লিয়ন ত্রিপুরা
স্বাধীন বাংলাদেশের জমানায় গণমাধ্যম কতটা শক্তিশালী, নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশন করেছে তা নিয়ে সবসময় একটা বির্তক রয়েছে। তবে কোন দেশের সংবাদমাধ্যম পুরোপুরি স্বাধীন বা নিরপেক্ষ নয় তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সব দেশের রাষ্ট্র ও সরকার স্বীয় স্বার্থ হাসিল করার জন্য গণমাধ্যম ও সংবাদ মাধ্যমকে ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বরং বাংলাদেশে সরকার ও প্রশাসন বিভিন্ন সময় তার স্বীয় স্বার্থ হাসিল করার জন্য সংবাদ ও গণমাধ্যমকে ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগ উঠেছে বারবার। শুধু তাই নয় সংবাদমাধ্যম যাতে তার স্বাধীন সত্তা নিয়ে সরকারের কাজের সমালোচনা, সরকারের ভুল-ত্রুটি, ব্যর্থতা এবং বিপরীতে জনপ্রতিক্রিয়া তুলে ধরতে না পারে তার জন্য সংবাদমাধ্যমের উপরও একের পর এক কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ হয়েছে নানানভাবে। সেসব হালচাল বুঝার জন্য কোন বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার হয় না।
বর্তমান সরকার তার কাজের সমালোচনা বন্ধ ও মানুষের বাক-স্বাধীনতা হরণ করার জন্য ২০১৮ সালে “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮” নামে একটি আইন জারি করে। যার মাধ্যমে সরকার তার সমালোচনাকারী, ভিন্ন মতাবলম্বী ও বিরোধী শক্তির উপর এক ধরনের স্টিম রোলার চালাচ্ছে। কখনো মামলা দিয়ে, তাতে কাজ না হলে তার সমর্থকদের দিয়ে হামলা, বিচার বিভাগের উপর চাপ প্রয়োগ করে জেল জরিমানা পর্যন্তও করাচ্ছে। এর প্রভাব মুক্তবুদ্ধি চর্চা, বহুমত ও পথের স্রষ্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেও পড়ছে। দলীয় মনোনয়ন পাওয়া শিক্ষকেরা পদ-পদবী লোভের আশায় তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী শিক্ষক নতুবা ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দিচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর পর ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাসকে কেন্দ্র করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক সহ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের উপর স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ঠুকে দিয়েছে। যা পুরোটায় একটা লজ্জাজনক ব্যাপার।
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম বা গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন বা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছে তার একটি চিত্র আমরা দেখি ২০২০ সালে ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস’ নামে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের ১৮০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান গত বছরের তুলনায় এক ধাপ নেমে ১৫১-এ দাঁড়িয়েছে। তার মানে এটা স্পষ্ট, বাংলাদেশে এখন আর আগের মতন স্বাধীন সংবাদমাধ্যম বলতে যা বুঝায় তার ছিটেফোঁটাও নেই। প্রতিবেদনে সংস্থাটি আরও বলেছে, গোটা বিশ্বে দিন দিন স্বাধীন গণমাধ্যমগুলো রাষ্ট্র ও সরকারের চাপে সত্য প্রকাশে সাহস পাচ্ছে না। সত্য প্রকাশ করলে তাদেরকে নানান ধরনের আইন ও মামলায় জড়ানো হয়। যার কারণে গণমাধ্যমের উপর সরকার, রাষ্ট্র, সামরিক ও অসামরিক প্রতিষ্ঠানের প্রভাব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। করোনা ভাইরাসের এ দিনগুলোতেও সংবাদমাধ্যম ও গণমাধ্যমের উপর সরকারি হস্তক্ষেপ ও নিপীড়ন বেড়েই চলেছে। হিসেব বলছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ জারি হওয়ার পর বর্তমান পর্যন্ত ১৮০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অনেকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে সাংবাদিক ছাড়াও আছেন লেখক, কার্টুনিস্ট ও মানবাধিকারকর্মী। এ করোনাকালেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ করোনায় চেয়ে ভয়াবহ আকারে প্রয়োগ হচ্ছে।
জাতীয় পর্যায়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মত প্রকাশে বাধা-নিষেধ
বাংলাদেশের জাতীয় সংবাদমাধ্যম দেশ ও বিদেশে যার বলিষ্ঠ প্রচার সেই প্রথম আলো পত্রিকাকে ‘আদিবাসী’ শব্দ লেখার জন্য বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা ২০১৬ সালে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েছিল পরে বাধ্য হয়ে প্রথম আলো সরকারি শব্দ ‘উপজাতি’, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ লিখেছে। সরকার ২০১৮ সালে প্রজ্ঞাপন জারি করে সকল সংবাদ মাধ্যমকে হুশিয়ারি করেছিল যাতে কেউ আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার না করেন। তদুপুরি কোন কোন সংবাদমাধ্যম আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করছেন। তবে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার করার কারণে তারা যে খুব পার পেয়ে যাচ্ছেন এমনটিও না। তাদেরকেও কঠোর জবাবদিহির মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত আদিবাসীদের উপর সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি বেদখল, নারী-শিশুর উপর ধর্ষণ, হত্যা, খুন ও মানবাধিকার লংঘনের ঘটনাও প্রকাশ পায় না রাষ্ট্রীয় চাপের মুখে। কেননা এসব ঘটনার পশ্চাতে সরকার বা ক্ষমতাসীন দলের কোনো না কোন সংস্থা বা ব্যক্তি জড়িত থাকে। তবে ফেসবুকের কল্যাণে কিছু কিছু ঘটনার খবর জানা গেলেও বেশিরভাগ ঘটনা দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর কাছে অজানা থেকে যায়।
