হিল ভয়েস, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০: নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আগামীকাল ১৫ সেপ্টেম্বর জুম্ম জনগণের জাতীয় জাগরণের অগ্রদূত, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা, সাবেক সাংসদ, মহান বিপ্লবী নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার (এম এন লারমা) ৮১তম জন্মদিবস পালন করা হবে।
অনলাইন নিউজপোর্টাল ‘হিল ভয়েস’-এর উদ্যোগে মহান নেতা এম এন লারমার ৮১তম জন্মদিবস উপলক্ষ্যে ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ মঙ্গলবার বিশেষ প্রকাশনা বের করা হবে। বিশেষ প্রকাশনায় এম এন লারমার বড় বোন ও সংগ্রামী নেত্রী জ্যোতি প্রভা লারমা, জনসংহতি সমিতির সহ তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)-এর সাবেক সভাপতি ও বিশিষ্ট লেখক বাচ্চু চাকমা, পিসিপির নিপন ত্রিপুরা ও মিতুল চাকমা বিশাল প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের লেখা থাকবে।
বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ সকাল ১১:০০ ঘটিকায় অনলাইন আলোচনা আয়োজনের পরিকল্পনা নিয়েছে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রংয়ের সভাপতিত্বে ও ফোরামের সহ সাংগঠনিক সম্পাদক হরেন্দ্র নাথ সিংয়ের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিতব্য উক্ত অনলাইন আলোচনায় প্যানেল আলোচক হিসেবে থাকবেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক শাহ আলম, সাংবাদিক ও লেখক আবু সাইদ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মেসবাহ কামাল, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস, নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. জোবাইদা নাসরীন কনা, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য মেইনথিন প্রমীলা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। আইপিনিউজ ফেসবুক পেইজ (https://www.facebook.com/ipnewsbd/) থেকে উক্ত অনলাইন আলোচনা সরাসরি প্রচার করা হবে।
সামাজিক দূরত্ব ও কোভিড-১৯ বিধিবিধান মেনে মহান বিপ্লবী নেতা এম এন লারমার ৮১তম জন্মদিবস উপলক্ষে ১৫ সেপ্টেম্বর বিকাল ৪:০০ ঘটিকায় রাঙ্গামাটি দেবাশীষ নগরে এম এন লারমা স্মৃতি গণপাঠাগারের উদ্যোগে পাঠাগার কার্যালয়ে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানের আয়োজনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এম এন লারমা স্মৃতি গণপাঠাগারের সভাপতি সুমন চাকমা সভাপতিত্বে উক্ত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক শাখার সাধারণ সম্পাদক ইন্টুমনি তালুকদার প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন।
পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম যুব সমিতি ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের উদ্যোগে রাঙ্গামাটির কল্যাণপুরে ১৫ সেপ্টেম্বর সকাল ১০:০০ টায় আলোচনা সভা এবং সন্ধ্যা ৬:০০ প্রদীপ প্রজ্জ্বলন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।
এছাড়া বাংলাদেশ আদিবাসী কালচারাল ফোরামের উদ্যোগে বিকাল ৫:০০ টায় অনলাইন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও কবিতা পাঠের আসর আয়োজন করা হবে। বাংলাদেশ আদিবাসী কালচারাল ফোরামের সভাপতি চন্দ্রা ত্রিপুরার সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিতব্য উক্ত কর্মসূচি আদিবাসী কালচারাল ফোরামের ফেসবুক পেইজ থেকে সরাসরি প্রচার করা হবে।
রাঙামাটি শহরের অনতিদূরে সেই সময়ের এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম মহাপূরমে পার্বত্য চট্টগ্রামের এই মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৩৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাঁর পিতা সেই গ্রামেরই জুনিয়র হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক চিত্ত কিশোর চাকমা ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, মানবতাবাদী, সমাজসেবী ও গণতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার অধিকারী। মাতা সুভাষিণী দেওয়ান ধর্মপ্রাণ ও স্নেহময়ী।
তিনি ১৯৫৮ সালে রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় হতে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর তিনি চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে ১৯৬০ সালে আই এ পাশ করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি বিএ পাশ করেন। এরপর তিনি ১৯৬৮ সালে বিএড পাশ করেন এবং ১৯৬৯ সালে এলএলবি পাশ করেন।
কর্মজীবনে তিনি ১৯৬৬ সালে দীঘিনালা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক পদে, ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রাম রেলওয়ে কলোনি হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে এবং ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বার এসোসিয়েশনে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৫৬ সাল থেকে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবনে পদার্পন করেন। তিনি ছিলেন ১৯৫৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম পাহাড়ী ছাত্র সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা। তিনি ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে এবং ১৯৬০ সালে গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল আন্দোলনে যোগদান করেন। ১৯৬০ সালে পাহাড়ী ছাত্র সমাজে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন এবং ১৯৬২ সালে অনুষ্ঠিত পাহাড়ী ছাত্র সম্মেলনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন।
১৯৬১ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করেন। এর ফলে পাকিস্তান সরকার তাঁকে ১৯৬৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি নিবর্তনমূলক আইনে আটক (চট্টগ্রামের পাথরঘাটাস্থ পাহাড়ী ছাত্রাবাস হতে) করে। দুই বছরের অধিক কারাবোগের পর ১৯৬৫ সালের ৮ মার্চ চট্টগ্রাম কারাগার থেকে শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি লাভ করেন।
১৯৭০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম নির্বাচন পরিচালনা কমিটি গঠন করেন এবং ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট ৪ দফা সম্বলিত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিনামা পেশ করেন।
তাঁর উদ্যোগে ১৯৭২ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি গঠিত হয়। জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে বীরেন্দ্র কিশোর রোয়াজা ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে জুম্মদেরকে ‘বাঙালি’ হিসেবে আখ্যায়িত করার প্রতিবাদে গণ পরিষদ অধিবেশন বর্জন করেন এবং বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাক্ষর প্রদান থেকে বিরত থাকেন।
১৯৭৪ সালে সরকারের পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি হিসেবে কমনওয়েল্থ সম্মেলনে যোগদান উপলক্ষে লন্ডন সফর করেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানের লক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে তিনি ১৯৭৫ সালে বাকশালে যোগদান করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে নিয়মাতান্ত্রিক আন্দোলনের সকল পথ রুদ্ধ তিনি আত্মগোপনে যান এবং সশস্ত্র আন্দোলনের হাল ধরেন।
১৯৭৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ১ম জাতীয় সম্মেলনে তিনি সভাপতি হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হন। এরপর ১৯৮২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ২য় জাতীয় সম্মেলনেও তিনি সভাপতি হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হন।
১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর ভোর রাতে বিভেদপন্থী গিরি-প্রকাশ-দেবেন-পলাশ চক্রের বিশ্বাসঘাতকতামূলক অতর্কিত আক্রমণে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার পানছড়ি উপজেলার খেদারাছড়ার থুমে নির্মমভাবে নিহত হন।