প্রধীর তালুকদার রেগা
এবার ৭৩ বছর পর গিলগিট-বালটিস্তান ভারতে অর্ন্তভুক্ত হওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। পাকিস্তান কবলিত কাশ্মীরের রাজনৈতিক কর্মী ড: আমজাদ মির্জা জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে জোর দাবি জানান গিলগিট-বালটিস্তান পাকিস্তানের কব্জা থেকে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হতে চায়। ভারতও গিলগিট-বালটিস্তান নিজের দখলে নিতে চায়।
পাক অধিকৃত গিলগিট-বালটিস্তান। জম্মু কাশ্মীর ও লাদাকের উত্তর পশ্চিমাংশের এক বিশাল পর্বতময় অঞ্চল, যার উত্তরে আফগানিস্তান, উত্তর-পূর্বে চীনের ঝিনজিয়াং প্রদেশ, দক্ষিনে পাকিস্তান শাসিত আজাদ, জম্মু ও কাশ্মির (এজেকে), দক্ষিণ-পূর্বে ভারত শাসিত জম্মু ও কাশ্মির। ৭২,৪৯৬ বর্গকিলোমিটারের এলাকাজুড়ে গিলগিট-বালটিস্তানের জনসংখ্যা মাত্র ২০ লক্ষ। এ অঞ্চলে বিভিন্ন সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে তাদের স্বতন্ত্র আস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করতে পাকিস্তান সরকার শুরু থেকেই উদ্যত।
গিলগিট-বালটিস্তান ইউএনপিও (আনরিপ্রেজেন্টটেড নেশনস এন্ড পিপলস অর্গানাইজেশন)-এর সদস্য। পার্বত্য চট্টগ্রাম, তিব্বত, তাইওয়ান ইউএনপিও-র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ইউএনপিও’র সদস্য সংখ্যা এখন ৪৪। সদস্য হিসেবে ছিল পূর্ব তৈমূর, ইস্টোনিয়াও, তবে এরা বর্তমানে স্বাধীনতা লাভ করেছে। গিলগিট-বালটিস্তান যেমন পাক অধিকৃত অঞ্চল তেমনি পার্বত্য চট্টগ্রামকেও পাক আগ্রাসিত অঞ্চল বলা যেতেই পারে।
’৪৭ সালে দেশভাগের শুরু থেকেই গিলগিট-বালটিস্তান অঞ্চলটি জম্মু কাশ্মিরের একটি বিতর্কিত অঞ্চল। এখানে সিয়া মুসলিম ধর্মীয় মানুষের সংখ্যাধিক্য। অন্যদিকে পাকিস্তানের অপরাপর সকল অংশে সুন্নি মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এখানে মীর ও সামন্তপ্রভু রাজাদের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। পাকিস্তান সরকার প্রথম থেকেই সিডিউল ৪ নামে এক আইন প্রয়োগ করে এ অঞ্চলের শাসন শোষণ জারি রেখেছে যা স্থানীয় জনগণ মোটেই মেনে নিতে পারেনি। তাছাড়া পাকিস্তানের অপরাপর প্রদেশের মতো কোন সুযোগ সুবিধা এ অঞ্চলের মানুষ কখনো পায়নি। প্রশাসনিকভাবে এবং উন্নয়নের দিক থেকে বরাবরই থেকেছে বঞ্চিত।
মূলত গিলগিট-বালটিস্তান অঞ্চলটি পাকিস্তানের জলাধার (ওয়াটার ট্যাঙ্ক) বলা হয়। ৪০ বছর আগে হাতে নেওয়া প্রকল্প পাকিস্তান সরকার তার সেনা বাহিনীর প্রত্যক্ষ মদতে চীনের সাহায্যপুষ্ট হয়ে ইন্ডাস নদীতে বিশাল দায়ামার ভাসা জলবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণ করছে।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ পাকিস্তান সরকার সে দেশের নতুন মানচিত্র প্রকাশ করেছে যেখানে কাশ্মির, জুনাগড় এবং ভারতের বেশকিছু অঞ্চলকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে দেখান হয়েছে। আর গিলগিট-বালটিস্তানকে তাদের পঞ্চম প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। বিবদমান দুই প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে এ কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলটি নিয়ে টানাপোড়েন নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কারণ চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক কড়িডোর (কারাকোরাম মহাসড়ক) এই গিলগিট-বালটিস্তান অঞ্চলটি হয়ে তৈরি হয়েছে। চীনের ঝিনজিয়াঙ প্রদেশ থেকে পাকিস্তানের হাসান এবডাল সংযোগকারী ১,৩০০ কিলোমিটার এই মহাসড়ক এখন পৃথিবীর অষ্টম আশ্চার্য্যরে নব সংযোজন। অনেকটা সিল্করোড বরাবর সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ৫,০০০ মিটার উচ্চতায় তিনটি পর্বতশ্রেণী যেমন হিমালয়, কারাকোরাম ও হিন্দুকুশ পর্বতমালা ভেদ করে তৈরি এ মহা সড়ক।