◐ বাংলাদেশে ১/১১-এর সময়কালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীদের চরিত্র হনন ও নির্যাতনের নীতি গ্রহণ করে। এমনকি সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী একাধিক সংবাপত্রকে বিশেষ বিশেষ রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অপরীক্ষিত বা অপ্রমাণিত সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করতে বাধ্য করেছিল।◐
দ্বিতীয় উদাহরণ, বাংলাদেশে ১/১১-এর সময়কালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশের রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীদের চরিত্র হনন ও নির্যাতনের নীতি গ্রহণ করে। এমনকি সামরিক গোয়েন্দা বাহিনী একাধিক সংবাপত্রকে বিশেষ বিশেষ রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অপরীক্ষিত বা অপ্রমাণিত সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করতে বাধ্য করেছিল। ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম তা স্বীকারও করেছেন। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান নিজ নামে ‘দুই নেত্রীকে যেতে হবে’ শিরোনামে মন্তব্য প্রতিবেদন প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সে ঘটনা নিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এলে অনেকবার লেখালেখিও হয়েছে। বাংলাদেশে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সেনাবাহিনীর একাংশের ভূমিকা নিয়ে টিআইবি ২০১৩ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।
নেত্র নিউজের (২৪ জুলাই ২০২০) এক প্রতিবেদনে জানা যায় যে, “জেনারেল আজিজ যেদিন সেনাপ্রধান নিযুক্ত হন, সেদিন জনপ্রিয় নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ২৪.কম একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি প্রথম যেভাবে প্রকাশিত হয় তাতে লেখা হয়েছিল “[আজিজের] নাম সম্প্রতি মিডিয়ায় এসেছে তার ছোট ভাই তোফায়েল আহমেদ জোসেফ এর জেরে, যিনি ৯০ এর দশকে সন্ত্রাসী হিসেবে কুখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন এবং যার মৃত্যুদন্ড লাঘব করা হয় ও শেষপর্যন্ত রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেয়ে তিনি কারাবাস থেকে মুক্তি লাভ করেন। ডিজিএফআইয়ের নির্দেশে, বিটিআরসি বিডিনিউজের ওয়েবসাইটটি তৎক্ষণাৎ বন্ধের আদেশ দেয়। প্রতিবেদনের এই লেখাগুলো মুছে দিলে কয়েক ঘন্টা পর আবার সাইট খুলে দেয়া হয়।” নেত্রনিউজে আরো বলা হয় যে, “এটা সহজেই অনুমেয় যে বাংলাদেশে কোন সম্পাদক সেনাবাহিনীকে রাগিয়ে তুলতে পারে এমন কিছু প্রকাশে কতখানি অপারগ।”
টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৭ সালের এগারোই জানুয়ারির পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু’বছরের শাসনামলে সশস্ত্র বাহিনীর একাংশ ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল অর্থ ও সম্পদ অর্জন করে এবং গণমাধ্যমের ওপরও তারা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। এ তথ্য থেকে বাংলদেশের গণমাধ্যমের উপর সেনাবাহিনীর প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। যার অর্থ হল, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম নানান সময়ে বিভিন্ন সরকার, সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক ব্যবহৃত হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, সাংবাদিকরা আত্ম-নিয়ন্ত্রণ (self-censor) অথবা গ্রেফতারের ঝুঁকি নেয়ার মতো চাপের মুখে পড়েন। ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার “পর্নগ্রাফি বিরোধী অভিযানের” নামে প্রায় ২০,০০০ ওয়েবসাইট ব্লক করে। এই ওয়েবসাইটগুলোর মধ্যে বেশ কিছু জনপ্রিয় ব্লগও রয়েছে। মার্চ মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা উপদেষ্টার বিষয়ে কিছু অভিযোগ সংবলিত প্রতিবেদন প্রকাশ করায় ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেল আল জাজিরার ইংরেজি নিউজ ওয়েবসাইট ব্লক করে দেয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআইয়ের সেন্সরশীপ
