হিল ভয়েস, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ঢাকা: বননির্ভর আদিবাসী মানুষের অধিকার সুরক্ষার দাবি করেছে ভূমি, বন ও পরিবেশবাদী মানবাধিকার সুরক্ষা কর্মী এবং আদিবাসী নেতৃবৃন্দ। গতকাল ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ শনিবার অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) ও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) যৌথভাবে ‘বন আইন ২০১৯ খসড়া বিষয়ে নাগরিক অভিমত’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল জাতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, চাকমা সার্কেল প্রধান ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন, কারিতাস ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (সিডিআই)-এর পরিচালক থিওফিল নকরেক, পার্বত্য চট্টগ্রাম বন সংরক্ষণ ও ভূমি অধিকার আন্দোলনের সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা, সিডিএ-এর শাহ-ই-মবিন জিন্নাহ, স্বপন কুমার গুহ, শফিকুল ইসলাম, আদিবাসী নারী নেত্রী বিচিত্রা তিরকি প্রমুখ।
আলোচনায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের তৈরি খসড়া বন আইনের ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, খসড়া আইনটি নতুন কোনো আইন নয়। এখানে মূলত ১৯২৭ সালের বন আইনের ধারাগুলোকে বাংলা করা হয়েছে। খসড়ায় যুগোপযোগীকরণের কথা বলা হলেও এতে যুগোপযোগী হওয়ার কোনো উপাদান নতুন করে সংযোজন করা হয়নি বরং ক্ষেত্রবিশেষে অগভীর কিছু প্রস্তাব যুক্ত করা হয়েছে।
রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, বিদ্যমান আইনি কাঠামোতে পরিবর্তন এনে বন ব্যবস্থাপনায় বননির্ভর মানুষের অংশগ্রহণ ও অংশীদারত্ব নিশ্চিত করতে হবে। সংরক্ষিত বন বা রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণার আগে বনবাসী মানুষের যে ছয় ধরনের অধিকারের দাবি নিষ্পত্তির বিধান আইনে রাখা হয়েছে সেটি অবশ্যই প্রতিপালন করতে হবে।
চাকমা সার্কেল প্রধান রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, বর্তমান বন আইনে ‘বন’ এর কোনো সংজ্ঞা নেই। প্রস্তাবিত সংজ্ঞায় সরকার যে কোনো ভূমিকে ‘বন’ হিসেবে ঘোষণা দিলেই তা ‘বন’ হিসেবে বিবেচিত হবে, সেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আর সেটা হলে কেবল সাইনবোর্ড-সর্বস্ব বন চিহ্নিত হতে পারে।
সামাজিক বনায়নের বিষয়টি অনেক আগেই পাহাড়িরা প্রত্যাখ্যান করেছে উল্লেখ করে দেবাশীষ রায় বলেন, খসড়া আইনে জুমচাষের ক্ষেত্রে যেসব বিধানের প্রস্তাব করা হয়েছে তা পার্বত্য চুক্তির মূল বিধান ও চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বন নীতি ও অন্যান্য নীতির সঙ্গে সংগতি রেখে এবং বসবাসকারীদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের ফরেস্ট ট্রানজিট বিধিমালা সংশোধনের দাবি জানান তিনি।
খসড়া বন আইনে বন সংশ্লিষ্ট মানুষের স্বার্থকে আমলে নেওয়া হয়নি বলে সভায় মন্তব্য করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক গৌতম দেওয়ান। তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের জন্য কোনো আইন পাশ করা হলে তা আঞ্চলিক পরিষদের মতামতের ভিত্তিতে করতে হবে বলে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে বলা হয়েছে। কিন্তু তা করা হয় না।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, সিলেট, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আদিবাসীরা বসবাস করেন। সেখান থেকে তাদের উচ্ছেদের যাতে কোনো চেষ্টা করা না হয় সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে বন বিভাগের কাছে সেরকম একটি নির্দেশনা অবিলম্বে দিতে হবে।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন উত্তরবঙ্গসহ গোটা সমতলের বন সম্পর্কে বলেন, বন এখন আর নেই, সব ধ্বংস ও উজাড় হয়ে গেছে। এখন রয়েছে গাছবিহীন বন এলাকা। ফলে এই অঞ্চলের আদিবাসী মানুষেরা চরম খারাপ অবস্থার মধ্যে বসবাস করছে।
কারিতাস ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (সিডিআই)-এর পরিচালক থিওফিল নকরেক বলেন, বন আইন প্রণয়নের বহু আগে থেকে আমরা গারোরা এখানে বসবাস করে বনকে রক্ষা করছি। তাদের উচ্ছেদের জন্য বন বিভাগ উঠে পড়ে লেগেছে। বন-নির্ভর আদিবাসী মানুষের প্রত্যেকের নামে ১০ থেকে ১১টি মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে।
এছাড়াও আলোচনা সভায় বননির্ভর আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানুষের অধিকারের সুরক্ষা এবং বন বিভাগের জবাবদিহি নিশ্চিত করে নতুন বন আইন করার দাবি উঠেছে। এর পাশাপাশি বন সম্পর্কিত আইন ও নীতিমালায় বনবাসী মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ারও কথা বলা হয়েছে।