গিলগিট-বালটিস্তানে সরাসরি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে পরিচালিত এক নির্বাচিত পরিষদ রয়েছে। ইসলামাবাদের ফেডারেল মিনিস্ট্রি অব কাশ্মীর এফেয়ার্স এবং গিলগিট-বালটিস্তান অধীন এ পরিষদের মাধ্যমে পাকিস্তান অত্র এলাকার সকল সম্পদের নিয়ন্ত্রণ করে। তবে পাকিস্তানের সংবিধানে এই গিলগিট-বালটিস্তান বা উত্তরাঞ্চল সম্পর্কে কোন উল্লেখ নেই। তাই অঞ্চলটি স্বাধীনও নয়, পাকিস্তানে প্রদেশের মর্যাদাও নেই। বলা হয় পাকিস্তানী কব্জায় থাকা বিতর্কিত এলাকা। তবে ভারত মনে করে, এ অঞ্চলটি যেহেতু জম্মু কাশ্মীরের অংশ সে কারণে তা ভারতেরই অংশ। ১৯৪৭ সালে রাজা হরি সিংয়ের মাধ্যমে জম্মু কাশ্মীরের ভারতভুক্তির শর্ত অনুসারে এই অঞ্চল অবশ্যই ভারতের। তবে পাকিস্তানের কব্জায়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির সন্ধিক্ষণেই আগ্রাসনের শিকার হয় অনেক অঞ্চল। তার মধ্যে বাংলাদেশ লাগোয়া পার্বত্য চট্টগ্রাম ও জম্মু কাশ্মীর লাগোয়া গিলগিট বালটিস্তান। তৎকালীন জম্মু, কাশ্মীর, লাদাক, গিলগিট-বালটিস্তান এলাকাগুলিতে ছিল ছোট ছোট রাজাদের রাজত্ব। পার্বত্য চট্টগ্রামেও তেমনি চাকমা, বোমাঙ বা মঙ রাজার আস্তিত্ব ছিল। কারোর ছিলনা একক শক্তি বা আধিপত্য। সবই স্বতন্ত্রভাবে সামন্ততান্ত্রিক শোষণ শাসনের ব্যাবস্থার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিরোমণি কিন্তু সামগ্রিকভাবে দুর্বল রাজশক্তি। তবে জম্মুতে মহারাজা হরি সিংয়ের প্রভাব প্রতিপত্তি অন্যান্যদের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী ছিল। তবে একথা ঠিক যে রাজারা না ছিল জনদরদী, না ছিল জনপ্রিয়। প্রজাদের আশা-আকাক্সক্ষা কখনোই রাজাদের আশা-আকাঙক্ষার সাথে প্রতিফলিত ছিল না।
গিলগিট-বালটিস্তানের জনগণের সম্মতি ছাড়া এই অঞ্চলটি দখল করা হয়েছিল এবং বিরোধপূর্ণ অঞ্চল থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের জন্য ভারত ও পাকিস্তান বিষয়ক জাতিসংঘ কমিশন (টঘঈওচ)-এর আহ্বান থাকা সত্ত্বেও আজ অবধি দখলে রাখা হয়েছে। বিগত ৬০ বছর ধরে গিলগিট-বালটিস্তানকে যথাযথ সাংবিধানিক মর্যাদা, একটি কার্যকর আইনী ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়নি।
গিলগিট-বালটিস্তানের মত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটিও জুম্ম জনগণের সম্মতি ছাড়া তৎকালীন পাকিস্তান দখল করেছিল। গিলগিট-বালটিস্তানের মত পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য এখনো সাংবিধানিক মর্যাদা, সাংবিধানিক বিধিব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হয়নি। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ সম্বলিত বিশেষ শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রতিশ্রুতি প্রদান করলেও সরকার উক্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না করায় তাও নস্যাৎ হতে বসেছে।
গিলগিট-বালটিস্তান অঞ্চলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা না থাকায় সেখানে অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘন, তীব্র দারিদ্র, শিক্ষার নিম্নহার, মন্থর অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে না হওয়ায় জুম্ম জনগণের উপর ধারাবাহিক মানবাধিকার লঙ্ঘন, শিক্ষার হার কম, প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা ও পানীয়জল-স্যানিটেশন পরিষেবার অভাব, উন্নয়ন-বঞ্চনা প্রবলভাবে বিদ্যমান রয়েছে। ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ার অগ্রগতি না থাকায় উক্ত পরিস্থিতির কোন অগ্রগতি সাধিত হয়নি।
অন্যদিকে গিলগিট-বালটিস্তান ভূখন্ডের মধ্য দিয়ে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর চলে গিয়েছে। এর ফলে গিলগিট-বালটিস্তানের জনগণকে তাদের সম্মতি না থাকা সত্ত্বেও কিংবা কোন প্রকার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা ব্যতিরেকে উক্ত উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে তাদেরকে বাধ্য করা হচ্ছে। তিব্বত, মধ্য এশিয়া ও ভারত সম্পর্কিত বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষার সংমিশ্রণের মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গীভূতকরণ চলছে, যাকে বিশেষজ্ঞরা ‘সাংস্কৃতিক গণহত্যা’ বলে অভিহিত করেছেন।