পার্বত্য চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলাদেশের এক-দশমাংশ জায়গা জুড়ে অবস্থিত। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হয়। এই সংবিধানে পার্বত্যবাসীদের অস্তিত্ব সংরক্ষণার্থে একটা গণতান্ত্রিক বিশেষ শাসনব্যবস্থার দাবি উত্থাপন করা হয়। ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতৃবৃন্দ পার্বত্য অঞ্চলের স্বতন্ত্র শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস, জাতীয় পরিচিতি এবং অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকারের নিকট আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে ধরেন। কিন্তু জুম্ম জনগণের প্রবল দাবি সত্ত্বেও এ দাবি উপেক্ষিত ও প্রত্যাখ্যান করা হয়। অপরদিকে পার্বত্যবাসীদের এই দাবি পূরণের পরিবর্তে সরকার একের পর এক দমন নীতি গ্রহণ করতে থাকে। এ উদ্দেশ্যে ১৯৭৩ সালে দীঘিনালা, আলিকদম ও রুমায় তিনটি সেনানিবাস স্থাপন করা হয়। সেসময় সমগ্র পার্বত্য অঞ্চলে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়। জুম্ম জনগণকে সাংবিধানিকভাবে বাঙালি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। শুরু হয় রাজাকার-মুজাহিদ দমনের নামে নিরীহ নিরপরাধ সাধারণ জনগণের উপর নানাবিধ অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতন।
১৯৭৫ সালে সামরিক শাসন জারি করা হলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আন্দোলনের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে জুম্ম জনগণের উপর সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর অভিযান ও নির্যাতন জোরদার হয়ে উঠে। জুম্ম জনগণের জাতীয় অস্তিত্ব ও ভূমির অধিকার সংরক্ষণের লক্ষ্যে ও আত্মরক্ষার্থে জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে জুম্ম জনগণকে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হয়। শান্তিবাহিনী দমনের নামে ১৯৮০ সালে অপারেশন দাবানল নামে সেনা অভিযান জোরদার করা হয়, ২০০১ সালে যার নাম পরিবর্তন করে ‘অপারেশন উত্তরণ’ করা হয়। একটি তথ্য বলছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতি ৭ জন জুম্মর বিপরীতে সেনাবাহিনীর একজন সদস্য মোতায়েন করা হয়। দুই দশকের বেশি সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে জুম্ম জনগণের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামের পর ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের পর বিগত ২৩ বছরে ৭২ টি ধারার মধ্যে এপর্যন্ত মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বাকি দুই তৃতীয়াংশ ধারা এখনো অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অবাস্তবায়িত মৌলিক বিষয়সমূহের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে আইনী ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা; পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদে সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি ব্যবস্থাাপনা, বন ও পরিবেশ, পর্যটন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ইত্যাদিসহ রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও কার্যাবলী হস্তান্তর করা; নির্বাচন বিধিমালা ও ভোটার তালিকা বিধিমালা প্রণয়ন পূর্বক তিন পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা; ‘অপারেশন উত্তরণ’ নামক একপ্রকার সেনাশাসনসহ সকল অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার করা; ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে বেহাত হওয়া জুম্মদের জায়গা-জমি ফেরত দেয়া; ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের তাদের স্ব স্ব জায়গা-জমি প্রত্যার্পণ পূর্বক পুনর্বাসন প্রদান করা; অস্থানীয়দের প্রদত্ত ভূমি ইজারা বাতিলকরণ; পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকরিতে জুম্মদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ করা; চুক্তির সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে পুলিশ এ্যাক্ট, পুলিশ রেগুলেশন ও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য অন্যান্য আইন সংশোধন; পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সেটেলার বাঙালিদের সম্মানজনক পুনর্বাসন করা ইত্যাদি অন্যতম।
একদিকে সরকার চুক্তি বাস্তবায়ন করছে না, অন্যদিকে পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী প্রণীত আইন লঙ্ঘন করে ডিসি-এসপিসহ জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর মাধ্যমে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। পার্বত্য চুক্তি মোতাবেক কেবল ছয়টি ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া সকল অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করার বিধান থাকলেও বাস্তবে সরকার একের পর এক নতুন সেনা ক্যাম্প স্থাপন করে চলেছে।
❝প্রতিবেদনে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর পরেও এই অঞ্চলটি সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে রয়েছে এবং আদিবাসী অধিকারকর্মীদের গ্রেফতার, জোরপূর্বক অন্তর্ধান ও নির্যাতনের হুমকি দেয়া হচ্ছে।❞
মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি সেনাশাসনের অধীনে রেখে সরকার তথা শাসকগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামকে ইসলামিকীকরণ ও সামরিকীকরণে একটি হীন স্বার্থে লিপ্ত হয়েছে। ৮ জুলাই ২০২০ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সারাবিশ্বের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২০ বছর পরেও এই অঞ্চলটি সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে রয়েছে এবং আদিবাসী অধিকারকর্মীদের গ্রেফতার, জোরপূর্বক অন্তর্ধান ও নির্যাতনের হুমকি দেয়া হচ্ছে। এদিকে ১ জুলাই খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়ি থেকে রাতের আঁধারে ৩ জন নিরীহ জুম্মকে এবং ১৪ জুলাই একজনকে দিনের বেলায়, আরেক জনকে রাতের বেলায় রাঙ্গামাটি জেলা শহরের দুই ভিন্ন স্থান থেকে দুই জুম্মকে গোয়েন্দা ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে যায়।
একদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হাওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামে এক অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃবৃন্দসহ অধিকারকামী সংগঠন ও ব্যক্তির উপরে মিথ্যা মামলা চাপিয়ে দিয়ে এলাকা ছাড়া করা হয়েছে। আর এরই সুযোগে নির্বিবাদে চলছে জুম্মদের মালিকানাধীন পাহাড়-বন, ঝিড়ি থেকে পাথর উত্তোলন, জুম্ম নারী ধর্ষণ, হত্যা, ভূমি-জায়গা দখলের কার্যক্রম। এসব ঘটনায় সেনা ও পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা সবসময় প্রশ্নসাপেক্ষ। সত্য হল, এসব ঘটনা দেশের কোন সংবাদমাধ্যমে কিংবা খবরের কাগজে আসে না বললেই চলে। কেননা এসব ঘটনার মূল হোতা বা পরিকল্পনায় থাকে সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। তারাই এসবের পিছনের কলকাঠি নাড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাসমূহ টিভি মিডিয়া কিংবা সংবাদ মাধমে না আসার পেছনে সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃত্বের ইতিহাস আশির দশক থেকে। যখন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির নেতৃত্বে প্রতিরোধ সংগ্রাম চলছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামে কি চলে, কি চলে না সেসব খবর জানার জন্য বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের কোন উপায় ছিল না। সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকার যা যা বলে তাই তারা জানত। প্রকৃতপক্ষে সেসব খবর ছিল বানোয়াট, সাজানো ও মনগড়া সরকারি রিপোর্ট।
পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে জুম্ম জনগণকে নিশ্চিহ্ন ও সংখ্যালঘুতে পরিণত করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি-পূর্ব সময়ে সেনা, ভিডিপি ও বহিরাগত সেটেলাররা সম্মিলিতভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগণের উপর ১৫টির অধিক গণহত্যা সংঘটিত করে। এসব ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের সবসময় বয়ান ছিল সেটেলারদের গণহত্যা চালাতে তাদের পাশে সবসময় সেনাবাহিনী ও বিডিপিকে দেখা যেত। তারাই প্রথমে হামলা করে তারপর সেটেলাররা হামলা চালায়। এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য উদাহরণ, ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ কাউখালী কলমপতি গণহত্যা। এদিন সেনা কর্মকর্তারা বৌদ্ধ বিহার সংস্কারের জন্য পাহাড়িদের ডেকে এনে নৃশংসভাবে ব্রাশ ফায়ার করে এবং সেটলারদের লেলিয়ে দেয়। সেনা ও সেটলারের হামলায় এ হত্যাকান্ডে ৩০০-এর অধিক নিরীহ জুম্ম প্রাণ হারায়। এসব গণহত্যাসমূহের কিছু কিছু তদন্ত হলেও তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি। বাকি গণহত্যাগুলো কালের পরিক্রমায় অতল গহ্বরে হারিয়ে দেয়া হয়েছে। অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়নি। এসব ঘটনাসমূহ তৎকালীন কোন পত্রিকা কিংবা খবরের কাগজেও আসেনি। সাংবাদিকদের সবসময় সেনা নজরদারিতে রাখা হত যাতে তারা কোন ভুক্তভোগী পাহাড়ির সাথে আলাপ করতে না পারেন। প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরতে না পারেন।
১৯৯৬ সালে ১২ জুন রাতের আঁধারে তৎকালীন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমাকে অপহরণের ঘটনায় অপহরণকারী লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস, ভিডিপি সদস্য নুরুল হক ও সালেহ আহমেদকে আসামী করে স্থানীয় বাঘাইছড়ি থানায় মালা দায়ের করা হয়। রাতের আঁধারে কল্পনা অপহরণের ঘটনাও সে সময়ে কোন খবরের কাগজে আসেনি। কার্যত পিসিপি কর্মীদের অব্যাহত তৎপরতা ও আন্দোলনের পর ধীরে ধীরে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনা জানতে পারে। কল্পনা চাকমার সন্ধান চেয়ে এ্যামনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এর মতন বিদেশী মানবাধিকার সংস্থাসহ দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন তুললেও অভিযুক্ত প্রধান আসামী লেঃ ফেরদৌস সামরিক বাহিনীর সদস্য হবার কারণে তথা রাষ্ট্রক্ষমতার জোরেই অপরাধীর কোন বিচার হয়নি, এমন অভিযুক্ত লেঃ ফেরদৌস মেজর পদোন্নতি লাভ করে সিলেটের এক সেনানিবাসে কমর্রত থাকার কথাও জানা যায়। ২৪ বছর পার হয়ে গেলেও কল্পনা চাকমার সন্ধান রাষ্ট্র এখনো দিতে পারেনি।
