না কোন সময়ে দূর্ভিক্ষ, খাদ্যভাব দেখা দিলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম সেধরনের কোন উপদ্রবের দেখা মেলেনি। কিন্তু উপনিবেশিক শক্তির হিংস্র থাবা থেকে এই পাহাড়ের রক্ষা হয় নি। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই অঞ্চলকে চুষে খাওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হতে থাকে। মোঘল, ব্রিটিশ, পাকিস্তান, বাংলাদেশ কোনকালেই তার ভাটা পড়েনি। অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করে এই লুটের প্রতিযোগিতাকে আরো উলঙ্গ করে দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের পশ্চাদভূমি হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ব্যবহার হেতু এই অঞ্চলকে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করার এক উদ্ভট কারণও হাজির করা হয়েছে। ধর্মীয় জাতীয়তার ভিত্তিতে যে বিভাজন হচ্ছিল, পার্বত্য চট্টগ্রামের বেলায় এসে সেটা ধর্মের বাহিরে গিয়ে কেবল লুন্ঠনের ভাগবাটোয়ারায় পরিণত হয়েছিল। পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রতি মাসে ৬০-৭০ লাখ ঘনফুট গাছের পারমিট দেওয়া হতো। সেই হিসাবে বৎসরে প্রায় ৭ কোটি ২০ লাখ ঘনফুট গাছ পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাইরে পাচার করা হতো। বর্তমানে গাছ কমে যাওয়ায় প্রতি মাসে ৫ লাখ ঘনফুট গাছের পারমিট প্রদান করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে বন বিভাগের ৪ টি ডিভিশন থেকে এই হিসাবে বৎসরে প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার ঘনফুট গাছ পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাইরে পাচার করা হয় (সুত্র:হিল ভয়েস)। এ তো কেবল গাছের হিসাব। এছাড়াও বাঁশ, বেত, পাথর প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদকে লুন্ঠন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশ এবং এর অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়ে একে দাসত্বের শৃঙ্খল পরানোর প্রচেষ্টা চলছে। ষাটের দশকের কাপ্তাই বাঁধ তাই জুম্ম জনগণের মরন ফাঁদ হয়েই রয়ে গেছে।

প্রকৃতির সাথে লড়াইয়ে যে মানুষ নিজেকে সগৌরবে দাঁড়িয়ে রেখেছে, সেই মানুষগুলোকে কৃত্রিম উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়ে অসহায়ে পরিণত করা হয়েছে। সরল উৎপাদন ব্যবস্থার সরলতাকে কাজে লাগিয়ে নিরবে-নিভৃতে নির্যাতন-নিপীড়নের যাঁতাকলে পিষ্ট করে কৃত্রিম এক সরলতার তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মামবেন্দ্র নারায়ণ লারমা তাই জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন এক মুক্তির কান্ডারী হয়ে। সদ্য স্বাধনীতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের সংবিধানে পাহাড়ের মানুষদের জন্য একটু ঠাঁই খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে আসা ভিন্ন ভাষাভাষী ১৪ টি জাতিগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে শোষণ ও নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছে, এই সত্যকে তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এই ১৪টি জাতিগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করতে জুম্ম জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ধারণ করে ১৫ ফেব্রæয়ারি এম এন লারমার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করে। তৎপরবর্তী ২ নভেম্বর ১৯৭২ সংবিধান বিল বিবেচনা (দফাওয়ারী পাঠ) এ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংবিধানে “৪৭(ক)। পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল বিধায় উক্ত অঞ্চলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকারের নিরাপত্তার জন্য উক্ত অঞ্চলটি একটি উপজাতীয় স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হইবে” নামে একটি নতুন অনুচ্ছেদ সংযোজন করার প্রস্তাব পেশ করেন। কিন্তু তার সেই প্রস্তাবটিকে ‘বিধি বহির্ভূত’ বলে নাকচ করে দেওয়া হয়।

“মানুষ পিতৃশোক ভুলতে পারে, কিন্তু ভূমি হারানোর শোক কখনও ভুলতে পারে না।-স্টালিন”