অনুরূপভাবে জুম্ম জনগণের সম্মতি ব্যতিরেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের চিরায়ত জুম ভূমি ও মৌজা ভূমিকে পাইকারীভাবে রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা, অস্থানীয়দের নিকট হাজার হাজার একর জায়গা-জমি ইজারা প্রদান, পর্যটনের নামে জবরদখল, সামরিক কাজের জন্য ব্যাপক ভূমি অধিগ্রহণ, ব্যাপকভাবে পাহাড় কেটে ও বনাঞ্চল ধ্বংস করে রাস্তাঘাট নির্মাণ, প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ধ্বংস করে বনবাগানের মাধ্যমে বনায়ন, স্থল বন্দর স্থাপন ও তদুদ্দেশ্য সংযোগ সড়ক নির্মাণ ইত্যাদি জনসংস্কৃতি-পরিপন্থী, গণবিরোধী ও পরিবেশ-বিধ্বংসী উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে এবং তাদেরকে সেসব উন্নয়ন কার্যক্রমগ্রহণ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও একমাত্র বাংলা ভাষাই সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত ভাষা, যা ভিন্ন ভাষাভাষি জুম্ম জনগোষ্ঠীর উপর আগ্রাসন ত্বরান্বিত করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে লক্ষ লক্ষ মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বসতি প্রদানের মাধ্যমে অমুসলিম অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে পরিণত করা ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত হচ্ছে, যার মূল্য লক্ষ্য হলো জুম্ম জনগণকে জাতিগতভাবে নির্মূল করা।
পাকিস্তান অধিকৃত গিলগিট-বালটিস্তানের জনগণ ১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তান কর্তৃক উস্কে দেয়া গোষ্ঠীগত সংঘাতের মুখোমুখী হয়ে আসছে। শিয়া বিরোধী এধরনের প্রথম গোষ্ঠীগত সংঘাত দেখা দিয়েছিল ১৯৮৮ সালে রমজানের প্রথম চাঁদ দেখাকে কেন্দ্র করে। ২০১২ সালে গোষ্ঠীগত সহিংসতা পুনরায় শুরু হয়েছিল, গিলগিট-বালটিস্তানকে ইসলামাবাদের সাথে সংযোগ স্থাপনকারী তিনটি রুটে শিয়া ভ্রমণকারীদের লক্ষ্য করে সুসংগঠিত হত্যার ফলে আরো তীব্র সংঘাতের সূচনা করে। এতে ৬০ জনের বেশি নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রামেও সত্তর থেকে নব্বই দশকে সেনাবাহিনী ও মুসলিম সেটেলাররা জুম্ম জনগণের উপর কমপক্ষে ১৫টি গণহত্যা সংঘটিত করেছিল, যেখানে কমপক্ষে ২০ হাজার জুম্ম নিহত হয়েছিল, কয়েক শত নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল এবং হাজার হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ায় ১৯৯৭ সালের পরেও নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় মুসলিম সেটেলাররা কমপক্ষে ২০টি সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত করে, যেখানে শত শত ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে জুম্মদেরকে তাদের চিরায়ত ভূমি ও বাস্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ এবং তাদের জায়গা-জমি জবরদখল করা।
এছাড়া পশ্চিম চীনকে পাকিস্তান হয়ে ভারত মহাসাগরের সাথে সংযুক্ত করার উদ্দেশ্যে গৃহীত চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) গিলগিট-বালটিস্তানের ভূখন্ডের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে এবং এতে ৪০০,০০০ এর বেশি আদিবাসী এবং কমপক্ষে ২০০ বর্গকিলোমিটার প্রাকৃতিক পরিবেশকে এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যমন্ডিত স্থানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতি করছে। স্থানীয় জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই প্রকল্পটি জোরপূর্বক বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যারা