১৬ আগস্ট ২০১৫-তে ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলো একটি খবর প্রকাশ করে যে পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর হাতে ৫ জন নিহত হয়েছে। ডেইলি স্টার এর শিরোনাম ছিল: “গানফাইট ইন হিলস: ফাইভ কিল্ড বাই আর্মি” (পাহাড়ে বন্দুকযুদ্ধ: আর্মির হাতে নিহত পাঁচ)। প্রতিবেদনে বলা হয়: “গতকাল সকালের দিকে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি এলাকায় পাঁচজন আদিবাসী তরুণ সেনাবাহিনীর সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছে।”
এতে সেনাবাহিনী ক্রুদ্ধ হয়। তবে সেনাবাহিনীর হাতে পাঁচজন নিহত হয়েছে সে খবর প্রকাশে নয়, বরং প্রতিবেদনে “আদিবাসী” শব্দটি ব্যবহারের কারণে, এবং নিহত তরুণদের পরিচয় “সন্ত্রাসী” হিসেবে না দেবার কারণে। সেনাবাহিনীর মিডিয়া বিভাগ আইএসপিআর পত্রিকা দুটির সাথে এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে সম্পাদকদ্বয় কথা দেন পরের দিন প্রতিবেদনে প্রয়োজনীয় সংশোধনসহ প্রকাশ করা হবে। এবং সংশোধিত খবর প্রকাশ করতে বাধ্য হন।
❒ সেনাসদস্যদের নির্যাতনে রমেল চাকমার মৃত্যুর ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি সত্যতা পেলেও অভিযুক্ত ক্যাপ্টেন তানভীর ও অভিযুক্ত সেনা সদস্যদের উপর কোন আইনী ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।❒
২০১৭ সালে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এইচএসসি পরিক্ষার্থী রমেল চাকমাকে ক্যাপ্টেন তানভীরের নেতৃত্বে একদল সেনাবাহিনী নানিয়াচরে ট্রাক পোড়ানো মামলার আসামী সাজিয়ে গ্রেফতার করে অমানবিক নির্যাতন করে মেরে ফেলে। সেনাবাহিনীর কাছে মামলার আসামী থাকলেও পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী ট্রাক পোড়ানো মামলায় রমেলের নাম ছিল না। এঘটনায় রমেলকে আটকের কথা স্বীকার করলেও সেনাবাহিনী মেরে ফেলার কথা অস্বীকার করে। বিচার-বহির্ভূত রমেল হত্যার বিচার চেয়ে এলাকাবাসী অবরোধও পালন করেছিল। সেনাসদস্যদের নির্যাতনে রমেল চাকমার মৃত্যুর ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত কমিটি সত্যতা পেলেও অভিযুক্ত ক্যাপ্টেন তানভীর ও অভিযুক্ত সেনা সদস্যদের উপর কোন আইনী ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
২০১৭ সালে সেনা ও পুলিশের সামনে লংগদুতে সেটেলাররা আদিবাসী জুম্মদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটসহ সংঘবদ্ধ সাম্প্রদায়িক হামলা চালায়। এ হামলায় প্রায় ২৫০টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত হয়। তিনটিলা এলাকায় গুণমালা চাকমা নামে ৭৫ বছরের এক বৃদ্ধা জীবন্ত আগুনে পুড়ে মারা যান। এ ক্ষেত্রেও সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থার চাপে সাম্প্রদায়িক হামলার প্রকৃত ঘটনা তুলে না ধরে অসত্য ও মনগড়া সংবাদ প্রচার ও প্রকাশ করতে হয়েছিল। ঘটনার তিন বছর পার হলেও এখনো প্রকৃত দোষীদের শাস্তি দেয়া হয়নি। ভুক্তভোগীদর অনেকে এখনো খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে।
২০১৮ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে বিলাইছড়িতে সেনাবাহিনী কর্তৃক দুই মারমা তরুণী ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির ঘটনা মূলধারা খবরের কাগজে আসেনি। খবর আটকে রেখেছিল সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা। ফেসবুকের মাধ্যমে ঘটনা জানাজানি হবার ফলে ঘটনার অনেকদিন পর পত্রিকা ও টিভি মিডিয়ায় খবর আসে। তাও অভিযোগ পাওয়া গেছে মর্মে পত্রিকা কিংবা টিভিতে খবর প্রচার করতে বাধ্য করা হয়। তবে ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্য সেনাবাহিনী রাসেল মারমা নামে একজন ভাড়াটে দালালকে দিয়ে একটি মিথ্যা ও মনগড়া সংবাদ সম্মেলন করেছিল। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ শেষে উপস্থিত সাংবাদিকরা মেয়েটির ছোটভাইকে সেদিন কী দেখেছে জিজ্ঞেস করলে, ছেলেটি মাতৃভাষায় সেনাবাহিনীর পোশাক পরা বাঙালি দেখেছে বলে জানায়। বলাবাহুল্য, ধর্ষণকারী ও শ্লীলতাহানীকারী দুই সেনা সদস্যেরও কোন বিচার হয়নি।
একই বছর আলিকদমের বিজিবি সদস্য কর্তৃক দুই ত্রিপুরা কিশোরিকে ধর্ষণের ঘটনাও দুই একটি পত্রিকায় আসলেও বেশিরভাগ খবরে কাগজে কোন খবর হিসেবে স্থান পায়নি। এ খবরটিও যাতে কোন পত্রিকায় না আসে সেজন্য বিজিবি সদস্য ও গোয়েন্দারা বেশ তৎপর ছিল। ভুক্তভোগীরা বান্দরবান পুলিশ সুপারের নিকট ধর্ষণের ঘটনা স্বীকার করলেও বিজিবি সদস্যদের কোন ধরনের আইনের আওতায় আনা হয়নি। উপজেলা নির্বাহী অফিসার কর্তৃক গ্রামে প্রবেশের অনুমতি থাকা সত্ত্বেও ঘটনার তদন্ত করতে যাওয়া নাগরিক টিমকেও সেনাবাহিনী কর্তৃক গ্রামে ঢুকতে বাধা প্রদান করা হয়েছিল। এ ঘটনাটি পরে ধামাচাপা পড়ে।