শুরুতেই বলেছিলাম, ‘ভূমিই মানুষের জীবন’। এই ভূমিকে ঘিরেই মানুষের সামাজিকতা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি সমস্ত কিছু আবর্তিত হয়। সেই ভূমিকে নিরাপদ রাখার প্রয়াস তাই এম এন লারমাও করেছিলেন। ভূমিকে নিরাপদ রাখার অর্থ হলো এই যে, ভূমির সাথে সাথে, এর সাথে জড়িয়ে থাকা সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতিকে নিরপাদ রাখা। ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা নিয়ে পাকিস্তান সরকার তথাকথিত বিজলী বাতি আর উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে এতদঞ্চলের লক্ষাধিক পাহাড়িকে বাস্তুচ্যুত করতে যখন মরিয়া, সেই সময়ে নিজের মাতৃভূমির রক্ষার্থে ছাত্রাবস্থাতেই তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন প্রচারপত্র বিলি করে। নিজ ভূমির মানুষ ভূমি হারিয়ে, সহায়-সম্বল হারিয়ে, নিঃস্ব হয়ে পরদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। কেউ বা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে পড়ছে। শাসকের লোলুপ দৃষ্টি যখন পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে, তখনই তিনি উঠে দাঁড়ানোর সাহস করেছিলেন। নিজের বাস্তুভিটার একখন্ড মাটি নিয়ে দৃঢ় শপথ নিয়েছিলেন, সেই মাটির মর্যাদা রাখার। ফলশ্রæতিতে ১৯৭২ সালে গঠন করেছিলেন জনসংহতি সমিতি। যার লক্ষ্য হচ্ছে একটি শোষণহীন ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। যার আদর্শ স্বয়ং মানবতা।

সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশে পার্বত্যবাসীর রাজনৈতিক অধিকারকে ভূলন্ঠিত করে, তাদের প্রতিনিধিত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। যুগ যুগ ধরে ঐতিহাসিকভাবে বিশেষ শাসন ব্যবস্থার দ্বারা পরিচালিত পার্বত্য চট্টগ্রামের মর্যাদাকে বাতিল করে দিয়ে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশের পথটিকে উন্মুক্ত করা হয়েছে। এতদঞ্চলের প্রথাগত ও ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকারকে খর্ব করে কেবলমাত্র করুণার পাত্র হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়েছে। স্বভাবতই জাতির ক্রান্তিলগ্নে সেই সময়ে প্রগতিশীল এক আদর্শকে ধারণ করে এম এন লারমার আবির্ভাব। গণপরিষদে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম হল বিভিন্ন জাতিসত্তার ইতিহাস। কেমন করে সেই ইতিহাস সংবিধানের পাতায় স্থান পেল না, তা আমি ভাবতে পারি না। সংবিধান হচ্ছে এমন একটা ব্যবস্থা, যা অনগ্রসর জাতিকে, পিছিয়ে পড়া, নির্যাতিত জাতিকে, অগ্রসর জাতির সাথে সমান তালে এগিয়ে নিয়ে আসার পথ নির্দেশ করে। কিন্তু বস্তুতপক্ষে এই পেশকৃত সংবিধানে আমরা সেই রাস্তার সন্ধান পাচ্ছি না।’ কিন্তু রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের কাছে তার সে বক্তব্য সেদিন গৃহীত হয় নি। রাষ্ট্র সেদিন এক বঞ্চিত মানবের অধিকারকে স্বীকার করতে পারেনি। উগ্র জাত্যভিমানের কাছে স্বাধীন দেশের একজন নগরিকের অধিকারই কেবল নয়, সমগ্র দেশের একটি অংশের অধিকারকে সেদিন হরণ করা হয়েছিল। তাই তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্ত সচেতন ব্যক্তিদের নিয়ে পার্বত্যবাসীকে অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার মহান ব্রত নিয়ে এগিয়ে গেছেন পাহাড় থেকে পাহাড়ে। শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়ে জুম্মদের চেতনাবোধকে জাগ্রত করার মহাপ্রয়াস করেছিলেন, যাদের অধিকাংশই ছিলেন শিক্ষক।

প্রাসঙ্গিকতা:

সময়ের আবর্তে অনেক কিছুই লুপ্ত হয়ে যায়, অনেক কিছুই ধ্বংস হয়ে যায়। তবে এম এন লারমার প্রাসঙ্গিকতা যেন কোন কালেই হারাবে না, কোন সময়েই লুপ্ত হবে না। বিশ্বের সমস্ত নিপীড়িতের আন্দোলনে এবং আন্দোলনের পরেও তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বর্তমান সময়ে এম এন লারমা আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। কেননা সম্রাজ্যবাদ বিগত সময়ের চেয়েও আরো ভয়ংকর আর কৌশলে পদক্ষেপ ফেলে শোষণের স্টীম রোলার চালিয়ে যাচ্ছে। উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান, ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান, পুঁজির শোষণ এ সমস্ত কিছু বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিকে আরো জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে। এ সময় স্বাধিকারের জন্য লড়াই করা প্রত্যেক জাতি, শ্রেণির কাছে বর্তমান পরিস্থিতি আরো বেশি কঠিনরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। ক্ষমতার দ্ব›েদ্ব বর্তমান সাম্রাজ্যবাদ কলোনির নেশায় মত্ত হয়ে সংঘাতকে আপন করে নিয়ে সমগ্র বিশ্ববাসীকে ধীরে ধীরে এক মরনোন্মুখ যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিও আজ এক ভিন্ন মাত্রায় ধাবিত হচ্ছে। দীর্ঘ দুই দশকের অধিক সশস্ত্র সংগ্রামের ফসল পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি আজ শাষকগোষ্ঠীর বিশ্বাসঘাতকতায় মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। নয়া উপনিবেশিক কায়দায় শোষণের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

মিলিটারাইজেশন আর ইসলামি সম্প্রসারণবাদের আগ্রাসন এতদঞ্চলের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যকে গ্রাস করতে চাইছে। রাষ্ট্র উগ্র জাতীয়তাবাদের খোলসের বাইরে আরো একটি খোলসের দ্বারা আবৃত হয়েছে এখন, সেটি হচ্ছে ধর্মীয় মৌলবাদের খোলস। যেখান থেকে রাষ্ট্র কিছুতেই বেরুতে পারছে না। সংবিধানে ‘রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ইসলামকে’ স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, আবার তথাকথিত ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’র নীতি বাস্তবায়নের জন্য ‘কোন ধর্মকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দান’ এই বাক্যটিও সংযোজিত রয়েছে। এর থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ধর্মীয় মৌলবাদকে বাহিরের ধর্মনিরপেক্ষতার স্বচ্ছ আবরণ দ্বারা আবৃত করার চেষ্টা করছে রাষ্ট্র। সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রহিম’ সংযোজিত রয়েছে। সামরিক জান্তারা সেগুলো খুব ভালভাবেই পাকাপোক্ত করে রেখে গেছে, আর গণতন্ত্রের মানসকন্যা, মানসপুত্ররা সেই সামরিক জান্তাদের নীতিবহির্ভূত কোন কিছু করতে কোন সাহসই করতে পারে না। এম এন লারমার সেই সাত কোটি মানুষের মনের কথার সংবিধানরূপে এটি কখনই মুখ তুলতে পারে নি। শাসকগোষ্ঠীর শাসন-শোষণের হাতিয়ার হয়েই রয়ে গেছে এটি।

মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার যে স্বপ্ন, একটি সুন্দর, নিরাপদ পার্বত্য অঞ্চলের, সে স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার সময় এসে গেছে। তরুণ বয়সে যে প্রকারে এম এন লারমা লড়াইয়ের ময়দানে পা রেখে গেছেন, ঘুমন্ত জুম্ম জাতিকে জাগ্রত করে তাদের ঐক্য ও সংহতিকে প্রসারিত করেছেন। সেই ঐক্য ও সংহতির মূলে এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী মহল আঘাত করেছে। আংশিক সুবিধা লাভের প্রত্যাশায় সামগ্রিক স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেওয়া সুবিধাবাদীরা আবারও শোষকের পা চাটা কুকুরে পরিণত হয়েছে। এই সময়ে এম এন লারমার আদর্শকে ধারণ করে, লড়াইয়ের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়াই তারুণ্যের কর্তব্য। প্রতিটি তারুণ্যের মনে এম এন লারমার যে রক্ত প্রবাহিত, সেই রক্ত কণিকাকে উত্তপ্ত করার সময় এসে গেছে। আমাদের ধমনীর শিরায় শিরায় বেঁচে থাক এম এন লারমা, এমন প্রতিজ্ঞায় সংকল্পবদ্ধ হতেই হবে। রাষ্ট্রের জুম্ম স্বার্থ বিরোধী পলিসিকে বানচাল করতে হলে, একটি সুন্দর জীবনের প্রত্যাশা করতে হলে, আগামীর জন্য নিরাপদ আবাসস্থল পেতে হলে এম এন লারমার পথেই হাঁটতে হবে। তার সমস্ত কার্যকলাপকে সার্থক তখনই মনে হবে, যখন প্রতিটি তরুণ তার অনুসারী কেবল নয়, তার চেতনাকে ধারণ করে এক নতুন সমাজ বিনির্মাণে অগ্রগামী হয়ে পথ দেখাবে।

মিতুল চাকমা বিশাল: সাবেক সদস্য পিসিপি।

More From Author