সিপিইসি’কে তাদের সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামেও ২১৮,০০০ একর ভূমিকে রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা, অস্থানীয়দের নিকট ইজারা প্রদান, পর্যটনের নামে জবরদখল, সামরিক ছাউনি স্থাপন, রাস্তাঘাট ও অবকাঠামো উন্নয়ন, স্থল বন্দর স্থাপন, সীমান্ত ও সংযোগ সড়ক নির্মাণ ইত্যাদি প্রকল্প সরকার সেনাবাহিনীর মাধ্যমে জুম্ম জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক বাস্তবায়ন করছে। এসব উন্নয়নের ফলে জুম্ম জনগণের সংস্কৃতি ও অস্তিত্বকে দ্রুত ধ্বংসের কিনারে নিয়ে যাচ্ছে এবং এতদাঞ্চলের পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্যতার ভারসাম্য দ্রুত গতিতে নষ্ট করে ফেলছে। তাই এসব প্রকল্পকে জুম্ম জনগণের ’মরণ ফাঁদ’ হিসেবে বিবেচনা করছে।
বিগত ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে গিলগিট-বালটিস্তানের জনগণ ধারাবাহিকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে। গিলগিট-বালটিস্তানের লোকেরা সাংবিধানিক সংকটের মধ্যে রয়েছে, যেখানে পাকিস্তান সরকার এই অঞ্চলকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেনি, এমনকি এই অঞ্চলের জনগণকে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার বা রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব কোন অধিকারেরই স্বীকৃতি দেয়নি। গিলগিট-বালটিস্তানের জনগণ চলাফেরার স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার এবং সভা-সমিতির স্বাধীনতা থেকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত।
পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণও পাকিস্তান আমল থেকে বর্তমান বাংলাদেশের শাসনামলে ধারাবাহিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়ে আসছে। পাকিস্তান সরকার যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামকে সাংবিধানিক মর্যাদা দেয়নি, বাংলাদেশ সরকারও পার্বত্য চট্টগ্রামের সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করেনি। অনুরূপভাবে জাতীয় সংসদেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের জন্য আসন সংরক্ষণ করা হয়নি। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি মোতাবেক প্রণীত পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন ১৯৯৮ এবং তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯- এই চারটি আইনকে সংবিধানের প্রথম তফসিলে ‘কার্যকর আইন’ হিসেবে অন্তর্ভুক্তির দাবিকে সরকার প্রত্যাখ্যান করেছিল। বর্তমানে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামীলীগ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যাকে রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের পথ পরিহার করে সামরিকায়নের দমন-পীড়ন ও ডেভেলাপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে সমাধানের পথ বেছে নিয়েছে। ফলে গিলগিট-বালটিস্তানের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামে চলাফেরার স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার এবং সভা-সমিতির স্বাধীনতা রুদ্ধ হয়ে পড়েছে।
বস্তুত গিলগিট-বালটিস্তানের জনগণ যেভাবে পাকিস্তানের কব্জা থেকে মুক্ত হয়ে ভারতে অন্তর্ভুক্ত হতে চায়, তেমনি ১৭ আগস্ট কালো দিবস পালনকালে ভারতের চাকমাসহ অন্যান্য জনগোষ্ঠীও ১৯৪৭ সালের ভারত বিভক্তি আইন মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে দাবি করেছিল।
যাই হোক, পাহাড়ময় পার্বত্য চট্টগ্রাম ও পর্বতময় গিলগিট-বালটিস্তান দেশভাগের সময়কার একটি পূর্ব পাকিস্তানের জবর দখলে, অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তানের জবর দখলে যাওয়া অঞ্চল। কেন জানি আজ দেশভাগের ৭৩ বছর পর পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বালটিস্তান এ দুইয়ের মধ্যে সাদৃশ্য খোঁজার সময় এসেছে।