আগস্টের ২১ তারিখ ২০১৯ সালে সংবাদে ‘Indigenous’ বা ‘আদিবাসী’ শব্দ ব্যবহার করায় ডেইলি স্টার পত্রিকার বান্দরবান জেলা প্রতিনিধি সঞ্জয় কুমার বড়ুয়াকে আসামি করে খাগড়াছড়ি পৌরসভার ২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো: মাছুম রানা খাগড়াছড়ি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (আমলি) আদালতে মামলা দায়ের করেন। এতেও সেনা ও গোয়েন্দাবাহিনীর একটা ইন্ধনের গন্ধ পাওয়া যায়। কেননা বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পত্রিকা ডেইলি স্টার পত্রিকার সাংবাদিক সঞ্জয় কুমার বড়ুয়া বহু বছর যাবৎ ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার পত্রিকায় ইংরেজিতে আদিবাসী শব্দ লিখে আসছেন। এত বছর কারোর কোন মাথা ব্যাথা না থাকলেও এক সেটেলার উড়ে এসে জুড়ে বসে মামলা ঠুকে দিয়েছে। পরে আদালত অবশ্যই সাংবাদিকের পক্ষে রায় দেন যে, আদিবাসী শব্দটির সাথে দেশের স্বাধীন সার্বভৌমত্বের কোন প্রশ্ন জড়িত নেই এবং আদিবাসী শব্দটি ব্যবহারে সংবিধানে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই।
আরেকটি সবচেয়ে বড় আলোচিত তথ্য হল, মুক্তিপণ বাণিজ্যের সাথে সেনা ও গোয়েন্দাবাহিনীর যোগসূত্রতা। খবর নিয়ে জানা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকারকামীদের উপর মিথ্যা মামলা পরবর্তী জামিনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তারা গোপনে কোন কোন জামিন প্রার্থীদের কাছে যোগাযোগ করে টাকা আদায় করে। নতুবা কেউ টাকা দিতে অস্বীকৃতি বা অপারগতা প্রকাশ করলে জামিনের পর তাকে জেল ফটক থেকে আবারো গ্রেফতার করে হয়। ফলে অনেকে সহায় সম্পত্তি বিক্রির বিনিময়ে হলেও সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থার কাছে টাকা দিতে বাধ্য হন। এ ধরনের অনেক ঘটনার অভিযোগ আছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির তথ্য ও প্রচার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বরের চুক্তির পর ২০টির অধিক সেটেলার কর্তৃক জুম্মদের উপরে ব্যাপক আকারে সাম্প্রদায়িক হামলা ঘটে। এখানেও সবসময় অপরাধীদের পার পাইয়ে দিতে সেনা-গোয়েন্দা সংস্থাদের প্রভাব দেখা যেত। তার কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত তথাকথিত আইন-শৃংখলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থারা সবই নিয়ন্ত্রণ করে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক সাংবাদিক মুখোমুখি আলাপে এসব কথা স্বীকার করেছেন। কোন সংবাদমাধ্যম সংবাদ পরিবেশন করলেও তা কেবলই সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষের হয়ে সংবাদ প্রচারণা করতে হত। যেটুকু প্রচারণা হত সেখানেও প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করা হয়। অন্য কোন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত নতুবা সংগঠনের কর্মীকে জড়ানো হয়। খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, সেনা ও গোয়েন্দারা এখন পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের অর্থায়নে কিছু ভূঁইফোড় অনলাইন সংবাদমাধ্যম চালু করেছে। এসব সংবাদ মাধ্যমের আদৌ কোন নিজস্ব সংবাদ কর্মী নেই। তবে তাদের সব খবরের যোগানদাতা সেনা ও গোয়েন্দারা। তাদের পক্ষ হয়ে সংবাদ পরিবেশন করা। তাদের দেয়া মিথ্যা ও অপপ্রচারমূলক সংবাদ প্রচার করা। তার জন্য এসব সংবাদ মাধ্যমকে মাসে মাসে সেনাবাহিনী থেকে কিছু অর্থ দেয়া হয় বলে একটি গোপন সূত্র বিষয়টা নিশ্চিত করেছে।
সময় গড়িয়েছে, যুগ বদলেছে কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা এখনো আগের মতনই রয়ে গেছে। যে সরকারের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সে সরকার টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় এলেও চুক্তি বাস্তবায়নে তার কোন আগ্রহ চোখে পড়ে না, উল্টো স্বৈরশাসকদের মতো দমন-পীড়নের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের তৎপরতা জোরদার করেছে। একপ্রকার রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সকল পথ ।
সাম্প্রতিক সময়ে তার চিত্র আরও বেশি দৃশ্যমান হয় শান্তির লক্ষে চুক্তি স্বাক্ষরকারী পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কর্তৃক জানুয়ারি থেকে জুন ২০২০ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে। সেখানে তারা সরকারকে অভিযোগ করে বলেছেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা, পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা, সর্বোপরি পার্বত্য চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী কার্যক্রম নির্বিঘ্নে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে আন্দোলনরত জুম্মদেরকে ক্রিমিলাইজেশনের অংশ হিসেবে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বিগত ছয় মাসে সেনাবাহিনী, বিজিবি, গোয়েন্দা বাহিনী ও পুলিশ কর্তৃক ৭২টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এই ৭২টি ঘটনায় ২ জনকে বিচার বহির্ভূত হত্যা, ২৭ জনকে অবৈধ গ্রেফতার, ৮ জনকে সাময়িক আটক, ২২ জনকে শারীরিক নির্যাতন ও হয়রানি, ৫৩টি বাড়ি তল্লাসী, ৩টি নতুন ক্যাম্প স্থাপন, সেনাবাহিনীর উন্নয়নে ১৬৭ পরিবার ক্ষতির মুখে পতিত হওয়ার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে ও পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে জানুয়ারি-জুন ২০২০-এর মধ্যে সেনাবাহিনী রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলার বিভিন্ন স্থানে সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজির কর্মকান্ড বিস্তারে প্রত্যক্ষ ও উলঙ্গভাবে সহায়তা প্রদান করেছে।
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত ৭২টি ঘটনার কোনটির খবর কোন সংবাদমাধ্যমে আসেনি। কতিপয় ঘটনায় খবর সংবাদমাধ্যমে আসলেও তা বিকৃতভাবে এবং পক্ষপাতদৃষ্ট। ২০২০ সালে জানুয়ারি থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি প্রত্যেক মাসের শেষে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর মাসিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে এবং জাতীয় ও স্থানীয় সংবাদপত্র, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এবং অনলাইন নিউজপোর্টালে ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠিয়ে থাকে। কিন্তু সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর চাপের কারণে কোন সংবাদমাধ্যমে সশস্ত্রবাহিনী কর্তৃক সেসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় না। কদাষিৎ প্রকাশ করা হলেও তা বিকৃত ও খন্ডিত আকারে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। যেমন ইংরেজী দৈনিক ‘নিউ এজ’কে একটি সাহসী পত্রিকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ১/১১-এর পর দেশে জরুরী অবস্থা চলাকালে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে পত্রিকা সম্পাদক নুরুল কবীর ছিলেন খুবই সোচ্চার। সেই পত্রিকায় জনসংহতি সমিতির এপ্রিল মাসের প্রতিবেদন প্রকাশ করে সেনাবাহিনী কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলী সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে।
❑ নিউ এজ পত্রিকায় ২ মে ২০২০ তারিখে ‘3 killed in Chittagong Hills Tracts in April’ শীর্ষক সংবাদে কেবল “সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্তৃক ৩ জনকে গুলি করে হত্যা এবং একজন ছাত্রসহ ৪ জনকে অপহরণ ও মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা” প্রকাশ করে। “সেনাবাহিনী ও বিজিবি কর্তৃক ৭ জনকে আটক, ১৩ জনকে মারধর ও হয়রানি, ৮ জনকে সাময়িক আটক, ১৩টি বাড়ি তল্লাসীর ঘটনাবলী’ সম্পূর্ণ চেপে যায়।❒
জনসংহতি সমিতির এপ্রিল মাসের প্রতিবেদনে বলা হয় যে, সেনাবাহিনী ও বিজিবি কর্তৃক ৭ জনকে আটক, ১৩ জনকে মারধর ও হয়রানি, ৮ জনকে সাময়িক আটক, ১৩টি বাড়ি তল্লাসী ও ত্রাস সৃষ্টির লক্ষ্যে একবার ব্লাঙ্ক ফায়ার, হাসপাতালে নেয়ার পথে সেনাবাহিনী কর্তৃক তল্লাসীর নামে পৌনে একঘন্টা আটকে রাখায় একজন গর্ভবতী নারীর মৃত্যুর ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। অপরদিকে সেনা-সমর্থিত সংস্কারপন্থী ও ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্তৃক ৩ জনকে গুলি করে হত্যা এবং একজন ছাত্রসহ ৪ জনকে অপহরণ ও মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বলে প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়। কিন্তু নিউ এজ পত্রিকায় ২ মে ২০২০ তারিখে ‘3 killed in Chittagong Hills Tracts in April’ শীর্ষক সংবাদে কেবল “সশস্ত্র সন্ত্রাসী কর্তৃক ৩ জনকে গুলি করে হত্যা এবং একজন ছাত্রসহ ৪ জনকে অপহরণ ও মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা” প্রকাশ করে। “সেনাবাহিনী ও বিজিবি কর্তৃক ৭ জনকে আটক, ১৩ জনকে মারধর ও হয়রানি, ৮ জনকে সাময়িক আটক, ১৩টি বাড়ি তল্লাসীর ঘটনাবলী’ সম্পূর্ণ চেপে যায়। সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর হয়রানি ও দমন-পীড়নের ভয়েই নিউ এজ এভাবে নিউজটি প্রচার করেছিল বলে নি:সন্দেহে বিবেচনা করা যায়।
গত ১০ জুলাই ২০২০ সেনাবাহিনীর গুলিতে শান্তিলতা তঞ্চঙ্গ্যা নামে এক জুম্ম নিহত ও তার ছেলে আহত হওয়ার ঘটনায়ও সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দাদের মনগড়া দেয়া তথ্য সন্ত্রাসীদের সাথে সেনাবাহিনীর গোলাগুলিতে এক গৃহবধু নিহত শিরোনামে সারাদেশের সংবাদ মাধ্যমে প্রচার করতে বাধ্য করা হয়েছিল। অথচ স্থানীয়দের আলাপে জানা যায়, দুই ঘটনায় কোন গোলাগুলির ঘটনা ঘটেনি। একটি ঘটনা দলের আভ্যন্তরীণ কোন্দলে ৬ জন নিহত হন। আরেকটি ঘটনায় সেনাবাহিনীরাই ইচ্ছাকৃতভাবে জনমনে ভয় সৃষ্টি করার জন্য ১০ জুলাই সন্ধ্যা ৭টার দিকে গুলি ছোড়ে শান্তিলতাকে হত্যা করে।
অন্যদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ‘হিল ভয়েস” নামে একটি অনলাইন নিউজপোর্টাল পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগণের উপর সেনা-সেটেলার ও গোয়েন্দাবাহিনীর অমানবিক নির্যাতন, অবৈধ গ্রেফতার, ঘরবাড়ি তল্লাসী, দমন-পীড়নের ঘটনা, ভূমি বেদখল, হত্যা-লুন্ঠন, জুম্ম নারীদের উপর ধর্ষণ, হত্যার ঘটনা নি:সংকোচে ও নির্ভয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরছে। গত ১৬ এপ্রিল ২০২০ থেকে সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার হিল ভয়েসকে বাংলাদেশে ব্লক করে দেয়া হয়েছে। তবে বাংলাদেশের অধিকাংশ পাঠক কম্পিউটারে ও মোবাইল ফোনে ইনষ্টল করে ভিপিএন (https://protonvpn.com)-এর মাধ্যমে “হিল ভয়েস” অনলাইন নিউজপোর্টালটি ভিডিজ করে থাকেন।
গত জুলাইয়ের শেষান্তে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনায় ডিজিএফআইয়ের একটি গোপন তদন্ত প্রতিবেদনে কক্সবাজারের পুলিশের বিরুদ্ধে সন্দেহভাজন অপরাধীদের বিচার-বহির্ভূত হত্যাকান্ডের অভিযোগ এনেছে (নেত্রনিউজ.কম, ২ আগস্ট ২০২০)। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বাধীন র্যাব কর্তৃক ক্রশফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের নামে দেশে হাজার হাজার লোক বিচার-বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হলেও সেসব ঘটনা বিষয়ে ডিজিএফআইকে সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। বরঞ্চ সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই নানা অজুহাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন দিয়ে এসেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বয়ং সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই এ ধরনের বিচার-বহির্ভূত হত্যাকান্ডের অসংখ্য ঘটনা ঘটিয়েছে। অথচ সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর এই নৃশংস হত্যাকান্ডের শিকার হওয়াতে সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই সোচ্চার হয়েছে!
পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্রবাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন তথা দমন-পীড়নের ঘটনাবলীর সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআইয়ের সেন্সর তো রয়েছেই, উপরন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে কতিপয় সংবাদমাধ্যমের সেল্ফ-সেন্সরশীপও কাজ করে। তাই সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তথা মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সারাদেশের তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে দ্বিগুণ সেন্সরশীপ বা বাধা-নিষেধের মুখোমুখী হয়। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতনের বিষয়টি কেবল দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো এড়িয়ে যায় না, দেশের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ, এমনকি মানবাধিকার সংগঠনগুলোও দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যায়। এভাবে আজ দেশের সেনাবাহিনী ও ডিজিএফআই দেশবাসী ও বিশ্ববাসীকে আড়ালে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামে মানবতা বিরোধী দমন-পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে।
গণমাধ্যম সমাজ জীবনের দর্পণ স্বরূপ এবং আধুনিক যুগে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম অঙ্গে পরিণত হয়েছে। এটি এখন আমাদের জীবনের, সমাজের একটি অংশ। বলা যায় গণমানুষের সারথি স্বরূপ। গণমাধ্যমের কাজ রাষ্ট্রের মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, যন্ত্রণা, হতাশা, দুর্দশা, অসাম্য প্রভৃতি বিষয় তুলে ধরে সমাধানের পথ ত্বরান্বিত করা; সরকার ও রাষ্ট্রের ভালো মন্দের দিক তুলে ধরা, সমালোচনা করা, জনমত গঠনে ভূমিকা পালন করা; সরকার ও রাষ্ট্রের কার্যাবলির উপর জনমত কী সেগুলো তুলে ধরা ইত্যাদি। মূলত স্বাধীন ও আত্মনিয়ন্ত্রিত হয়ে সততা, বস্তুনিষ্ঠতা, ভারসাম্য ও উচ্চমানের পেশাদারিত্বের মাধ্যমে সঠিক ও নির্ভুল তথ্য দেয়া গণমাধ্যমের অন্যতম দায়িত্ব। সে দায়বোধের জায়গা থেকে পার্বত্য চটগ্রামের চলমান কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য গণমাধ্যম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারত। সে ধরনের উদ্যোগও চোখে পড়ে না। পার্বত্য চট্টগ্রামে গণমাধ্যম তো সেনাবাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় চলে। সুতরাং এদের দ্বারা নিরপেক্ষ সংবাদ ও সংকট নিরসনে সরকার কী কী ভূমিকা নিতে পারে সেসব আশা করা যায় না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মূল গণমাধ্যমের বড় একটা ভূমিকা পালনের সুযোগ থাকলেও তারাও সরকার, গোয়েন্দা ও সেনাবাহিনীর ভয়ে সে ভূমিকা পালন করছে না। গণমাধ্যম যদি সে কাজটি করতে না পারে, সাহস রেখে জনগণের কাছে অজানা খবর জানাতে না পারে তাহলে তো গণমাধ্যমে তার সৃষ্টির চেতনার সাথে প্রতারণা করা সামিল।